পক্ষে গেলে সাংবাদিকতা মুক্ত, বিপক্ষে গেলে ‘মব’
Published: 7th, August 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো নতুন ধরনের চাপের মুখে পড়েছে। প্রতিবেদন পক্ষে গেলে সাংবাদিকতা ‘মুক্ত’ থাকে, বিপক্ষে গেলে ‘মবের’ (উশৃঙ্খল জনতা) শিকার হতে হয়।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল বুধবার সকালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আয়োজিত এক সংলাপে কয়েকজনের বক্তব্যে এই অভিমত উঠে আসে। ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: অভিযোগ নিষ্পত্তি ও স্বনিয়ন্ত্রণের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
সংলাপে সম্মানিত অতিথি ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের ওপর চাপের ক্ষেত্রে এখন একটি ‘সামাজিক শক্তি’ সক্রিয় রয়েছে। সারা বিশ্বেই কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সময় নতুন সামাজিক শক্তিগুলোর উদ্ভব ঘটে, তারা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং কখনো কখনো তা ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নেয়। এ দেশেও তার কিছু প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তবে এ ধরনের ঘটনায় যে পরিমাণ সহিংসতা হয়, সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে তা হয়নি।
অধিকাংশ মিডিয়া হাউস (গণমাধ্যমের মালিক প্রতিষ্ঠান) এখন তাদের অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তার জন্য গণমাধ্যমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, যত দিন এই বাস্তবতা থাকবে, তত দিন প্রকৃত অর্থে স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব নয়।
সংলাপে দৈনিক মানবজমিন–এর সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সাংবাদিকতাকে মুক্ত বলা হচ্ছে। সাংবাদিকতা মুক্ত, যদি সেটি কারও পক্ষে যায়। তবে বিপক্ষে গেলে চিন্তা আছে। তখন শুরু হয় মব ভায়োলেন্স (উশৃঙ্খল জনতার সহিংসতা)।
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, সাংবাদিকদের অনেকেই এখন পালিয়ে আছেন, অনেকে বিদেশে চলে গেছেন, অনেকে মামলায় জর্জরিত। এর কারণ রাজনীতি। অসুস্থ রাজনীতি সাংবাদিকদের গ্রাস করেছে। রাজনীতিমুক্ত না হলে সাংবাদিকতা মুক্ত হবে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে সরকারকে সমর্থন দেওয়া এবং সুবিধা নেওয়ার কারণেই সাংবাদিকরা চাপের শিকার হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এস এম শামীম রেজা বলেন, সংবিধানসংক্রান্ত যে বিস্তৃত আলোচনা হচ্ছে, সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি অনুপস্থিত। গণমাধ্যমের স্বনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সামনে এনে সাংবাদিকদের অন্য আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হবে কি না, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, সাংবাদিকদের ওপর যে অবিচার হয়, যে চাপ আসে, সেগুলো নিরসন করা হবে না, ব্যাপারটি যেন এ রকম না হয়।
গণমাধ্যমকে পুরো স্বাধীনতা দিতে হবে বলে মন্তব্য করে জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক আসিফ বিন আলী বলেন, এখন যেটা আছে, সেটা ‘অ্যাডহক ফ্রিডম’ (ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীনতা)। কেউ যদি সরকারের ‘প্রেস টিমের’ পরিচিত হয়, তার জন্য ‘ফ্রিডম’ আছে। আর কেউ যদি বিগত সরকারের সময় ভুল করে থাকে, এখন সাংবাদিকতা করতে চায়, তার জন্য ফ্রিডম নেই। এটার সাম্প্রতিক উদাহরণ দৈনিক জনকণ্ঠ।
এখন যেটা আছে, সেটা ‘অ্যাডহক ফ্রিডম’ (ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীনতা)। কেউ যদি সরকারের ‘প্রেস টিমের’ পরিচিত হয়, তার জন্য ‘ফ্রিডম’ আছে। আর কেউ যদি বিগত সরকারের সময় ভুল করে থাকে, এখন সাংবাদিকতা করতে চায়, তার জন্য ফ্রিডম নেই। আসিফ বিন আলী, পিএইচডি গবেষক, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিজনকণ্ঠ দখল হয়েছে উল্লেখ করে আসিফ বিন আলী বলেন, এর পেছনে অ্যাক্টররা (পেছনে থাকা লোক) বিগত সরকারের সময়ও ভিন্ন নামে সক্রিয় ছিল। এখন নতুন করে সক্রিয় হয়েছেন। তিনি বলেন, এখন পরিস্থিতি জটিল। আইনের শাসন না নিশ্চিত করা হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে না।
বাংলাদেশ গণমাধ্যমের মালিকানা পরিস্থিতি তুলে ধরে আসিফ বিন আলী বলেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে বসুন্ধরা গ্রুপের মতো একটা বড়সড় গ্রুপ পুরো মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে জমি দখলের ব্যবসাকে বৈধতা দিতে পারে।
আরও আলোচনাসংলাপে গণমাধ্যম নিয়ে আরও আলোচনা হয়। নানা দিক নিয়ে কথা বলেন আলোচকেরা। গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন সোনার পাথরবাটিতে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে সাংবাদিকদের চাকরি যাওয়ার বিষয়ে মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক রেজাওয়ানুল হক বলেন, ‘প্রশ্ন করার কারণে তিনজন সাংবাদিকের চাকরি গেছে। অফকোর্স এই চাকরি সরকার খায়নি। সরকার মিডিয়া হাউসকে বলে নাই যে এদের কে চাকরি থেকে বের করে দেন।… মিডিয়া হাউসের মালিক তাঁর নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্যে নিজের থেকে চাকরি খেয়েছেন।’
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন থেকে ওয়েজ বোর্ড কীভাবে বাদ গেল, সেই প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ।
‘মব’ করার মাধ্যমে গণমাধ্যম দখল করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ প্রতিদিন–এর নির্বাহী সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন বলেন, দেশের সংবাদপত্রসংশ্লিষ্ট আইনে সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট নয়। প্রেস কাউন্সিল আইনে সীমাবদ্ধতা থাকলেও যেটুকু এখতিয়ার রয়েছে, সেটিরও বাস্তবায়ন হয় না।
সংলাপ সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের সভাপতি জিল্লুর রহমান। এতে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল ও সদস্য মাহমুদা হাবীবা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোনিয়া জামান খান, সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান, কাজী জেসিন প্রমুখ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র সময় ত র জন য র জন ত ব দ কত
এছাড়াও পড়ুন:
ফতুল্লার সেই বিএনপিকর্মী ইব্রাহিম মারা গেছেন
ফতুল্লার বিএনপি কর্মী ইব্রাহিম (৫২) মারা গেছেন। সে ফতুল্লা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য ছিলেন। রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে তিনি ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীনবস্থায় মারা যান।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকালে হাজিগঞ্জ জামে মসজিদে নিহতের নামাজের জানাজা শেষে পাঠানটুলি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
নিহত ইব্রাহিম ফতুল্লা থানার ফতুল্লা ইউনিয়ন ৮ নং ওয়ার্ড হাজীগঞ্জের আব্দুল জলিলের পুত্র। তিনি বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক।
জানা যায়,২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার পল্টনে বিএনপির ডাকা মহা সমাবেশে ফতুল্লা ইউনিয়ন ৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি ও যুবদলের ব্যানারে সে অংশগ্রহণ করে।
সমাবেশের শেষের দিকে মুল মঞ্চের পেছনের দিকে পুলিশের সাথে বিএনপির নেতা,কর্মীও সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। সে সময় পুলিশ বিএনপি নেতা- কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের কে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
ইব্রাহিম পুলিশের হামলায় মারাত্নক আহত হয়ে রাস্তায় পরে থাকে। সে সময় সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়। ঘটনার চারদিন পর তার সহোযোগিরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে খুঁজে পায়। দীর্ঘদিন সহোযোগিরা নিজেদের অর্থায়নে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মদনপুর আল বারাকা নামের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা করায়।
পরবর্তীতে ইব্রাহিমকে নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন হলে বিএনপি নেতা ও শিল্পপতি আবু জাফর আহমেদ বাবুল তার চিকিৎসার দ্ধায়িত্ব নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পিজি হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানেই রোববার রাতে তিনি মারা যান।
ফতুল্লা ইউনিয়ন যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোঃ পারভেজ মিয়া জানান,নিহত ইব্রাহিম ২০২৩ সালে ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ঘোষিত পল্টন পার্টি অফিসের সামনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে ফতুল্লা ইউনিয়ন বিএনপি ও ইউনিয়ন যুবদলের সাথে ঢাকায় গিয়েছিলেন ।
সমাবেশ চলাকালে ফতুল্লা ইউনিয়ন ৮ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি রুহুল আমিন টিপু ও নিহত ইব্রাহিম এবং তিনি সহ আরো নেতা-কর্মীরা পল্টন পার্টি অফিস সংলগ্ন চায়না টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ পুলিশ তাদের উপর চড়াও হয়। এতে করে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে।
অতর্কিত হামলায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর প্রায় চার দিন পর পত্রিকার নিউজে দেখতে পায় ইব্রাহিম নামে একজন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
সেই সংবাদের পর তার পরিবারের লোকজন এবং ৮ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রওশন আলী ঢাকা মেডিকেলে খোঁজ নেওয়ার পরে তারা নিশ্চিত হন যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে থাকা চিকিৎসারতি হচ্ছে তাদের নিখোঁজ ইব্রাহিম।
ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসা শেষ করে তাকে বাসায় আনা হয়। বাসায় আনার পরে উনি আবার অসুস্থ হয়ে পরে। ফলে ৮ নং ওয়ার্ডের সকল নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় পুনরায় তাকে মদনপুর আল বারাকা হসপিটালে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রায় তিন মাস চিকিৎসা শেষে তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে তিনি আবারও অসুস্থ হয়ে পরেন।
এমতাবস্থায় নাসিক ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল হক রিপন তাকে দেখতে আসলে স্থানীয় গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশ পায়। প্রকাশিত সংবাদের পর বিএনপি নেতা শিল্পপতি প্রাইম বাবুল ভাই তার চিকিৎসার দ্ধায়িত্ব নেন।
বাবুল ভাই নিজে এসে তার দাত্ব নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি করান। দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থায় রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) রাত আনুমান ১১ টা ৪০ মিনিটের সময় তিনি ইন্তেকাল করেন।