ধর্ম–সম্প্রদায়ের পরিচয় ছাপিয়ে আনন্দই যেখানে মুখ্য
Published: 1st, October 2025 GMT
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে আমাদের রেলওয়ে কোয়ার্টারের পাশেই ছিল ছোট খেলার মাঠ। মাঠের এক প্রান্তে হাসপাতাল, রেলওয়ে ক্লাব আর পাশেই হাসপাতাল কলোনির সরু রাস্তা। হাসপাতাল কলোনি স্কুলের মাঠেই বসত দুর্গাপূজার মণ্ডপ। মহালয়ার দিন থেকেই বাজত মাইক। শুরু হতো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের মহিষাসুরমর্দিনী দিয়ে।
‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক-মঞ্জীর;/ ধরণির বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;/ প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।’
আশ্বিন মাসের আবহাওয়ার আচরণ বোঝা ভার। কখনো চিটচিটে গরম, বিকেলের দিকে নরম ঝিরঝিরে বাতাস। আবার কখনো টানা বৃষ্টি। এই সময় খটখটে শুকনো আবহাওয়া একটানা থাকলে আমাদের প্রতিবেশী লক্ষ্মী মাসি বলতেন, এবার মা দুর্গা ঘোড়ায় চড়ে এলেন। আর বৃষ্টি হলে বলতেন দেবী এসেছেন নৌকায়।
মহালয়ার পর থেকেই হাসপাতাল কলোনির মাইক দশমীর দিন পর্যন্ত লাগাতার বেজে চলত। মণ্ডপের মাইক থেকে ভেসে আসা সুরের সঙ্গে আমরা নিজের অজান্তে গুন গুন করে গাইতাম লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, কিংবা ‘ও পলাশ ও শিমুল আমায় কেন এত রাঙালে’। পূজার কল্যাণে প্রতিবছরই আমাদের কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, বাপ্পী লাহিড়ীর নিত্যনতুন গান শোনা হয়ে যেত।
তবু হাসপাতাল কলোনির পূজায় জাঁকজমক তেমন ছিল না। দুর্গা প্রতিমার চেহারাটাও ছিল একেবারে আটপৌরে গৃহী নারীদের মতো। ত্রিশূলবিদ্ধ কোঁকড়ানো চুলের মহিষাসুর আর তার শরীরে কামড় বসানো সিংহও ছিল নিরীহ চেহারার। কিন্তু মণ্ডপে গেলে অপলক চেয়ে থাকতে হতো। সবচেয়ে অবাক লাগত গণেশকে দেখে। হাতির শুঁড় থাকলেও তাকে ভয়ংকর মনে হতো না। বরং পাশের বাড়ির নাদুসনুদুস দুষ্টু বালক যেন।
ষষ্ঠীর দিন প্রতিমা আনার পর ঢাকের শব্দ পুরো এলাকায় আলাদা আমেজ তৈরি করত। আমাদের বাড়ির অন্যতম সদস্য রেল কর্মচারী শ্রীধাম দাদা ঢাকের বোলের অর্থ ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, পূজার ঢাকও মানুষের মতো কথা বলে। শুনতে শুনতে আমারও তা-ই মনে হতো। মনে হতো ঢাক বলছে, ‘কর্তা কোথায়, কর্তা কোথায়’। এরপর ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ/ ঠাকুর যাবে বিসর্জন’।
পূজামণ্ডপে ঢাকা বাজাতে দেখতাম রেলওয়ে পাড়ার বাবুল দাশকে। রেলওয়েতে চাকরি করতেন তিনি। অবসর সময়ে কমার্শিয়াল থিয়েটার করতেন। দেখতে ছিলেন নায়কের মতো। আমরা বলতাম সোহেল রানা। একবার রেলওয়ে ক্লাবের বড় হলঘরের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকেছি, সেখানে দেখালাম বাবুলদা নাটকের মহড়া করছেন। একটা দৃশ্যে মদহীন মদের বোতল হাতে তিনি পড়ে যান স্টেজে। আবহে বাজছিল ‘আশা ছিল, ভালোবাসা ছিল, আজ আশা নেই, ভালোবাসা নেই।’ মণ্ডপে সেই বাবুলদাকে দেখা যেত ঘন চুল দুলিয়ে ঢাক বাজিয়ে চলছেন। সেই দৃশ্য বড়ই মনোহর। মণ্ডপের সামনে ধূপের ধোঁয়াও যেন তাঁর ঢাকের তালে নেচে উঠত।
পূজার আনন্দ শতভাগকলেজিয়েট স্কুলে ভর্তির পর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই আমি, সুজিত, রনি, অরূপ একসঙ্গে বসতাম, চলতাম, টিফিনও খেতাম। ছুটির পর ফুটবল খেলা কিংবা মেরিনা হোটেলে বসে পরোটা আর ডাল ভাগ করে খাওয়াও চলত একসঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগপর্যন্ত আমাদের এই সখ্য অটুট ছিল। বিশেষ করে অরূপের সঙ্গে। অন্য সেকশনে পড়া রাজাও ছিল আমাদের কমন বন্ধু।
রাজা আর অরূপ দুজনেই থাকত দক্ষিণ নালাপাড়ায়। আমার দুই ঈদই কাটত অরূপের সঙ্গে। আর পূজা এলে আমিও নালাপাড়া ছেড়ে আসতে পারতাম না। পরে কলেজে উঠে ওই পাড়ার উত্তম, জুয়েলসহ আরও অনেক বন্ধু জুটে যায়। দিনভর আড্ডা, ঢাকের বোলের সঙ্গে উদ্দাম নাচ, খাওয়াদাওয়া সবখানে আমিও ছিলাম শতভাগ। পূজার এই একটা বিশেষ দিক। ধর্মের পরিচয় ছাপিয়ে আনন্দই মুখ্য হয়ে উঠত।
নালাপাড়ার সর্বজনীন দুর্গাপূজা এবার ৭৮ বছরে পা দিল। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সাল থেকে কোর্ট বিল্ডিংয়ের কর্মকর্তা সতীশবাবুর উদ্যোগে প্রথম পূজা শুরু হয় এই পাড়ায়। পরে পূজাটা বারোয়ারি হয়ে ওঠে। সত্তর-আশির দশক থেকেই নালাপাড়ার পূজা চট্টগ্রাম শহরের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই সময় হাজারি লেন, দেওয়ানজী পুকুরপাড়, পাথরঘাটার পাঁচবাড়ির মতোই নালাপাড়ার মণ্ডপও বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
দুর্গাপূজা শেষ হয়ে গেলেও তার রেশ থেকে যায় লক্ষ্মীপূজা অর্থাৎ কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত। লক্ষ্মীপূজার সময় এলেই মনে পড়ে নাড়ুর কথা। একবার বেড়াতে গিয়েছি চাঁদপুরের শ্বশুরবাড়িতে। স্ত্রী-পরিজন নিয়ে লক্ষ্মীপূজার আমন্ত্রণ ছিল শ্বশুরবাড়ির পাশের পালপাড়ায়। সেখানে চার-পাঁচটি বাড়িতে নাড়ু খেতে হলো। সেমাই, চালের গুঁড়া, নারকেল দিয়ে তৈরি বিচিত্র সব নাড়ু। একটা বাড়িতে সেই নাড়ু খেয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করতেই গৃহকর্ত্রী ব্যাগ ভর্তি করে নাড়ু এনে দিলেন। আমি বিস্মিত। এত নাড়ু কী করব। বৃদ্ধা মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘বাড়ি নিয়ে যা। খেতে খেতে আমার কথা মনে করিস।’
রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনির দুর্গাপূজার আনন্দের সুর কেটে গিয়ে বিষাদের মুহূর্ত তৈরি হতো দশমীর দিন। সেদিন বিকেলের দিকে ট্রাক এসে দাঁড়াত কলোনির মাঠের এক কোণে। সেখান থেকে একদল কাঁধে করে প্রতিমা ওঠাতেন ট্রাকে। প্রতিমার পেছন পেছন অসংখ্য শিশু-কিশোর, তরুণ। সবার ‘কণ্ঠে দুর্গা মা কি জয়’ ধ্বনি । সব প্রতিমার নাম নিত তারা। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ। জয়ধ্বনি থেকে বাদ পড়ত না অসুরও।
শিশু-কিশোরদের অনেকেই ট্রাকে চড়ে বসত। ঢাক বাজাতে বাজাতে সেই ট্রাক চলে যেত পতেঙ্গার দিকে। পেছনে হাসপাতাল কলোনির সরু রাস্তায় তখন কয়েক শ নারী দাঁড়িয়ে। কেউ নিঃশব্দে, কেউ সশব্দে কাঁদছেন। এর চেয়ে বিষাদের দৃশ্য আর কী হতে পারে!
আহমেদ মুনির প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
.