মহান আল্লাহ মানুষের জন্য মহাবিশ্বকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে তাতে স্থির ও সর্বব্যাপী নিয়ম বা সুন্নাহ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, “তারা কি পূর্ববর্তীদের সুন্নাহ ছাড়া অন্য কিছুর অপেক্ষা করে? তুমি আল্লাহর সুন্নাহর কোনো পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর সুন্নাহর কোনো বিচ্যুতি পাবে না।” (সুরা ফাতির, আয়াত: ৪৩)

এই সুন্নাহ মানে রীতি বা নিয়ম, যেই নিয়মগুলো বিশ্বজগত, মানুষের মন ও সমাজে ছড়িয়ে আছে। এগুলো স্থির এবং অপরিবর্তনীয়, যা আমাদের জীবন ও সমাজের গতিপথ নির্ধারণ করে।

এই সুন্নাহ মানুষের জন্য আল্লাহর রহমত। এগুলোর ধারাবাহিকতা ও স্থায়িত্বের কারণে আমরা আমাদের চারপাশের জগতকে বুঝতে এবং তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারি। কল্পনা করুন, যদি আগুনের পোড়ানোর নিয়ম, মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম বা মানুষের প্রচেষ্টা ও আচরণের ভিত্তিতে অবস্থার উন্নতি বা অবনতির নিয়ম স্থির না থাকত, তাহলে আমাদের জীবন কতটা বিশৃঙ্খল হতো।

তোমাদের আগে অনেক সুন্নাহ অতিবাহিত হয়েছে। তাই পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদের পরিণতি কী হয়েছিল।সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৭

এই সুন্নাহগুলো আমাদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে, যা আমাদের প্রচেষ্টাকে সহজ করে এবং জীবনের জটিলতা বোঝার পথ দেখায়।

আরেকটি রহমত হল, সমাজের বেশিরভাগ পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঘটে। মানুষের জীবনকাল সভ্যতার আয়ুষ্কালের তুলনায় খুবই সংক্ষিপ্ত। ফলে আমরা প্রায়শই কোনো ঘটনার কারণ দেখি, কিন্তু ফলাফল দেখার সময় পাই না, অথবা ফলাফল দেখি, কিন্তু তার কারণ বুঝতে পারি না। এই সুন্নাহ আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে একটি একক কাঠামোতে বেঁধে দেয়।

আল্লাহর সুন্নাহ: সর্বদিক থেকে সমন্বয়

আল্লাহর সুন্নাহ হল এমন সাধারণ নিয়ম, যা নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হলে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে স্থিতিশীলতা ও সমন্বয় নিশ্চিত করে। এর অর্থ হল, একজন মুসলিমকে অতীতের গভীরে যেতে হবে তার বর্তমানের শিকড় বোঝার জন্য এবং বর্তমানের বাইরে তাকাতে হবে ভবিষ্যতের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে।

কোরআন এ বিষয়ে বহু নির্দেশ দিয়েছে। যেমন, “তোমাদের আগে অনেক সুন্নাহ অতিবাহিত হয়েছে। তাই পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদের পরিণতি কী হয়েছিল।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৭)

আবার বলা হয়েছে, “বল, পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, আল্লাহ কীভাবে সৃষ্টি শুরু করেছেন। তারপর আল্লাহ পরবর্তী সৃষ্টি সৃজন করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।” (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ২০)

স্থান সবসময় সময়ের উত্তরাধিকারী; তাই বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের মাধ্যমে আমরা অতীতের বিভিন্ন সময়ের চিহ্ন এবং আল্লাহর সৃষ্টির প্রমাণ দেখতে পাই।

একসময় এই উম্মাহ জাতিগুলোর মধ্যে শীর্ষে ছিল, কিন্তু এখন এটি পিছিয়ে পড়েছে। এই পতন থেকে উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ হল ইতিহাসের কারণগুলো খুঁজে বের করা, যা আমাদের এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে।

বর্তমানে বিশ্ব একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ হয়ে উঠেছে, যা বাস্তবতাকে আরও জটিল করে তুলেছে। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির কিছু অংশ আমাদের নাগালের মধ্যে থাকলেও, এর শিকড় ও প্রভাব মুসলিম ভূখণ্ডের বাইরেও বিস্তৃত।

আরও পড়ুনদৈনন্দিন জীবনের ৬টি সহজ সুন্নাহ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫সুন্নাহ ও ‘ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান’

পশ্চিমা বিশ্বে আজ “ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান” নামে একটি শাখা গড়ে উঠেছে। তারা ভবিষ্যৎকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করে: এক বছরের জন্য স্বল্পমেয়াদী, পাঁচ বছরের জন্য নিকটবর্তী, বিশ বছরের জন্য মধ্যমেয়াদী, পঞ্চাশ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদী এবং তার বেশি সময়ের জন্য অতি দীর্ঘমেয়াদী।

তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার কারণে তারা প্রযুক্তি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারে। কিন্তু তারা ধর্মের পরিবর্তে বিজ্ঞানকে মানুষের আচরণের প্রধান নিয়ন্ত্রক মনে করে, যা তাদের অনেক পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণ করে।

মানব ইতিহাস ধর্মীয় বাণী ও শরীয়ার ইতিহাস, যা মানুষের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাবের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। এটি যারা এই দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে তাদের কাছে বোধগম্য হয় না।

কোরআন আমাদের শেখায় যে অতীত জাতিগুলোর ধ্বংস হয়েছে, তা তাদের উন্নয়নের অভাবে নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশ মান্য না করা এবং তার পথ থেকে বিচ্যুতির কারণে।

কোরআন আমাদের শেখায় যে অতীত জাতিগুলোর ধ্বংস হয়েছে, তা তাদের উন্নয়নের অভাবে নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশ মান্য না করা এবং তার পথ থেকে বিচ্যুতির কারণে। পশ্চিমারা এটি বুঝতে ব্যর্থ হয় বলে তাদের অনেক ভবিষ্যৎ গবেষণা অপ্রয়োজনীয় দিকে যায়।

হ্যাঁ, ইসলামও আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে শেখায়। একজন মুসলিম মৃত্যু পর্যন্ত আখিরাতের কথা চিন্তা করে, যা তার বর্তমানের প্রতিটি কাজ ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।

কোরআন এই বিষয়ে সাধারণ নির্দেশনা দেয়, যেমন, “আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।” (সুরা রাদ, আয়াত: ১১)

আবার বলা হয়েছে, “বল, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, তিনি অতি ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি পাঠাবেন, তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগান ও নদী সৃষ্টি করবেন।” (সুরা নূহ: ১০-১২)

হাদিসেও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিস্তারিত আছে, যেমন ফিতনা পূর্ব দিক থেকে আসবে বা অনৈতিকতার কারণে অজানা রোগ ছড়াবে। (সহিহ বুখারি, কিতাবুল ফিতান, হাদিস: ৭০৯১)

আমাদের পূর্বসূরি আলেমগণ এই সুন্নাহ বুঝে বাস্তবতার সঙ্গে বিশেষভাবে মোকাবিলা করতেন। আবু বকর বলতেন, “জীবিতদের প্রশংসা করো না, যদি না তুমি মৃতদের জন্য তা করতে পারো।” এটি জাগতিক বিষয়ের পরিণতি এক মুহূর্তে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। ওমর (রা.