পানিশূন্যতা পূরণে ওরস্যালাইনের ভূমিকা
Published: 29th, July 2025 GMT
আলোচনা
তছলিম উদ্দীন খান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এসএমসি
বাংলাদেশেরই একটি প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি ওআরএস উদ্ভাবন করে, যা পরবর্তী সময় সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। পরে ব্র্যাক নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে এর জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আমরা সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি) ১৯৮৫ সালে প্যাকেটজাত ওআরএস নিয়ে যাত্রা শুরু করি। এই ৪০ বছরের প্রতিশ্রুতিশীল পথচলায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৫৫ থেকে বেড়ে ৭২ দশমিক ৩ বছর হয়েছে এবং শিশুমৃত্যুর হার ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
এখন এসএমসি ওরস্যালাইন শুধু ডায়রিয়া-কলেরা মোকাবিলায় নয়, কোটি কোটি মানুষের প্রতিদিনের পানিশূন্যতা পূরণেও ভূমিকা রাখছে। এসএমসির বিশ্বমানের উৎপাদনব্যবস্থায় আধুনিক ফর্মুলেশনে ওরস্যালাইন তৈরি হয় এবং স্বল্পমূল্যে বিপণনের ফলে দ্রুত মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। ওরস্যালাইন এখন বাড়ির পাশে ছোট্ট দোকানেও পাওয়া যায়, যার দাম মাত্র ছয় টাকা।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ওআরএস) হলো মূলত জীবন রক্ষাকারী তরল পানীয়, যা পরিষ্কার পানি, গ্লুকোজ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও সাইট্রেট দিয়ে তৈরি। গ্লুকোজ বিশেষভাবে পানি ও ইলেকট্রোলাইট শোষণে সাহায্য করে, যা শরীরে হারানো ফ্লুইড পূরণ করে।
ল্যানসেট ১৯৭৮ সালে বলেছিল যে ওআরএস বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা উদ্ভাবন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ উভয়েই একে কম খরচে জীবন রক্ষাকারী উপাদান হিসেবে সমর্থন করেছে।
এসএমসির ওরস্যালাইন এখন দেশের অন্যতম সেরা ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে। আমরা সব সময় নিত্যনতুন উদ্ভাবনের চেষ্টা করি। ২০০৪ সাল থেকে আমরা নিজস্ব বিশ্বমানের ফ্যাক্টরিতে ওআরএস-এন তৈরি শুরু করি, যা বাজারের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। আমরা জিংক ট্যাবলেট সহজলভ্য করার জন্যও কাজ করেছি। কারণ, ওআরএস ও জিংকের সম্মিলিত ব্যবহার ডায়রিয়ার পরবর্তী পর্ব ও তীব্রতা উভয়ই কমায়।
দেশের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ৭৫ শতাংশ শিশু ওরস্যালাইন খাচ্ছে। বাকি ২৫ শতাংশ জনগণের কাছে পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে দুর্গম এলাকা, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ও অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের ওরস্যালাইনের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী ও মিডিয়ার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
তাহমিদ আহমেদ
নির্বাহী পরিচালক, আইসিডিডিআরবি
সারা বিশ্বে ৪০ বছর আগে বছরে ৪৫ লাখ শিশু মারা যেত, এখন তা কমে ৬ লাখে নেমেছে। এর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে ওরস্যালাইন। শুধু ওরস্যালাইন নয়, বাংলাদেশে জিংকের ওপর গবেষণা হয়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে ১০ দিনের জন্য জিংক দেওয়া হলে সেই শিশুর ডায়রিয়ার তীব্রতা ও স্থায়িত্ব কমে যায় এবং পরবর্তী ছয় মাসে মৃত্যুঝুঁকিও হ্রাস পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউনিসেফ এখন ওরস্যালাইন ও জিংককে শিশুদের ডায়রিয়ার চিকিৎসায় অপরিহার্য হিসেবে সুপারিশ করে।
যদি লবণের সঙ্গে চিনি বা গ্লুকোজ মেশানো হয়, তাহলে পানি শরীর শোষণ করতে পারে, এটিই ছিল ওআরএস আবিষ্কারের মূলনীতি। আইসিডিডিআরবির এই উদ্ভাবন সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। গবেষণা শুধু করলেই হবে না, সেটিকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। এই প্রয়োগে ব্র্যাকের ভূমিকা বিরাট। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীরা এই কাজ শুরু করেন। ১৯৮৫ সাল থেকে এসএমসি প্যাকেটজাত ওরস্যালাইন বিতরণ শুরু করে। ১৯৮৭ সালের পর বাংলাদেশ সরকারও এ প্রোগ্রামটি তাদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান অনুযায়ী, ওআরএস প্রায় ছয়-সাত কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। আমার জানামতে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নেই যা এত সংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এটি সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্বের জন্য একটি উপহার।
বর্তমানে ওআরএসের কভারেজ রেটে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে ১ নম্বরে, এখানে প্রায় ৭৫ শতাংশ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে ওআরএস দেওয়া হয়। আফ্রিকার অনেক দেশে এটি এখনো ১৫ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি নয়। বাংলাদেশে এখনো ২৫ শতাংশ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু ওআরএসের সুবিধা পাচ্ছে না। এই ২৫ শতাংশ কারা, কোন আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর মানুষ, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত, যাতে নির্দিষ্ট এলাকা ধরে কাজ করা যায়। আমার মনে হয়, স্কুলপর্যায়ে একটি সচেতনতা অভিযান দরকার, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবার ও প্রতিবেশীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে। আমার মতে, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
বিশ্ব ওআরএস দিবস উপলক্ষে ওআরএসের আবিষ্কার ও উদ্যাপন নিয়ে এই সভার আয়োজনের জন্য প্রথম আলো ও এসএমসিকে ধন্যবাদ জানাই।
আবু জামিল ফয়সাল
জনস্বাস্থ্যবিদ
জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। কিছু কথা পুনরাবৃত্তি হতে পারে, তবে তা গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, মানুষের সচেতনতা বাড়ানো যেমন অবশ্যই দরকার, কিন্তু এখন একটা পর্যায়ে আসছে যে আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতার থেকে স্বাস্থ্যশিক্ষা বাড়াতে হবে। শুধু একটুখানি সচেতনতা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। স্বাস্থ্যশিক্ষা বলতে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য কীভাবে সুন্দর রাখা যায়, তা বোঝায়। স্বাস্থ্য সচেতনতা মানে শুধু ‘ওআরএস খাও’, কিন্তু স্বাস্থ্যশিক্ষা মানে কখন, কতটা ও কীভাবে সঠিকভাবে ওআরএস ব্যবহার করতে হবে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ওআরএস একটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। ওআরএস তৈরির জন্য বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা অপরিহার্য। আমি আমার গ্রামের একটি ঘটনা জানি, যেখানে পুকুরের অপরিষ্কার পানিতে ওআরএস মিশিয়ে খাওয়ানোর ফলে একটি শিশুর ডায়রিয়া আরও বেড়ে গিয়েছিল, অর্থাৎ পানি কী পরিমাণের ভালো ও বিশুদ্ধ হতে হবে, তা না হলে এর উপকার পাওয়া যাবে না, এটাও বলতে হবে।
প্যাকেজিংয়ে ওআরএস কখন খাওয়া যাবে না বা কীভাবে ভুল ব্যবহার করা যাবে না, সে বিষয়ে সতর্কীকরণ বার্তা দেওয়া প্রয়োজন। স্যাশেগুলো এত ছোট থাকে যে এসব কথা বলার হয়তো জায়গা থাকে না। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যশিক্ষা ও অ্যাডভোকেসি দরকার।
আমাদের উচিত এসব বিষয়ে গবেষণা করা। যাঁরা ম্যানুফ্যাকচারার, যাঁরা এনজিও হিসেবে মাঠে-ঘাটে কাজ করেন, তাঁদের এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে। সামগ্রিকভাবে এ বিষয়গুলো আমাদের আলোচনায় ও গবেষণায় আনতে হবে, যাতে ওআরএসের কার্যকারিতা আরও বাড়ানো যায় এবং আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর অপচয়, অপব্যবহার ও ভুল তথ্য রোধ করতে পারি।
সুকুমার সরকার
জনস্বাস্থ্যবিদ
১৯৯০ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম পরিবার পর্যায়ে ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনার ওপর একটি জরিপ হয়, তখন দেখা গিয়েছিল যে লবণ-গুড় সলিউশন শেখানো হলেও মানুষ পরিমাণমতো মেশাতে পারছিল না, ফলে জটিলতা দেখা যাচ্ছিল। এ প্রেক্ষাপটে প্যাকেটজাত ওআরএসের ধারণাটি আসে। এসএমসি এটির অন্যতম প্রধান প্রচারক ছিল। প্যাকেটজাত ওআরএসের আজকের এ সহজলভ্যতা এক দিনে আসেনি। সরকারের সীমিত প্রোগ্রামের বিপরীতে, বাজারের মাধ্যমে, বিশেষ করে এসএমসির প্রচেষ্টায় ডায়রিয়ার এ স্থানীয় সমস্যা সমাধান সম্ভব হয়েছে, যা আমাদের উচ্চস্বরে স্বীকার করা উচিত।
সাধারণ মানুষ, এমনকি চিকিৎসকদের মধ্যেও একটি ভুল ধারণা ছিল যে ডায়রিয়া হলে শিরায় স্যালাইন দেওয়া উচিত। কমিউনিটির বিশ্বাস ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার এ ধারণাকে পরিবর্তন করা ছিল একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আইসিডিডিআরবির তত্ত্বাবধানে চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক ও মাঠকর্মীদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত ‘ওআরটি ক্যাম্পেইন’-এর মাধ্যমে সারা দেশে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফলে আজ আমরা ওআরএসের উচ্চ ব্যবহার হার দেখতে পাচ্ছি।
হাসপাতালগুলোতে বাচ্চাদের ডিহাইড্রেশন ওআরএস খাইয়ে ঠিক করা শুরু হয়, যা পরিবার ও কমিউনিটির আস্থা বাড়ায়। গণমাধ্যম ও এসএমসির টেলিভিশন ক্যাম্পেইনগুলোও এ সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিকের পর ওআরএসকে দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রভাবশালী স্বাস্থ্য উদ্ভাবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমার জন্য এটি একটি অত্যন্ত আবেগের ও গর্বের বিষয়। কারণ, ওআরএস ছিল আমার পেশার প্রথম কাজ। আমি ভীষণ আনন্দিত যে আজ ওআরএস দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের শিক্ষক।
কাজী মহিউল ইসলাম
সাবেক মহাপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
আমি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শুরু করতে চাই। ১৯৯৪ সালে আমার সন্তান ডায়রিয়ায় মারাত্মক আক্রান্ত হয়। তখন মনে হয়েছিল, তাকে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত আমার সন্তানের জীবন বেঁচে উঠেছিল ওরস্যালাইনের কারণে। আইসিডিডিআরবি, ব্র্যাক, এসএমসি ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। এ ঘটনা কেবল আমার একার নয়, এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে, যারা এ রকম জীবনরক্ষাকারী সেবার উপকারভোগী।
আপনারা অনেক কাজ করছেন। আমরা সত্যিই গর্বিত। বাংলাদেশ সরকার থেকে শুরু করে এনজিও, আইএনজিও, বেসরকারি খাত, এসএমসি—সবাই অনেক অনেক কাজ করছে। তারপরও বিশ্বের শীর্ষ ২০টি উচ্চ পানিশূন্যতাজনিত বোঝাগ্রস্ত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম এখনো বিদ্যমান। সুতরাং পানিশূন্যতা পূরণে এত অর্জন সত্ত্বেও আমাদের আত্মতুষ্টিতে না ভুগে আরও বেশি মানুষকে এ সেবার আওতায় আনতে কাজ করতে হবে। আমাদের কাজ করতে হবে আকাশের নিচে ঘুমানো শিশুদের নিয়েও। ওরস্যালাইন খাওয়া নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে।
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা ২০২৪ সালের মে-জুন মাসে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা আইসিডিডিআরবি হাসপাতালেই ৩১ জন মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি কি জানেন, ওআরএস কীভাবে বানাতে হয়?’ ৩১ জনের মধ্যে ২৬ জনই বলেছেন, ‘আমরা তো জানতাম এটা বুকের দুধের সঙ্গে যায়।’ অর্থাৎ মায়েরা ওআরএস পান করলে তা শিশুর শরীরে যাবে। অথচ বাস্তবতা হলো শিশুর পানিশূন্যতা হলে শিশুকেই ওরস্যালাইন খাওয়াতে হবে। এ ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের কাজ করতে হবে।
হাসিন জাহান
কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ
ওআরএস যেভাবে প্রতিকারের মাধ্যমে মানুষকে, বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যুর হার কমাতে সহায়তা করে, সেটি অভাবনীয়। ঠিক একইভাবে আমরা যদি প্রতিরোধের ব্যবস্থায় যাই, তবে নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি দিয়ে আমরা এ পানিবাহিত ডায়রিয়া কমাতে এবং শিশুকে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারি।
শুধু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা দিয়ে আমরা এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। বারবার ডায়রিয়া হলে শিশুর শোষণ ক্ষমতা কমে যায়, বিশেষ করে পুষ্টির শোষণ। ফলে পরবর্তী সময়ে তার অন্যান্য দিকের বৃদ্ধিও কমে আসে। এ বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন।
দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় প্রতিরোধে ওরস্যালাইনের ভূমিকা কী, সেটি আলোচনা করা যেতে পারে। একটি ভালো দিক হলো সরকার এখন যেসব ত্রাণ দিয়ে থাকে, সেখানে ওআরএস একটি অন্তর্নিহিত উপাদান হিসেবে থাকে।
আমরা উপকূলীয় অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, দুর্যোগ প্রভাবিত এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই পানি লবণাক্ত থাকে। এ কারণে সেখানকার মানুষের উচ্চ রক্তচাপও বেশি—এটি পরীক্ষিত ও গবেষণায় এসেছে। ঘূর্ণিঝড় বা কোনো দুর্যোগ হয়, তখন একই স্যালাইনের প্যাকেট সেখানে যায় এবং রোগীরা যখন অপেক্ষাকৃত লবণাক্ত পানি দিয়ে সেই স্যালাইন পান করেন। এটি তাঁদের জন্য ক্ষতিকর কি না, এ বিষয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। সেখানে কি এই স্যালাইনের উপযুক্ত কোনো বিকল্প রয়েছে অথবা সেখানে রাইস স্যালাইন যেতে পারে অথবা এখানের কম্পোজিশন কি পরিবর্তন হতে পারে? এসএমসি ও আইসিডিডিআরবি নিশ্চয়ই জলবায়ুসহনশীল কোনো ওআরএস নিয়ে কাজ করতে পারে। এতে আমরা পানিশূন্যতা মোকাবিলায় যেটুকু পিছিয়ে আছি, সেটাও কাটিয়ে উঠতে পারব।
মো.
আবদুল মান্নান
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, নবজাতক বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
একটি বাস্তবতা দিয়ে আমার কথা শুরু করতে চাই। আমার নানাকে দেখিনি। ডায়রিয়ার কারণে তিনি মারা গিয়েছিলেন। তিনি পানি খাওয়ার জন্য অনেক ব্যাকুল ছিলেন, তবু তাঁকে পানি দেওয়া হয়নি। তখনকার ধারণা ছিল যে ডায়রিয়া হলে যেহেতু শরীর থেকে পানি বের হয়ে যাচ্ছে, পানি দিলে আরও বেশি পানি বের হয়ে যাবে। এ রকম অসচেতনার জন্য কত জীবন ঝরে গেছে অকালে।
তবে আইসিডিডিআরবির মাধ্যমে দেশজুড়ে, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে পেশাদার সংগঠনগুলো যে সচেতনতা নিয়ে এসেছে, ফলে হাজারো মানুষ ও লাখো শিশুর জীবন ওরস্যালাইনের মাধ্যমে রক্ষা পেয়েছে। এটি আমাদের সৌভাগ্য যে আইসিডিডিআরবি এটি আমাদের দেশেই তৈরি করেছে। এটি এখন সারা পৃথিবীতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ডায়রিয়ার পাশাপাশি বমিতেও খাওয়ার স্যালাইনের নির্দেশিকা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে একবারে বেশি না দিয়ে অল্প অল্প করে দিতে হবে। এ ছাড়া উচ্চ জ্বরের কারণেও শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। এটি প্রতিরোধেও খাওয়ার স্যালাইনের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। গর্ভধারণ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, নবজাতকের ক্ষেত্রে ওরস্যালাইন খাওয়া যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে পরামর্শ মেনে পরিমিত খেতে হবে।
আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, প্রতি হাজার জীবিত জন্মে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু ৩১ থেকে ২৫-এ নামিয়ে আনা। এ লক্ষ্য অর্জনে টিকাদান, জিংক, ওআরএস, নারীশিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা—সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ওআরএস এমন একটি উদ্ভাবন, যা কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। আমি মনে করি, ওআরএস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দাবিদার।
তাহমিনা বেগম
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে শিশু বিভাগে রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করতাম। তখন অজস্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু ডায়রিয়া নিয়ে আসত, আর আমরা কিছুই করতে পারতাম না। কাঁদতে কাঁদতে আমি বাসায় যেতাম। সেই চিত্রটা এখন পাল্টে গেছে।
বর্তমানে ডায়রিয়া ও ওআরএস একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখন সবাই জানে, ডায়রিয়া হলে ওআরএস খেতে হবে। কারণ, কলেরা ও ডায়রিয়াজনিত অন্যান্য রোগে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। পানিশূন্যতায় শিশুর রক্তচাপ কমে যায়, শিশু অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, কিডনি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। ওআরএস পানিশূন্যতা পূরণ করে লাখ লাখ শিশুর জীবন বাঁচাচ্ছে।
ওআরএস কতটুকু দিতে হয়, তা শিশুর ওজন অথবা বয়সভেদে নির্ধারিত হয়। যেমন ছয় মাসের নিচে হলে ১০ চামচ, ছয় মাস থেকে এক বছর হলে ১৫ চামচ ও দুই বছর হলে ১৫ থেকে ২০ চামচ করে দিতে হয়। ডায়রিয়ার সঙ্গে যেহেতু বমিও প্রায়ই থাকে, তাই আমরা মায়েদের বলি ওআরএস ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে খাওয়াতে, যাতে তা শোষিত হতে পারে।
ডায়রিয়া হলে খাদ্যনালির ভেতরের লাইনিং নষ্ট হয়ে যায়, যা পুনর্গঠনের জন্য খাবারের প্রয়োজন হয়। তাই যদি শিশুর বয়স ছয় মাসের কম হয়, তাহলে অবশ্যই ওআরএসের পাশাপাশি মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাসের বেশি হলে স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে।
ওরস্যালাইন একটু একটু করে মিশিয়ে খাওয়ান অনেকে। এ কারণে লবণ ও পানির পরিমাণের অনুপাত নষ্ট হয়ে যায়। তাই এখন বাজারে যে প্যাকেট পাওয়া যায়, তা আধা লিটার পানিতে পুরোটা মিশিয়ে বয়স অনুযায়ী খাওয়াতে হবে।
সৈয়দ আব্দুল হামিদ
অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ওআরএসের তেমন কোনো ঝুঁকি নেই; বরং সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি অত্যন্ত নিরাপদ, কার্যকর ও টেকসই সমাধান, যা জনস্বাস্থ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়েও বড় অবদান রাখছে।
ওআরএস শুধু শিশুদের নয়, প্রাপ্তবয়স্ক ও বয়স্কদের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু জীবন বাঁচায় না, চিকিৎসার খরচও কমায়। একটি শিশুর ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে ওআরএসের খরচ যেখানে মাত্র ৬০ টাকা, সেখানে হাসপাতালে ভর্তি ও আইভি ফ্লুইড দিতে হলে খরচ হয় কয়েক হাজার টাকা। এতে শুধু অর্থ সাশ্রয় হয় না, পরিবারও রক্ষা পায় বড় আর্থিক বিপর্যয় থেকে।
শুধু অর্থ নয়, এর সামাজিক ও মানসিক প্রভাবও বিশাল। একটি শিশু মারা গেলে তার পরিবারের ওপর যে মানসিক ক্ষতি হয়, তা অপূরণীয়। ওআরএস সেই ক্ষতি থেকে পরিবারগুলোকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি কর্মদিবস বাঁচাচ্ছে, স্কুলে যাওয়া সম্ভব করছে, স্বাস্থ্য খাতে ‘আউট অব পকেট’ ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে এবং দারিদ্র্যের ঝুঁকি হ্রাস করছে।
এটি শুধু জীবন বাঁচাচ্ছে তা নয়, যে সংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে, শিশুদের জীবন বাঁচাচ্ছে, তার অর্থনৈতিক মূল্য বিশাল। অর্থনীতির ভাষায় বললে, ওআরএসের বিনিয়োগে রিটার্ন অত্যন্ত উচ্চ। ওআরএসের পেছনে ১ ডলার বিনিয়োগ করলে ১০ ডলারের সমপরিমাণ লাভ হয়। বছরে এটি বাংলাদেশে ১০ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করছে বলে ধারণা করা যায়।
আফসানা হাবিব শিউলী
প্রধান, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল
ডায়রিয়া ও পুষ্টি নিবিড়ভাবে জড়িত। যেসব শিশু ঘন ঘন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়, তারা অপুষ্টিতে বেশি ভোগে। ডায়রিয়া নানাভাবে পুষ্টিকে প্রভাবিত করে। এটি পুষ্টি উপাদানের শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ডায়রিয়ার কারণে অনেক পুষ্টি উপাদান শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। শিশুর ক্ষুধামান্দ্য হয় ও খাবারের প্রতি অনীহা জন্মে, যা ধীরে ধীরে অপুষ্টি বাড়িয়ে তোলে।
যদিও ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যুর হার এখন ১ শতাংশ, অপুষ্টি এখনো ডায়রিয়ার একটি বড় কারণ। অন্যদিকে গুরুতর অপুষ্টিও ডায়রিয়াসহ অন্যান্য চিকিৎসার জটিলতা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ ডায়রিয়া এবং অপুষ্টি একটি অন্যটিকে সমানভাবে প্রভাবিত করে।
একটি সুস্থ জাতি গঠনে পুষ্টিকর জাতি তৈরি করা অপরিহার্য। অপুষ্টি প্রতিরোধের জন্য ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরি। পানিশূন্যতার চিকিৎসায় ওরস্যালাইন শিশুর জীবন রক্ষার বড় ঢাল। ডায়রিয়া প্রতিরোধে ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে আমাদের দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ। শিশুকে নিরাপদে বড় করতে মায়ের বুকের দুধ, নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ও হাত ধোয়ার অভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি ডায়রিয়ার সময় ওরস্যালাইন ও জিংকের সঠিক ব্যবহার শিশুকে পানিশূন্যতা ও মৃত্যুঝুঁকি থেকে রক্ষা করে।
ওরস্যালাইন এটি কেবল একটি সাশ্রয়ী সমাধান নয়; বরং লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবন বাঁচানোর অন্যতম প্রধান উপায়—যার সুফল আমরা ইতিমধ্যে বহু বছর ধরে দেখে আসছি।
নুরুল ইসলাম খান
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
ওআরএস নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বর্তমানে সরাসরি কোনো একক সহায়তা দিচ্ছে না। তবে এটি আমাদের বিভিন্ন সাপোর্টের সঙ্গে একীভূত থাকে। উদাহরণস্বরূপ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য খাতের কর্মীদের জন্য আমরা প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি।
এ ছাড়া বন্যা বা অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতিতে আমাদের একটি জরুরি ওষুধ প্যাকেজ থাকে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য জাতিসংঘ সংস্থার সহায়তায় সরবরাহ করে। এই প্যাকেজেরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো ওআরএস।
আমাদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো সব সময় কাটা থাকে, ফলে পানির সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয় এবং এই পানিই আমরা ব্যবহার করি। সবার পক্ষে ফিল্টার বা পিউরিফিকেশন মেশিন ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করার জন্য আমাদের আবারও সচেতন হতে হবে।
ওআরএসের বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড়’-এর মতো বার্তাগুলো গণমাধ্যমে প্রচার করা হতো, যা আজও আমাদের মনে আছে। এ রকম আরও কিছু প্রচারাভিযান এখন অতি প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত যেসব বার্তা রয়েছে, যেগুলো প্রতিরোধে সহায়ক। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে ভূমিকা রাখে, সেগুলো প্রচারে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে।
ফিদা মেহরান
স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
ওআরএস আমাদের জন্য একটি গর্বের বিষয়। এর কারণ হলো ইউনিসেফ শুরু থেকেই ওআরএসের সঙ্গে সংযুক্ত। ওআরএসের উদ্ভাবন ও প্রসারে বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকার সঙ্গে ইউনিসেফের একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যেহেতু শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি, তাই আমাদের কাজের মধ্যে মায়ের স্বাস্থ্য, শিশুর স্বাস্থ্য, তাদের সুস্থ বেড়ে ওঠা এবং শিশুমৃত্যু হ্রাস—সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। ওআরএস শুধু শিশু বা মায়ের জন্য নয়, এটি আসলে সবার জন্যই একটি সমাধান। বাংলাদেশে যেসব জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম সফল হয়েছে, তার মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা এবং ওআরএস-কে প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। এমডিজি অর্জনেও এটি একটি বড় অবদান রেখেছে।
তবে ওআরএসের বিস্তৃত প্রভাব বিবেচনা করলে আরও কিছু বিষয় উঠে আসে। আমরা এখনো এমন একটি অবস্থায় আছি, যেখানে নিরাপদ পানি সবার জন্য নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা এখনো শতভাগ মানুষের কাছে ওআরএস পৌঁছে দিতে পারছি না। এটি সম্ভবত সচেতনতা ও সঠিক ব্যবহারের জ্ঞানের অভাবে হচ্ছে। এখানে বহু ক্ষেত্রভিত্তিক পদ্ধতির প্রয়োজন। আমাদের সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের একটি বড় ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বজনীনভাবে সচেতনতা তৈরি করতে ও বেসরকারি খাতকে জড়িত করতে হবে। এসএমসির মতো সামাজিক দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান খুব কমই আছে। আমরা আরও এমন প্রতিষ্ঠান চাই এবং তাদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
নূর–ই–নাজনীন ফেরদৌস
সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার, স্বাস্থ্য প্রকল্প, ব্র্যাক
বাংলাদেশ পাঁচ বছরের কম বয়সী লাখ লাখ শিশুর মৃত্যুরোধ ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা করতে পেরেছে। এ সাফল্যের জন্য আইসিডিআরবি, ব্র্যাক, ইউএনডিপি, ইউনিসেফ ও আরও অনেক সংস্থা কাজ করেছে। এটি তৈরি করা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করা, তাদের শেখানো ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া—এসবই অনেক বড় কাজ। এসব বড় কাজের ফলেই এটি এখন সফলতার মুখ দেখছে।
বারবার বলা হচ্ছে যে প্রায় ৩৪ শতাংশ ডায়রিয়ার চিকিৎসায় ওআরএস ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে অল্প কিছু জায়গায় আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি, যার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন ‘হার্ড-টু-রিচ’ এলাকা। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় প্রভাব আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে। ফলে চরম আবহাওয়ার ঘটনা যেমন খরা বাড়ছে। এসব পরিস্থিতিতে ত্রাণ হিসেবে ওআরএস পাঠানো হলেও অনেক সময় আমাদের মাঠপর্যায়ে কাজ করার সময় দেখা যায় যে সরবরাহ শেষ হয়ে যায়।
আমার অনুরোধ থাকবে, দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে সেই এলাকাগুলোতে যাতে লজিস্টিকের সরবরাহ ঠিক থাকে, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে আমরা ব্র্যাক যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো হার্ড-টু-রিচ এলাকায় কাজ করি, সেখানে গরমের সময়ে হঠাৎ ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ জায়গাগুলোতে কীভাবে পৌঁছানো যায়, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
সুপারিশ
শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে পাঠ্যপুস্তকে ওআরএস বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
দুর্গম এলাকা ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ওআরএস পৌঁছাতে উদ্যোগ নিতে হবে।
পানিশূন্যতায় যেসব স্বাস্থঝুঁকি রয়েছে, সেগুলোর প্রচার বৃদ্ধি করতে হবে।
সর্বজনীনভাবে সচেতনতা তৈরি করতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে হবে।
শিশুর পানিশূন্যতায় অবশ্যই ওআরএসের পাশাপাশি মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাসের বেশি হলে স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে।
ওআরএসের কার্যকারিতা আরও বাড়াতে গবেষণা বৃদ্ধি করা দরকার।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইস ড ড আরব র স ব স থ যশ ক ষ জনস ব স থ য ব যবহ র কর শ শ র জ বন স য ল ইন র প ন শ ন যত পর ব র পর এসএমস র ন র জন য র জ বন ব অন য ন য আম দ র স রক ষ ক র ব শ ষ কর ছয় ম স র দ র জন য ব সরক র সরক র র ইউন স ফ ক জ করত ব যবস থ পরবর ত সরবর হ ন র পদ র পর ব পর চ ল র অন য পর ম ণ উপ দ ন ক জ কর ক ত কর আরও ব ত করত র ওপর দরক র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
পানিশূন্যতা পূরণে ওরস্যালাইনের ভূমিকা
আলোচনা
তছলিম উদ্দীন খান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এসএমসি
বাংলাদেশেরই একটি প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি ওআরএস উদ্ভাবন করে, যা পরবর্তী সময় সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। পরে ব্র্যাক নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে এর জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আমরা সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি) ১৯৮৫ সালে প্যাকেটজাত ওআরএস নিয়ে যাত্রা শুরু করি। এই ৪০ বছরের প্রতিশ্রুতিশীল পথচলায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৫৫ থেকে বেড়ে ৭২ দশমিক ৩ বছর হয়েছে এবং শিশুমৃত্যুর হার ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
এখন এসএমসি ওরস্যালাইন শুধু ডায়রিয়া-কলেরা মোকাবিলায় নয়, কোটি কোটি মানুষের প্রতিদিনের পানিশূন্যতা পূরণেও ভূমিকা রাখছে। এসএমসির বিশ্বমানের উৎপাদনব্যবস্থায় আধুনিক ফর্মুলেশনে ওরস্যালাইন তৈরি হয় এবং স্বল্পমূল্যে বিপণনের ফলে দ্রুত মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। ওরস্যালাইন এখন বাড়ির পাশে ছোট্ট দোকানেও পাওয়া যায়, যার দাম মাত্র ছয় টাকা।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ওআরএস) হলো মূলত জীবন রক্ষাকারী তরল পানীয়, যা পরিষ্কার পানি, গ্লুকোজ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও সাইট্রেট দিয়ে তৈরি। গ্লুকোজ বিশেষভাবে পানি ও ইলেকট্রোলাইট শোষণে সাহায্য করে, যা শরীরে হারানো ফ্লুইড পূরণ করে।
ল্যানসেট ১৯৭৮ সালে বলেছিল যে ওআরএস বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা উদ্ভাবন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ উভয়েই একে কম খরচে জীবন রক্ষাকারী উপাদান হিসেবে সমর্থন করেছে।
এসএমসির ওরস্যালাইন এখন দেশের অন্যতম সেরা ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে। আমরা সব সময় নিত্যনতুন উদ্ভাবনের চেষ্টা করি। ২০০৪ সাল থেকে আমরা নিজস্ব বিশ্বমানের ফ্যাক্টরিতে ওআরএস-এন তৈরি শুরু করি, যা বাজারের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। আমরা জিংক ট্যাবলেট সহজলভ্য করার জন্যও কাজ করেছি। কারণ, ওআরএস ও জিংকের সম্মিলিত ব্যবহার ডায়রিয়ার পরবর্তী পর্ব ও তীব্রতা উভয়ই কমায়।
দেশের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ৭৫ শতাংশ শিশু ওরস্যালাইন খাচ্ছে। বাকি ২৫ শতাংশ জনগণের কাছে পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে দুর্গম এলাকা, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ও অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের ওরস্যালাইনের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী ও মিডিয়ার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
তাহমিদ আহমেদ
নির্বাহী পরিচালক, আইসিডিডিআরবি
সারা বিশ্বে ৪০ বছর আগে বছরে ৪৫ লাখ শিশু মারা যেত, এখন তা কমে ৬ লাখে নেমেছে। এর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে ওরস্যালাইন। শুধু ওরস্যালাইন নয়, বাংলাদেশে জিংকের ওপর গবেষণা হয়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে ১০ দিনের জন্য জিংক দেওয়া হলে সেই শিশুর ডায়রিয়ার তীব্রতা ও স্থায়িত্ব কমে যায় এবং পরবর্তী ছয় মাসে মৃত্যুঝুঁকিও হ্রাস পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউনিসেফ এখন ওরস্যালাইন ও জিংককে শিশুদের ডায়রিয়ার চিকিৎসায় অপরিহার্য হিসেবে সুপারিশ করে।
যদি লবণের সঙ্গে চিনি বা গ্লুকোজ মেশানো হয়, তাহলে পানি শরীর শোষণ করতে পারে, এটিই ছিল ওআরএস আবিষ্কারের মূলনীতি। আইসিডিডিআরবির এই উদ্ভাবন সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। গবেষণা শুধু করলেই হবে না, সেটিকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। এই প্রয়োগে ব্র্যাকের ভূমিকা বিরাট। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীরা এই কাজ শুরু করেন। ১৯৮৫ সাল থেকে এসএমসি প্যাকেটজাত ওরস্যালাইন বিতরণ শুরু করে। ১৯৮৭ সালের পর বাংলাদেশ সরকারও এ প্রোগ্রামটি তাদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান অনুযায়ী, ওআরএস প্রায় ছয়-সাত কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। আমার জানামতে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নেই যা এত সংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এটি সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্বের জন্য একটি উপহার।
বর্তমানে ওআরএসের কভারেজ রেটে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে ১ নম্বরে, এখানে প্রায় ৭৫ শতাংশ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে ওআরএস দেওয়া হয়। আফ্রিকার অনেক দেশে এটি এখনো ১৫ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি নয়। বাংলাদেশে এখনো ২৫ শতাংশ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু ওআরএসের সুবিধা পাচ্ছে না। এই ২৫ শতাংশ কারা, কোন আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর মানুষ, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত, যাতে নির্দিষ্ট এলাকা ধরে কাজ করা যায়। আমার মনে হয়, স্কুলপর্যায়ে একটি সচেতনতা অভিযান দরকার, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবার ও প্রতিবেশীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে। আমার মতে, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
বিশ্ব ওআরএস দিবস উপলক্ষে ওআরএসের আবিষ্কার ও উদ্যাপন নিয়ে এই সভার আয়োজনের জন্য প্রথম আলো ও এসএমসিকে ধন্যবাদ জানাই।
আবু জামিল ফয়সাল
জনস্বাস্থ্যবিদ
জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। কিছু কথা পুনরাবৃত্তি হতে পারে, তবে তা গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, মানুষের সচেতনতা বাড়ানো যেমন অবশ্যই দরকার, কিন্তু এখন একটা পর্যায়ে আসছে যে আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতার থেকে স্বাস্থ্যশিক্ষা বাড়াতে হবে। শুধু একটুখানি সচেতনতা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। স্বাস্থ্যশিক্ষা বলতে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য কীভাবে সুন্দর রাখা যায়, তা বোঝায়। স্বাস্থ্য সচেতনতা মানে শুধু ‘ওআরএস খাও’, কিন্তু স্বাস্থ্যশিক্ষা মানে কখন, কতটা ও কীভাবে সঠিকভাবে ওআরএস ব্যবহার করতে হবে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ওআরএস একটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। ওআরএস তৈরির জন্য বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা অপরিহার্য। আমি আমার গ্রামের একটি ঘটনা জানি, যেখানে পুকুরের অপরিষ্কার পানিতে ওআরএস মিশিয়ে খাওয়ানোর ফলে একটি শিশুর ডায়রিয়া আরও বেড়ে গিয়েছিল, অর্থাৎ পানি কী পরিমাণের ভালো ও বিশুদ্ধ হতে হবে, তা না হলে এর উপকার পাওয়া যাবে না, এটাও বলতে হবে।
প্যাকেজিংয়ে ওআরএস কখন খাওয়া যাবে না বা কীভাবে ভুল ব্যবহার করা যাবে না, সে বিষয়ে সতর্কীকরণ বার্তা দেওয়া প্রয়োজন। স্যাশেগুলো এত ছোট থাকে যে এসব কথা বলার হয়তো জায়গা থাকে না। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যশিক্ষা ও অ্যাডভোকেসি দরকার।
আমাদের উচিত এসব বিষয়ে গবেষণা করা। যাঁরা ম্যানুফ্যাকচারার, যাঁরা এনজিও হিসেবে মাঠে-ঘাটে কাজ করেন, তাঁদের এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে। সামগ্রিকভাবে এ বিষয়গুলো আমাদের আলোচনায় ও গবেষণায় আনতে হবে, যাতে ওআরএসের কার্যকারিতা আরও বাড়ানো যায় এবং আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর অপচয়, অপব্যবহার ও ভুল তথ্য রোধ করতে পারি।
সুকুমার সরকার
জনস্বাস্থ্যবিদ
১৯৯০ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম পরিবার পর্যায়ে ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনার ওপর একটি জরিপ হয়, তখন দেখা গিয়েছিল যে লবণ-গুড় সলিউশন শেখানো হলেও মানুষ পরিমাণমতো মেশাতে পারছিল না, ফলে জটিলতা দেখা যাচ্ছিল। এ প্রেক্ষাপটে প্যাকেটজাত ওআরএসের ধারণাটি আসে। এসএমসি এটির অন্যতম প্রধান প্রচারক ছিল। প্যাকেটজাত ওআরএসের আজকের এ সহজলভ্যতা এক দিনে আসেনি। সরকারের সীমিত প্রোগ্রামের বিপরীতে, বাজারের মাধ্যমে, বিশেষ করে এসএমসির প্রচেষ্টায় ডায়রিয়ার এ স্থানীয় সমস্যা সমাধান সম্ভব হয়েছে, যা আমাদের উচ্চস্বরে স্বীকার করা উচিত।
সাধারণ মানুষ, এমনকি চিকিৎসকদের মধ্যেও একটি ভুল ধারণা ছিল যে ডায়রিয়া হলে শিরায় স্যালাইন দেওয়া উচিত। কমিউনিটির বিশ্বাস ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার এ ধারণাকে পরিবর্তন করা ছিল একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আইসিডিডিআরবির তত্ত্বাবধানে চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক ও মাঠকর্মীদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত ‘ওআরটি ক্যাম্পেইন’-এর মাধ্যমে সারা দেশে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফলে আজ আমরা ওআরএসের উচ্চ ব্যবহার হার দেখতে পাচ্ছি।
হাসপাতালগুলোতে বাচ্চাদের ডিহাইড্রেশন ওআরএস খাইয়ে ঠিক করা শুরু হয়, যা পরিবার ও কমিউনিটির আস্থা বাড়ায়। গণমাধ্যম ও এসএমসির টেলিভিশন ক্যাম্পেইনগুলোও এ সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিকের পর ওআরএসকে দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রভাবশালী স্বাস্থ্য উদ্ভাবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমার জন্য এটি একটি অত্যন্ত আবেগের ও গর্বের বিষয়। কারণ, ওআরএস ছিল আমার পেশার প্রথম কাজ। আমি ভীষণ আনন্দিত যে আজ ওআরএস দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের শিক্ষক।
কাজী মহিউল ইসলাম
সাবেক মহাপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
আমি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শুরু করতে চাই। ১৯৯৪ সালে আমার সন্তান ডায়রিয়ায় মারাত্মক আক্রান্ত হয়। তখন মনে হয়েছিল, তাকে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত আমার সন্তানের জীবন বেঁচে উঠেছিল ওরস্যালাইনের কারণে। আইসিডিডিআরবি, ব্র্যাক, এসএমসি ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। এ ঘটনা কেবল আমার একার নয়, এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে, যারা এ রকম জীবনরক্ষাকারী সেবার উপকারভোগী।
আপনারা অনেক কাজ করছেন। আমরা সত্যিই গর্বিত। বাংলাদেশ সরকার থেকে শুরু করে এনজিও, আইএনজিও, বেসরকারি খাত, এসএমসি—সবাই অনেক অনেক কাজ করছে। তারপরও বিশ্বের শীর্ষ ২০টি উচ্চ পানিশূন্যতাজনিত বোঝাগ্রস্ত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম এখনো বিদ্যমান। সুতরাং পানিশূন্যতা পূরণে এত অর্জন সত্ত্বেও আমাদের আত্মতুষ্টিতে না ভুগে আরও বেশি মানুষকে এ সেবার আওতায় আনতে কাজ করতে হবে। আমাদের কাজ করতে হবে আকাশের নিচে ঘুমানো শিশুদের নিয়েও। ওরস্যালাইন খাওয়া নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে।
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা ২০২৪ সালের মে-জুন মাসে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা আইসিডিডিআরবি হাসপাতালেই ৩১ জন মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি কি জানেন, ওআরএস কীভাবে বানাতে হয়?’ ৩১ জনের মধ্যে ২৬ জনই বলেছেন, ‘আমরা তো জানতাম এটা বুকের দুধের সঙ্গে যায়।’ অর্থাৎ মায়েরা ওআরএস পান করলে তা শিশুর শরীরে যাবে। অথচ বাস্তবতা হলো শিশুর পানিশূন্যতা হলে শিশুকেই ওরস্যালাইন খাওয়াতে হবে। এ ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের কাজ করতে হবে।
হাসিন জাহান
কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ
ওআরএস যেভাবে প্রতিকারের মাধ্যমে মানুষকে, বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যুর হার কমাতে সহায়তা করে, সেটি অভাবনীয়। ঠিক একইভাবে আমরা যদি প্রতিরোধের ব্যবস্থায় যাই, তবে নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি দিয়ে আমরা এ পানিবাহিত ডায়রিয়া কমাতে এবং শিশুকে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারি।
শুধু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা দিয়ে আমরা এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। বারবার ডায়রিয়া হলে শিশুর শোষণ ক্ষমতা কমে যায়, বিশেষ করে পুষ্টির শোষণ। ফলে পরবর্তী সময়ে তার অন্যান্য দিকের বৃদ্ধিও কমে আসে। এ বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন।
দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় প্রতিরোধে ওরস্যালাইনের ভূমিকা কী, সেটি আলোচনা করা যেতে পারে। একটি ভালো দিক হলো সরকার এখন যেসব ত্রাণ দিয়ে থাকে, সেখানে ওআরএস একটি অন্তর্নিহিত উপাদান হিসেবে থাকে।
আমরা উপকূলীয় অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, দুর্যোগ প্রভাবিত এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই পানি লবণাক্ত থাকে। এ কারণে সেখানকার মানুষের উচ্চ রক্তচাপও বেশি—এটি পরীক্ষিত ও গবেষণায় এসেছে। ঘূর্ণিঝড় বা কোনো দুর্যোগ হয়, তখন একই স্যালাইনের প্যাকেট সেখানে যায় এবং রোগীরা যখন অপেক্ষাকৃত লবণাক্ত পানি দিয়ে সেই স্যালাইন পান করেন। এটি তাঁদের জন্য ক্ষতিকর কি না, এ বিষয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। সেখানে কি এই স্যালাইনের উপযুক্ত কোনো বিকল্প রয়েছে অথবা সেখানে রাইস স্যালাইন যেতে পারে অথবা এখানের কম্পোজিশন কি পরিবর্তন হতে পারে? এসএমসি ও আইসিডিডিআরবি নিশ্চয়ই জলবায়ুসহনশীল কোনো ওআরএস নিয়ে কাজ করতে পারে। এতে আমরা পানিশূন্যতা মোকাবিলায় যেটুকু পিছিয়ে আছি, সেটাও কাটিয়ে উঠতে পারব।
মো. আবদুল মান্নান
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, নবজাতক বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
একটি বাস্তবতা দিয়ে আমার কথা শুরু করতে চাই। আমার নানাকে দেখিনি। ডায়রিয়ার কারণে তিনি মারা গিয়েছিলেন। তিনি পানি খাওয়ার জন্য অনেক ব্যাকুল ছিলেন, তবু তাঁকে পানি দেওয়া হয়নি। তখনকার ধারণা ছিল যে ডায়রিয়া হলে যেহেতু শরীর থেকে পানি বের হয়ে যাচ্ছে, পানি দিলে আরও বেশি পানি বের হয়ে যাবে। এ রকম অসচেতনার জন্য কত জীবন ঝরে গেছে অকালে।
তবে আইসিডিডিআরবির মাধ্যমে দেশজুড়ে, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে পেশাদার সংগঠনগুলো যে সচেতনতা নিয়ে এসেছে, ফলে হাজারো মানুষ ও লাখো শিশুর জীবন ওরস্যালাইনের মাধ্যমে রক্ষা পেয়েছে। এটি আমাদের সৌভাগ্য যে আইসিডিডিআরবি এটি আমাদের দেশেই তৈরি করেছে। এটি এখন সারা পৃথিবীতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ডায়রিয়ার পাশাপাশি বমিতেও খাওয়ার স্যালাইনের নির্দেশিকা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে একবারে বেশি না দিয়ে অল্প অল্প করে দিতে হবে। এ ছাড়া উচ্চ জ্বরের কারণেও শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। এটি প্রতিরোধেও খাওয়ার স্যালাইনের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। গর্ভধারণ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, নবজাতকের ক্ষেত্রে ওরস্যালাইন খাওয়া যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে পরামর্শ মেনে পরিমিত খেতে হবে।
আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, প্রতি হাজার জীবিত জন্মে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু ৩১ থেকে ২৫-এ নামিয়ে আনা। এ লক্ষ্য অর্জনে টিকাদান, জিংক, ওআরএস, নারীশিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা—সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ওআরএস এমন একটি উদ্ভাবন, যা কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। আমি মনে করি, ওআরএস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দাবিদার।
তাহমিনা বেগম
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে শিশু বিভাগে রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করতাম। তখন অজস্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু ডায়রিয়া নিয়ে আসত, আর আমরা কিছুই করতে পারতাম না। কাঁদতে কাঁদতে আমি বাসায় যেতাম। সেই চিত্রটা এখন পাল্টে গেছে।
বর্তমানে ডায়রিয়া ও ওআরএস একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখন সবাই জানে, ডায়রিয়া হলে ওআরএস খেতে হবে। কারণ, কলেরা ও ডায়রিয়াজনিত অন্যান্য রোগে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। পানিশূন্যতায় শিশুর রক্তচাপ কমে যায়, শিশু অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, কিডনি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। ওআরএস পানিশূন্যতা পূরণ করে লাখ লাখ শিশুর জীবন বাঁচাচ্ছে।
ওআরএস কতটুকু দিতে হয়, তা শিশুর ওজন অথবা বয়সভেদে নির্ধারিত হয়। যেমন ছয় মাসের নিচে হলে ১০ চামচ, ছয় মাস থেকে এক বছর হলে ১৫ চামচ ও দুই বছর হলে ১৫ থেকে ২০ চামচ করে দিতে হয়। ডায়রিয়ার সঙ্গে যেহেতু বমিও প্রায়ই থাকে, তাই আমরা মায়েদের বলি ওআরএস ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে খাওয়াতে, যাতে তা শোষিত হতে পারে।
ডায়রিয়া হলে খাদ্যনালির ভেতরের লাইনিং নষ্ট হয়ে যায়, যা পুনর্গঠনের জন্য খাবারের প্রয়োজন হয়। তাই যদি শিশুর বয়স ছয় মাসের কম হয়, তাহলে অবশ্যই ওআরএসের পাশাপাশি মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাসের বেশি হলে স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে।
ওরস্যালাইন একটু একটু করে মিশিয়ে খাওয়ান অনেকে। এ কারণে লবণ ও পানির পরিমাণের অনুপাত নষ্ট হয়ে যায়। তাই এখন বাজারে যে প্যাকেট পাওয়া যায়, তা আধা লিটার পানিতে পুরোটা মিশিয়ে বয়স অনুযায়ী খাওয়াতে হবে।
সৈয়দ আব্দুল হামিদ
অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ওআরএসের তেমন কোনো ঝুঁকি নেই; বরং সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি অত্যন্ত নিরাপদ, কার্যকর ও টেকসই সমাধান, যা জনস্বাস্থ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়েও বড় অবদান রাখছে।
ওআরএস শুধু শিশুদের নয়, প্রাপ্তবয়স্ক ও বয়স্কদের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু জীবন বাঁচায় না, চিকিৎসার খরচও কমায়। একটি শিশুর ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে ওআরএসের খরচ যেখানে মাত্র ৬০ টাকা, সেখানে হাসপাতালে ভর্তি ও আইভি ফ্লুইড দিতে হলে খরচ হয় কয়েক হাজার টাকা। এতে শুধু অর্থ সাশ্রয় হয় না, পরিবারও রক্ষা পায় বড় আর্থিক বিপর্যয় থেকে।
শুধু অর্থ নয়, এর সামাজিক ও মানসিক প্রভাবও বিশাল। একটি শিশু মারা গেলে তার পরিবারের ওপর যে মানসিক ক্ষতি হয়, তা অপূরণীয়। ওআরএস সেই ক্ষতি থেকে পরিবারগুলোকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি কর্মদিবস বাঁচাচ্ছে, স্কুলে যাওয়া সম্ভব করছে, স্বাস্থ্য খাতে ‘আউট অব পকেট’ ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে এবং দারিদ্র্যের ঝুঁকি হ্রাস করছে।
এটি শুধু জীবন বাঁচাচ্ছে তা নয়, যে সংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে, শিশুদের জীবন বাঁচাচ্ছে, তার অর্থনৈতিক মূল্য বিশাল। অর্থনীতির ভাষায় বললে, ওআরএসের বিনিয়োগে রিটার্ন অত্যন্ত উচ্চ। ওআরএসের পেছনে ১ ডলার বিনিয়োগ করলে ১০ ডলারের সমপরিমাণ লাভ হয়। বছরে এটি বাংলাদেশে ১০ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করছে বলে ধারণা করা যায়।
আফসানা হাবিব শিউলী
প্রধান, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল
ডায়রিয়া ও পুষ্টি নিবিড়ভাবে জড়িত। যেসব শিশু ঘন ঘন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়, তারা অপুষ্টিতে বেশি ভোগে। ডায়রিয়া নানাভাবে পুষ্টিকে প্রভাবিত করে। এটি পুষ্টি উপাদানের শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ডায়রিয়ার কারণে অনেক পুষ্টি উপাদান শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। শিশুর ক্ষুধামান্দ্য হয় ও খাবারের প্রতি অনীহা জন্মে, যা ধীরে ধীরে অপুষ্টি বাড়িয়ে তোলে।
যদিও ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যুর হার এখন ১ শতাংশ, অপুষ্টি এখনো ডায়রিয়ার একটি বড় কারণ। অন্যদিকে গুরুতর অপুষ্টিও ডায়রিয়াসহ অন্যান্য চিকিৎসার জটিলতা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ ডায়রিয়া এবং অপুষ্টি একটি অন্যটিকে সমানভাবে প্রভাবিত করে।
একটি সুস্থ জাতি গঠনে পুষ্টিকর জাতি তৈরি করা অপরিহার্য। অপুষ্টি প্রতিরোধের জন্য ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরি। পানিশূন্যতার চিকিৎসায় ওরস্যালাইন শিশুর জীবন রক্ষার বড় ঢাল। ডায়রিয়া প্রতিরোধে ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে আমাদের দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ। শিশুকে নিরাপদে বড় করতে মায়ের বুকের দুধ, নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ও হাত ধোয়ার অভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি ডায়রিয়ার সময় ওরস্যালাইন ও জিংকের সঠিক ব্যবহার শিশুকে পানিশূন্যতা ও মৃত্যুঝুঁকি থেকে রক্ষা করে।
ওরস্যালাইন এটি কেবল একটি সাশ্রয়ী সমাধান নয়; বরং লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবন বাঁচানোর অন্যতম প্রধান উপায়—যার সুফল আমরা ইতিমধ্যে বহু বছর ধরে দেখে আসছি।
নুরুল ইসলাম খান
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
ওআরএস নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বর্তমানে সরাসরি কোনো একক সহায়তা দিচ্ছে না। তবে এটি আমাদের বিভিন্ন সাপোর্টের সঙ্গে একীভূত থাকে। উদাহরণস্বরূপ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য খাতের কর্মীদের জন্য আমরা প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি।
এ ছাড়া বন্যা বা অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতিতে আমাদের একটি জরুরি ওষুধ প্যাকেজ থাকে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য জাতিসংঘ সংস্থার সহায়তায় সরবরাহ করে। এই প্যাকেজেরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো ওআরএস।
আমাদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো সব সময় কাটা থাকে, ফলে পানির সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয় এবং এই পানিই আমরা ব্যবহার করি। সবার পক্ষে ফিল্টার বা পিউরিফিকেশন মেশিন ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করার জন্য আমাদের আবারও সচেতন হতে হবে।
ওআরএসের বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড়’-এর মতো বার্তাগুলো গণমাধ্যমে প্রচার করা হতো, যা আজও আমাদের মনে আছে। এ রকম আরও কিছু প্রচারাভিযান এখন অতি প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত যেসব বার্তা রয়েছে, যেগুলো প্রতিরোধে সহায়ক। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে ভূমিকা রাখে, সেগুলো প্রচারে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে।
ফিদা মেহরান
স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
ওআরএস আমাদের জন্য একটি গর্বের বিষয়। এর কারণ হলো ইউনিসেফ শুরু থেকেই ওআরএসের সঙ্গে সংযুক্ত। ওআরএসের উদ্ভাবন ও প্রসারে বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকার সঙ্গে ইউনিসেফের একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যেহেতু শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি, তাই আমাদের কাজের মধ্যে মায়ের স্বাস্থ্য, শিশুর স্বাস্থ্য, তাদের সুস্থ বেড়ে ওঠা এবং শিশুমৃত্যু হ্রাস—সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। ওআরএস শুধু শিশু বা মায়ের জন্য নয়, এটি আসলে সবার জন্যই একটি সমাধান। বাংলাদেশে যেসব জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম সফল হয়েছে, তার মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা এবং ওআরএস-কে প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। এমডিজি অর্জনেও এটি একটি বড় অবদান রেখেছে।
তবে ওআরএসের বিস্তৃত প্রভাব বিবেচনা করলে আরও কিছু বিষয় উঠে আসে। আমরা এখনো এমন একটি অবস্থায় আছি, যেখানে নিরাপদ পানি সবার জন্য নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা এখনো শতভাগ মানুষের কাছে ওআরএস পৌঁছে দিতে পারছি না। এটি সম্ভবত সচেতনতা ও সঠিক ব্যবহারের জ্ঞানের অভাবে হচ্ছে। এখানে বহু ক্ষেত্রভিত্তিক পদ্ধতির প্রয়োজন। আমাদের সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের একটি বড় ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বজনীনভাবে সচেতনতা তৈরি করতে ও বেসরকারি খাতকে জড়িত করতে হবে। এসএমসির মতো সামাজিক দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান খুব কমই আছে। আমরা আরও এমন প্রতিষ্ঠান চাই এবং তাদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
নূর–ই–নাজনীন ফেরদৌস
সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার, স্বাস্থ্য প্রকল্প, ব্র্যাক
বাংলাদেশ পাঁচ বছরের কম বয়সী লাখ লাখ শিশুর মৃত্যুরোধ ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা করতে পেরেছে। এ সাফল্যের জন্য আইসিডিআরবি, ব্র্যাক, ইউএনডিপি, ইউনিসেফ ও আরও অনেক সংস্থা কাজ করেছে। এটি তৈরি করা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করা, তাদের শেখানো ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া—এসবই অনেক বড় কাজ। এসব বড় কাজের ফলেই এটি এখন সফলতার মুখ দেখছে।
বারবার বলা হচ্ছে যে প্রায় ৩৪ শতাংশ ডায়রিয়ার চিকিৎসায় ওআরএস ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে অল্প কিছু জায়গায় আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি, যার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন ‘হার্ড-টু-রিচ’ এলাকা। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় প্রভাব আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে। ফলে চরম আবহাওয়ার ঘটনা যেমন খরা বাড়ছে। এসব পরিস্থিতিতে ত্রাণ হিসেবে ওআরএস পাঠানো হলেও অনেক সময় আমাদের মাঠপর্যায়ে কাজ করার সময় দেখা যায় যে সরবরাহ শেষ হয়ে যায়।
আমার অনুরোধ থাকবে, দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে সেই এলাকাগুলোতে যাতে লজিস্টিকের সরবরাহ ঠিক থাকে, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে আমরা ব্র্যাক যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো হার্ড-টু-রিচ এলাকায় কাজ করি, সেখানে গরমের সময়ে হঠাৎ ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ জায়গাগুলোতে কীভাবে পৌঁছানো যায়, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
সুপারিশ
শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে পাঠ্যপুস্তকে ওআরএস বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
দুর্গম এলাকা ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ওআরএস পৌঁছাতে উদ্যোগ নিতে হবে।
পানিশূন্যতায় যেসব স্বাস্থঝুঁকি রয়েছে, সেগুলোর প্রচার বৃদ্ধি করতে হবে।
সর্বজনীনভাবে সচেতনতা তৈরি করতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে হবে।
শিশুর পানিশূন্যতায় অবশ্যই ওআরএসের পাশাপাশি মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাসের বেশি হলে স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে।
ওআরএসের কার্যকারিতা আরও বাড়াতে গবেষণা বৃদ্ধি করা দরকার।