হাজেরা বিবির বেদিশা বোধ বাড়তেই থাকে, সাথে কাশির মাত্রা। খকখক কাশতে কাশতে পরানপাখি তার বেরিয়ে যাবার দশা। একে তো অ্যাজমার সাথে দীর্ঘ বছরের বন্ধুত্ব, তার ওপর শরীরের ভগ্নদশা তাকে কাহিল করে ছাড়ে। অনেক সময় কাশির গতি থেমে গেলে তার মুখে শুরু হয় গালির স্বরলিপি।
‘তোরা কই মরতে গেলি?’ বউদের তালাশে ডাক পাড়ে হাজেরা বিবি।
দুই পুত্রবধূর সেদিকে খেয়াল নেই। নেই মানে, তারা এখন দুপুরের খাবার খেয়ে সাবেক পুকুরের উত্তর পাড়ে বসেছে গপসপ মারতে। হুম, সাবেক পুকুর। অচিন ঘরের দুই মেয়ে বছরের ব্যবধানে বউ হয়ে আসার পর থেকে শুনে আসছে রান্নাঘরের উত্তর-পশ্চিম কোনার এই উঠানটি একদা পুকুর ছিল। তাতে ছেলেপুলের দল দিনদুপুরে সাঁতরিয়ে চোখ লাল করত, বড়দের গালি শুনত। গালিতে কাজ না হলে জইক্কার ভয় দেখাত, তাতে কিছুটা দমে যেত দুষ্টু ছেলেপুলের দল। আর ছিল পুকুরে মাছেদের কলকলানি। কত্ত রকমের মাছ! খননের প্রথম বছরে বিল থেকে ধরা কোরালের শখানেক পোনা পুকুরে ছেড়েছিল হাজেরা বিবির সোয়ামি ওরফে কাউয়ুমের বাপ ওরফে বাজারের বিশিষ্ট পান ব্যাপারী খোয়াজ আলী। আরও ছাড়া হয়েছিল তেলাপিয়া-রুই-কাতলের পোনা। বছরের মাঝামাঝি কাউয়ুমের বাপ ব্যবসার ব্যস্ততার অবসরে পুকুরে জাল ফেললে বুঝতে বাকি থাকে না, কোরালের রাক্ষুসে সাহসের কাছে তেমন টিকতে পারেনি অন্য নিরীহ মাছেরা। আহা রে, তেলাপিয়ার মাগুলোর লাইন ধরে মুখ দিয়ে পোনা ছাড়া দেখে হাজেরা বিবি মনে মনে বলেছিল, এবার তবে মনভরে মাছ খাওয়া যাবে। ভাগ দিতে হবে না কাউকে। একটা কাল আছিল তখন, বড় পুকুরের এক মাছকে কেটে ভাগ করে নিত চার গিরিজ। সে কথা ভাবতেই কাউয়ুমের মা কি বাপ দুজনেই ছেড়ে দিত চোখের পানি। আহা, আল্লাহ দিছে আজ, দুইটা ছেলে পরবাসে গিয়ে পরিবর্তন হইছে ভাগ্যের। ক্ষমতা দেখিয়ে বাকিদের খেয়েদেয়ে কোরালগুলো হয়েছিলও নাদুসনুদুস। একেকটার গায়ে ভাসে তামাটে চিকনাই। পাল্লায় তুললে কেজির গোলায় ধরে না তাদের। সেই পুকুর অতীতের ফসিল হয়ে এখন উঠান, ছোট ছেলের বরাদ্দে পড়ে আরেকটা পাকা ঘর তোলার দিন গুনছে। খালি জায়গায় গাছের ছায়ায় বেশ লাগে এই গরমাগরম ভরদুপুরে। দক্ষিণের তেকোনা বয়ার দুই পুত্রবধূর গতরে দিয়ে যায় শান্তির পরশ।
‘কই গেলি দুইটা, মরলি নাকি তোরা?’ কাশির সাথে রীতিমতো হুংকার ছাড়ে হাজেরা বিবি।
কান খাড়া করে মেজ বউ; ‘ভাবি, আম্মার ডাক না? আম্মাই তো ডাকে মনে লয়।’ বড় বউ মাত্র মাথাটা খুলে ধরেছিল জার সামনে। দু–চারটা উকুন ধরতে ধরতে চলত তাদের রাজ্যের খাজুরে আলাপ। বড় বউ খানিক বেজারই হয় অসময়ে শাশুড়ির ডাক শুনে। ‘আইচ্ছা, ঘরে চলো।’
হাজেরা বিবি ঘেমে একাকার। মুখে বিরক্তির চিহ্ন। কিছু বলছে না, সম্ভবত রাগে। মেজ বউ বাতাস দেওয়া শুরু করে হাতপাখা নিয়ে। আসলে শাশুড়ি-আম্মার কী দোষ ধরবে তারা বিছারি পায় না। বড় বউ একবার ঘরে সেট করা আইপিএস লাইনের দিকে তাকায়। মরার আইপিএস! বলে সে, ‘আম্মা, একটু শরবত করে দেব?’ চোখ বন্ধ করে হাঁপাচ্ছে হাজেরা বিবি। অনেকক্ষণ কাশছে হয়তো। টানের রোগীদের এই এক সমস্যা। কাশতে কাশতে বেহুঁশের মতো হয়ে যায়; পরে শরীরে আর বল পায় না। অবস্থা এমন, দরকারি কথা জিগালেও বলতে চায় না। বড় বউ আক্কেল করে একটা ইনহেলার টেনে নেয় মেডিসিন বাক্স থেকে। শাশুড়ির মুখের কাছে ধরে। শাশুড়ি ধীরে হাতে নেয় ইনহেলারটা, মুখে গুঁজে দেয় দুইটা টান।
‘কই গেলি দুইটা, মরলি নাকি তোরা?’ কাশির সাথে রীতিমতো হুংকার ছাড়ে হাজেরা বিবি। কান খাড়া করে মেজ বউ; ‘ভাবি, আম্মার ডাক না? আম্মাই তো ডাকে মনে লয়।’ বড় বউ খানিক বেজারই হয় অসময়ে শাশুড়ির ডাক শুনে। ‘আইচ্ছা, ঘরে চলো।’এবার একটু স্বাভাবিক হয়ে আসে হাজেরা বিবি। বোতলে জমানো ফোটানো পানিতে কুলি করে, গলা ভেজায়। আহা রে বেচারির কষ্ট, ফোটানো পানিতে চলছে আজ কবছর! গলা কি আর আছে? বলতে শুরু করে হাজেরা বিবি, ‘বুঝলি বউয়েরা, এই রকম অবস্থা গত ত্রিশ বছরে দেখিনি আমরা। কী আর বলব, এসব হইল গিয়ে খোদাতায়ালার পরীক্ষা। মানুষ তো আর মানুষ নাই। একেকটা মানুষের কাছে শয়তানও ফেল মারবে! হায়া-শরম উঠে গেছে, মনুষ্যত্ব উঠে গেছে, তাই এই তেজারত।’ সামনের রুম থেকে কাউয়ুমের বাপ ডাক দেয়, ‘ওয়া বউয়ল!’
বড় বউ শ্বশুরকে পানের বাটা এগিয়ে দেয়। ফরমাশের লিস্টটা ধীরে শুনিয়ে বাড়িয়ে দেয় বাজারের ব্যাগটা। সপ্তাহে দুদিন বসে জালিয়াখালী বাজার। রবি আর বুধ। অবশ্য প্রতিদিনই পাওয়া যায় সবকিছু। দরকার পড়লে বাড়ির রাস্তার মাথার দোকান থেকে আনিয়ে নেয় এটা-সেটা। তা ছাড়া বাড়ি বাড়ি এখন আসে নানান জাতের ফেরিওয়ালা। প্রায় সবকিছুই থাকে তাদের কাছে। অনেকেই অভ্যস্ত হলেও শ্বশুর-আব্বার এই এক অভ্যেস, দিনেমানে বাজারে যাবে ব্যাগ নিয়ে। তার এক কথা, যা কিনবা পয়লাই কিনবা। যত পরে যাবা তত পচা-গলা।
দুই বউও এই পরিস্থিতিতে বেশ বিরক্ত। এখন প্রায় প্রতিদিন সদাই করে আনে কাউয়ুমের বাপ, তাদের শ্বশুর। প্রতিদিন বাজার মানে প্রতিদিন রান্না। লাকড়ির চুলা না হোক, গ্যাসে হলেও পরিশ্রম কম না। অথচ পনেরো দিন আগেও এত কষ্ট করতে হতো না। এক হাটে বাজার করলে সপ্তাহ ধরে খাও। রাতে খাবার শেষে বাকিটা তুলে রাখো। এমনকি মাসের পুরোনো মাছ-মাংসও থাকে ফ্রিজে। গরবা আসলে কি জরুরতে মুশকিল আসান এই ফ্রিজ। ঘরে ঘরে হরেক রকমের ফ্রিজ মানুষের। কেউ কিনছে, কারও বাড়িতে গিফটের নামে যৌতুক হয়ে আসছে ছেলের বউয়ের সাথে। কাউয়ুমদের ঘরে দুই–দুইটা ফ্রিজ জিরাফের মতো দাঁড়িয়ে আছে মায়ের রুমে। এই তো, গত সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় বড় বউ রান্নার জন্য মাংসের পোঁটলা নিতে ফ্রিজ খুললেই বিশ্রী গন্ধের ধাক্কায় ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবার দশা। সেকি, বিদ্যুৎ-বিরহে ফ্রিজের সব জিনিস নষ্ট! যেই আজব যন্ত্র খাবার রাখত তরতাজা ফ্রেশ, বিদ্যুৎ বিনে সে হয়ে গেল অথর্ব? সাধের মনুষ্যদেহও কি রুহ বিনে এমন? আজ যে দামি, সময়ের আবর্তে সে মূল্যহীন; আজ যে দাপিয়ে বেড়ায়, কাল সে পথ পায় না পালানোর, হায় কপাল! ফ্রিজে জমানো মাছ-মাংস এখন পচা জিনিস, ফলত সেসবের স্থান হয় দূরের বিলে; কিছুটা রাক্ষুসে পাঙাশের প্রজেক্টে মাগনা খাবার হিসেবে দিয়েছে পড়শি কামালের মা। হাজেরা বিবির সে কী আফসোস, ‘বড় পুতের জন্য রাখছিলাম মইল্যা মাছগুলা, জাদুর রিজিকে পড়ল না। ফেলে দিতে হলো সব, আহা রে! বউ দুইটা আছে খালি খাওন আর ঘুমে। আগে খেয়াল রাখলে কি এত মাছ-মাংস পচত? টাকা কামানো কত কষ্টের তা বুঝলে তো, আমার ধনেরা বৈদেশে কেমন মেহনত করে আল্লাহ মালুম।’ হাজেরা বিবি দুই প্রবাসী পুত্রের কষ্টে এক চোট কেঁদে নেয় এই বেলা। তাতে দুই পুত্রবধূর বাড়ে বিরক্তি।
হাজেরা বিবির সে কী আফসোস, ‘বড় পুতের জন্য রাখছিলাম মইল্যা মাছগুলা, জাদুর রিজিকে পড়ল না। ফেলে দিতে হলো সব, আহা রে! বউ দুইটা আছে খালি খাওন আর ঘুমে। আগে খেয়াল রাখলে কি এত মাছ-মাংস পচত? টাকা কামানো কত কষ্টের তা বুঝলে তো!কী যেন নাম, ওহ, মোখা। আল্লাহর কী কেরামতি ঠিক বুঝতে পারে না দুই বউ। একেকবার ঘূর্ণিঝড় আসে একেকটা আজগুবি নামে। এসব ফাতরা নাম দেয় কে, অ্যাঁ? বাতাস বয় অসুরের বেগে, বৃষ্টি হয় বাজারের পুরান পাগলের মতো আর থেমে থেমে বজ্রপাত ভয় দেখায় দৈত্যের সুরত নিয়ে। এর ভেতর আবহাওয়া দপ্তর জানায়, এবারের বিশেষ মেহমান মোখা। লোকজন হাসে, নাম আর খুঁজে পাইল না! নাম যেমনই হোক, দশ নম্বর বিপৎসংকেতের সাথে বেড়ে চলে বাতাসের জোর। ভেঙে পড়ে গাছের ওপর গাছ। কোথাও–বা দেবে গেছে মাটির ঘর। উড়ে গেছে ঘরের চাল। রাস্তার ধারে, এমনকি বাড়ির উঠানের কোণে কি গোরস্তানের চিপায় দাঁড়িয়ে থাকা কারেন্টের খাম্বার গায়ে হেলান দিয়ে আরাম করতে থাকে গাছের কতিপয় ভাঙা ঢাল। কোথাও–বা সেই ভারে ছিঁড়ে গেছে দূরে চলে যাওয়া তারের দল। বিদ্যুৎ অফিস তো রাজ্যের লাসারা, তারা মওকা খোঁজে কেমনে লাগাবে লোডশেডিংয়ের ধাক্কা। গাছ ভাঙছে, তার গেছে ছিঁড়ে; সুতরাং বুঝুক এবার, কাকে বলে লোডশেডিং!
পক্ষকাল পার হয়ে মোখার কফিন কবরে খেয়ে ফেললেও উপজেলায় আসার নামগন্ধ নেই বিদ্যুৎবাবুর! এর ভেতরে উপজেলা বিদ্যুৎ অফিসে বার কয়েক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা হয়েছে, বিক্ষোভের বাণীতে ভরা ব্যানার টাঙিয়েছে, মাগার বিদ্যুৎ কবে নাগাদ আসবে, সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি অফিসের বড়কর্তা। তাদের এক কথা, সারা উপজেলায় যেই হারে গাছপালা, ঘরবাড়ি ভেঙে বিদ্যুতের লাইনে পড়েছে, তা পুরোপুরি ক্লিয়ার না করে বিদ্যুৎ দিলে বরং আরও বড় রকমের ক্ষতির আশঙ্কা আছে। সবুর ধরে কাজ করার সুযোগ না দিলে বিদ্যুৎ পেতে আরও দেরি হবে। কৌশল খাটিয়ে তারা বলে, ‘আপনাদের এই প্রতিবাদ সভা আমাদের রুটিন কাজে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।’ এরপর আর কথা বাড়ায় না উপজেলাবাসী প্রতিবাদকারী কেউই।
বিরস বদনে লোকেরা বাড়ি ফেরে খালি হাতে। বউ-ঝিরা বহু বছর আগে তুলে রাখা মরিচা-ধরা চেরাগ-হারিকেন নামায় মাচা থেকে। চার্জার লাইটের আলো কয়েক দিনের বিদ্যুৎ-বিরহে নিবু নিবু হয়ে নিজেদের অক্ষমতা জানান দিলে ঘরওয়ালিরা খেয়াল করে, ঘরে নেই কেরোসিনের পুরোনো বোতল! চারদিকে বিদ্যুতের ফকফকা আলো, তার ওপর চার্জার লাইট নামের আজব এক জিনিস বাজারে এসেছে, এক দিন চার্জ দিলে তিন দিন জ্বলে; বউ-ঝিরা কোন দুঃখে তবে পুরোনো বোতলের জঞ্জাল বাড়াবে ঘরের কোনায়? কাউয়ুমের বাপ পাড়ার দোকান থেকে কেরোসিনের ডিব্বা এনে বড় বউয়ের হাতে দিয়ে তাড়া লাগায়, ‘মাগরিবের ওয়াক্তে ঘরে চেরাগ জ্বালাতে হয়। ধরো, কেরোসিনে দ্রুত চেরাগ জ্বালাও বউয়েরা।’
পক্ষকাল পার হয়ে মোখার কফিন কবরে খেয়ে ফেললেও উপজেলায় আসার নামগন্ধ নেই বিদ্যুৎবাবুর! এর ভেতরে উপজেলা বিদ্যুৎ অফিসে বার কয়েক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা হয়েছে, মাগার বিদ্যুৎ কবে নাগাদ আসবে, সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি অফিসের বড়কর্তা।সেই চেরাগ-জ্বলা আদিম সন্ধ্যায় শহর থেকে ফেরে হাজেরা বিবির বড় ছেলে আব্দুল কাউয়ুম। ছোট থেকে পড়ালেখার মাথা ছিল তার বেশ, সেই সূত্রে স্টাডি শেষে ঢুকে পড়ে সরকারি চাকরিতে। লোকে বলে, এমনকি কাউয়ুমের বাপ স্বীকার করে, ‘পান বেচে কোনো রকমে চারটা ডাল-ভাত খেয়ে জীবন চালাইছি, কিন্তু সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি এনেছে বড় ছেলে কাউয়ুমই। তার ইনকামে বিদেশ পাঠাল ছোট দুই ভাই, জমি কিনে বড়সড় ভিটে হয়েছে, নিজেদের পাকা ঘরবাড়ি হয়েছে।’ কাউয়ুম জানায়, তার অফিসে বিশেষ ব্যস্ততা যাচ্ছে, তবু বাড়ি আসতে হলো কারও ফোনে সংযোগ না পেয়ে। দুরবস্থার কথা টিভিতে, মোবাইলে দেখা গেছে কিছু, তাই বলে এত খারাপ হবে কে জানত! বড় ছেলেরে কাছে পেয়ে বিলাপ শুরু করে দেয় হাজেরা বিবি। ‘অ পুত, এটা তো কারবালার ময়দান, নাই কারেন্ট, নাই পানি। তোর জন্য রাখছিলাম বড় দিঘির মইল্যা মাছ। শেষ, ফ্রিজের সব শেষ!’ গরমে, মশায়, চেরাগ-জ্বলা মৃদু আলোয় কারবালার একটা যোগ পেয়ে মায়ের সাথে সহমত পোষণ করতে ভোলে না কাউয়ুম। ছেলের এই সহমত মাকে আরও বেশি প্রলুব্ধ করে কান্নায়। মায়ের কান্না বাড়ে এই অবেলায়, সেই সাথে যুক্ত হয় হাজেরা বিবির পুরোনো কাশি।
রাতের উঠানে চেয়ার পেতে বসে কাউয়ুম। বহু বছর পর সে পরখ করে চারপাশ। গাছেদের সবুজ আশ্চর্য নীরবতায় ঘুমিয়ে আছে সারি সারি। কোথাও নেই সামান্য কোলাহল। আকাশে জেগে আছে চাঁদমামা আর অজস্র তারা। এমন সুন্দর আকাশ কাউয়ুম কেন, এলাকার কেউই দেখছে বলে মনে পড়ে না তার। আসলে গ্রামের কেউই রাতে সবুজ দেখার, আকাশ দেখার অবকাশ ইতিপূর্বে পায়নি এখনকার মতো করে। সন্ধ্যা হলেই বউ-ঝিরা বসে টিভি সিরিয়াল নিয়ে, পড়ুয়ারা পড়ার টেবিলে, বড়রা মোবাইলের স্ক্রিন কি চা-দোকানে। ফলে একা একা দিনযাপন করছিল গ্রামের সরল-সবল প্রকৃতি, আজ টের পায় কাউয়ুম। বয়ারের একেকটা হলকা মাঝেমধ্যে গায়ে লাগে তার। মরার দুষ্টু বাতাসই মনে করিয়ে দেয় পুকুরে মন ভরে সাঁতরানোর স্মৃতি। ইশ্, আজ যদি পুকুরে নামা যেত! হায়, গ্রামে কি এখন আর পুকুর রাখে লোকজন? আগের সেই ফসলে ভরা বিস্তৃত বিল মরে ভূত হয়ে আছে নতুন নতুন বাড়ি-ভিটের উপস্থিতিতে।
‘কাউয়ুম, কবে আসলা বাজান?’
পানির বোতল হাতে বাড়ি ঢোকে কাউয়ুমের বাপ। শহর চষে বেড়ানো ধুরন্ধর চালাক কাউয়ুম বুঝতে পারে, কারেন্ট নেই, মোটরে ওঠে না পানি। চাপকল গ্রাম থেকে উঠে গেছে সেই কবে! ভালো তো, এবার কিন্যা খাও পানি.
‘জে আব্বা, তোমাদের মোবাইলে পাই না আজ কত দিন, তাই সোজা চলে এলাম।’
‘বড় বউ, এদিকে আয় তো,’ রুম থেকে ডাক পাড়ে হাজেরা বিবি।
সকালের নাশতা খেয়ে শ্বশুর-আব্বা বেরিয়ে গেছে তখন। পালা মুরগিরাও খুত-কুড়া খেয়ে চলে গেছে তাদের চারণক্ষেত্রে। কাউয়ুমের ঘুম ভাঙেনি এখনো। বেচারা জার্নি করে এসেছে শহর থেকে। করে বড় চাকরি, কত ঝক্কি সামলাতে হয় তার! মেজ বউ দুপুরের রান্নার বন্দোবস্ত শুরু করে দিয়েছে রান্নাঘরে। বড় ছেলের আগমনে রান্নাঘর আজ অন্য দিনের চেয়ে অধিক চঞ্চল, বোঝা যায়। এ সময় সাধারণত আম্মা বউদের তালাশ করে না। এর কারণও আছে। হাজেরা বিবি রাতে তেমন ঘুমাতে পারে না টান আর কাশির যৌথ আক্রমণে। সকালে হালকা নাশতা সেরে ওষুধ আর ইনহেলার নিয়ে এক লাচা ঘুম তার হয়। এতে তার শরীরটা মোটের ওপর ভালো থাকে।
আগাগোড়া বড় বউকে একবার মেপে নেয় হাজেরা বিবি। শাশুড়ির এমন নিরীক্ষণের মুখে আর পড়তে হয়নি কাউয়ুমের বউকে। এই সপ্তাহে বা আজকাল বিরাট কোনো ভুল করছে কি না ইয়াদ করতে পারে না বড় বউ। তবে কেন ডাকলেন আম্মা!
‘ডাকছেন, আম্মা?’
‘অ্যাঁ, এই ঘরে বরকত আসবে কোত্থেকে? সাফসুরত থাকা লাগে ঘরের লোকদের, পাক-পবিত্র থাকা লাগে বউ-ঝিদের। কোন কাল আসল আল্লাহ মালুম। মেরে ফেলা হইছে সব পুকুর, পুকুরে গোসল কি শুধু, পুকুরের পানি খেয়েই জীবন পার করছি আমরা। পরে আসল চাপাকল, তাও গলা টিপে শেষ। ঘরে ঘরে মোটরের ঠেলায় চাপাকলে পানি আসবে কোন তালে? কদিন ধরে মইল্যাপিরার কারেন্ট হইছে হাওয়া, আসার নাম নাই! লাইনে তো নাই পানি, তাইলে পাক-পবিত্র হইবে কেমনে? বুঝি না আমরা, চুল কি হাওয়ায় পাকছে, অ্যাঁ!’ রাগে গরগর করতে থাকে হাজেরা বিবি। হঠাৎই শাশুড়ির এমন আক্রমণে যেন–বা বোবা হয়ে যায় বড় বউ। কী বলে আম্মা? একজন শাশুড়ি এমনভাবে কথা কেমনে বলে?
বড় বউ রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে শোনে শাশুড়ির উচ্চস্বর, ‘কিচ্ছু নাই, হায়া-শরম নাই, ইমান-আমল নাই। ফরজ গোসল না করে নিমাতারা সেজে থাকলে ঘরে ফেরেশতা ঢুকবে কেমনে, অ্যাঁ?’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ন ন ঘর বড় ছ ল আল ল হ ম জ বউ র জন য বউয় র র ওপর উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
হাজেরা বিবির বদনসিব
হাজেরা বিবির বেদিশা বোধ বাড়তেই থাকে, সাথে কাশির মাত্রা। খকখক কাশতে কাশতে পরানপাখি তার বেরিয়ে যাবার দশা। একে তো অ্যাজমার সাথে দীর্ঘ বছরের বন্ধুত্ব, তার ওপর শরীরের ভগ্নদশা তাকে কাহিল করে ছাড়ে। অনেক সময় কাশির গতি থেমে গেলে তার মুখে শুরু হয় গালির স্বরলিপি।
‘তোরা কই মরতে গেলি?’ বউদের তালাশে ডাক পাড়ে হাজেরা বিবি।
দুই পুত্রবধূর সেদিকে খেয়াল নেই। নেই মানে, তারা এখন দুপুরের খাবার খেয়ে সাবেক পুকুরের উত্তর পাড়ে বসেছে গপসপ মারতে। হুম, সাবেক পুকুর। অচিন ঘরের দুই মেয়ে বছরের ব্যবধানে বউ হয়ে আসার পর থেকে শুনে আসছে রান্নাঘরের উত্তর-পশ্চিম কোনার এই উঠানটি একদা পুকুর ছিল। তাতে ছেলেপুলের দল দিনদুপুরে সাঁতরিয়ে চোখ লাল করত, বড়দের গালি শুনত। গালিতে কাজ না হলে জইক্কার ভয় দেখাত, তাতে কিছুটা দমে যেত দুষ্টু ছেলেপুলের দল। আর ছিল পুকুরে মাছেদের কলকলানি। কত্ত রকমের মাছ! খননের প্রথম বছরে বিল থেকে ধরা কোরালের শখানেক পোনা পুকুরে ছেড়েছিল হাজেরা বিবির সোয়ামি ওরফে কাউয়ুমের বাপ ওরফে বাজারের বিশিষ্ট পান ব্যাপারী খোয়াজ আলী। আরও ছাড়া হয়েছিল তেলাপিয়া-রুই-কাতলের পোনা। বছরের মাঝামাঝি কাউয়ুমের বাপ ব্যবসার ব্যস্ততার অবসরে পুকুরে জাল ফেললে বুঝতে বাকি থাকে না, কোরালের রাক্ষুসে সাহসের কাছে তেমন টিকতে পারেনি অন্য নিরীহ মাছেরা। আহা রে, তেলাপিয়ার মাগুলোর লাইন ধরে মুখ দিয়ে পোনা ছাড়া দেখে হাজেরা বিবি মনে মনে বলেছিল, এবার তবে মনভরে মাছ খাওয়া যাবে। ভাগ দিতে হবে না কাউকে। একটা কাল আছিল তখন, বড় পুকুরের এক মাছকে কেটে ভাগ করে নিত চার গিরিজ। সে কথা ভাবতেই কাউয়ুমের মা কি বাপ দুজনেই ছেড়ে দিত চোখের পানি। আহা, আল্লাহ দিছে আজ, দুইটা ছেলে পরবাসে গিয়ে পরিবর্তন হইছে ভাগ্যের। ক্ষমতা দেখিয়ে বাকিদের খেয়েদেয়ে কোরালগুলো হয়েছিলও নাদুসনুদুস। একেকটার গায়ে ভাসে তামাটে চিকনাই। পাল্লায় তুললে কেজির গোলায় ধরে না তাদের। সেই পুকুর অতীতের ফসিল হয়ে এখন উঠান, ছোট ছেলের বরাদ্দে পড়ে আরেকটা পাকা ঘর তোলার দিন গুনছে। খালি জায়গায় গাছের ছায়ায় বেশ লাগে এই গরমাগরম ভরদুপুরে। দক্ষিণের তেকোনা বয়ার দুই পুত্রবধূর গতরে দিয়ে যায় শান্তির পরশ।
‘কই গেলি দুইটা, মরলি নাকি তোরা?’ কাশির সাথে রীতিমতো হুংকার ছাড়ে হাজেরা বিবি।
কান খাড়া করে মেজ বউ; ‘ভাবি, আম্মার ডাক না? আম্মাই তো ডাকে মনে লয়।’ বড় বউ মাত্র মাথাটা খুলে ধরেছিল জার সামনে। দু–চারটা উকুন ধরতে ধরতে চলত তাদের রাজ্যের খাজুরে আলাপ। বড় বউ খানিক বেজারই হয় অসময়ে শাশুড়ির ডাক শুনে। ‘আইচ্ছা, ঘরে চলো।’
হাজেরা বিবি ঘেমে একাকার। মুখে বিরক্তির চিহ্ন। কিছু বলছে না, সম্ভবত রাগে। মেজ বউ বাতাস দেওয়া শুরু করে হাতপাখা নিয়ে। আসলে শাশুড়ি-আম্মার কী দোষ ধরবে তারা বিছারি পায় না। বড় বউ একবার ঘরে সেট করা আইপিএস লাইনের দিকে তাকায়। মরার আইপিএস! বলে সে, ‘আম্মা, একটু শরবত করে দেব?’ চোখ বন্ধ করে হাঁপাচ্ছে হাজেরা বিবি। অনেকক্ষণ কাশছে হয়তো। টানের রোগীদের এই এক সমস্যা। কাশতে কাশতে বেহুঁশের মতো হয়ে যায়; পরে শরীরে আর বল পায় না। অবস্থা এমন, দরকারি কথা জিগালেও বলতে চায় না। বড় বউ আক্কেল করে একটা ইনহেলার টেনে নেয় মেডিসিন বাক্স থেকে। শাশুড়ির মুখের কাছে ধরে। শাশুড়ি ধীরে হাতে নেয় ইনহেলারটা, মুখে গুঁজে দেয় দুইটা টান।
‘কই গেলি দুইটা, মরলি নাকি তোরা?’ কাশির সাথে রীতিমতো হুংকার ছাড়ে হাজেরা বিবি। কান খাড়া করে মেজ বউ; ‘ভাবি, আম্মার ডাক না? আম্মাই তো ডাকে মনে লয়।’ বড় বউ খানিক বেজারই হয় অসময়ে শাশুড়ির ডাক শুনে। ‘আইচ্ছা, ঘরে চলো।’এবার একটু স্বাভাবিক হয়ে আসে হাজেরা বিবি। বোতলে জমানো ফোটানো পানিতে কুলি করে, গলা ভেজায়। আহা রে বেচারির কষ্ট, ফোটানো পানিতে চলছে আজ কবছর! গলা কি আর আছে? বলতে শুরু করে হাজেরা বিবি, ‘বুঝলি বউয়েরা, এই রকম অবস্থা গত ত্রিশ বছরে দেখিনি আমরা। কী আর বলব, এসব হইল গিয়ে খোদাতায়ালার পরীক্ষা। মানুষ তো আর মানুষ নাই। একেকটা মানুষের কাছে শয়তানও ফেল মারবে! হায়া-শরম উঠে গেছে, মনুষ্যত্ব উঠে গেছে, তাই এই তেজারত।’ সামনের রুম থেকে কাউয়ুমের বাপ ডাক দেয়, ‘ওয়া বউয়ল!’
বড় বউ শ্বশুরকে পানের বাটা এগিয়ে দেয়। ফরমাশের লিস্টটা ধীরে শুনিয়ে বাড়িয়ে দেয় বাজারের ব্যাগটা। সপ্তাহে দুদিন বসে জালিয়াখালী বাজার। রবি আর বুধ। অবশ্য প্রতিদিনই পাওয়া যায় সবকিছু। দরকার পড়লে বাড়ির রাস্তার মাথার দোকান থেকে আনিয়ে নেয় এটা-সেটা। তা ছাড়া বাড়ি বাড়ি এখন আসে নানান জাতের ফেরিওয়ালা। প্রায় সবকিছুই থাকে তাদের কাছে। অনেকেই অভ্যস্ত হলেও শ্বশুর-আব্বার এই এক অভ্যেস, দিনেমানে বাজারে যাবে ব্যাগ নিয়ে। তার এক কথা, যা কিনবা পয়লাই কিনবা। যত পরে যাবা তত পচা-গলা।
দুই বউও এই পরিস্থিতিতে বেশ বিরক্ত। এখন প্রায় প্রতিদিন সদাই করে আনে কাউয়ুমের বাপ, তাদের শ্বশুর। প্রতিদিন বাজার মানে প্রতিদিন রান্না। লাকড়ির চুলা না হোক, গ্যাসে হলেও পরিশ্রম কম না। অথচ পনেরো দিন আগেও এত কষ্ট করতে হতো না। এক হাটে বাজার করলে সপ্তাহ ধরে খাও। রাতে খাবার শেষে বাকিটা তুলে রাখো। এমনকি মাসের পুরোনো মাছ-মাংসও থাকে ফ্রিজে। গরবা আসলে কি জরুরতে মুশকিল আসান এই ফ্রিজ। ঘরে ঘরে হরেক রকমের ফ্রিজ মানুষের। কেউ কিনছে, কারও বাড়িতে গিফটের নামে যৌতুক হয়ে আসছে ছেলের বউয়ের সাথে। কাউয়ুমদের ঘরে দুই–দুইটা ফ্রিজ জিরাফের মতো দাঁড়িয়ে আছে মায়ের রুমে। এই তো, গত সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় বড় বউ রান্নার জন্য মাংসের পোঁটলা নিতে ফ্রিজ খুললেই বিশ্রী গন্ধের ধাক্কায় ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবার দশা। সেকি, বিদ্যুৎ-বিরহে ফ্রিজের সব জিনিস নষ্ট! যেই আজব যন্ত্র খাবার রাখত তরতাজা ফ্রেশ, বিদ্যুৎ বিনে সে হয়ে গেল অথর্ব? সাধের মনুষ্যদেহও কি রুহ বিনে এমন? আজ যে দামি, সময়ের আবর্তে সে মূল্যহীন; আজ যে দাপিয়ে বেড়ায়, কাল সে পথ পায় না পালানোর, হায় কপাল! ফ্রিজে জমানো মাছ-মাংস এখন পচা জিনিস, ফলত সেসবের স্থান হয় দূরের বিলে; কিছুটা রাক্ষুসে পাঙাশের প্রজেক্টে মাগনা খাবার হিসেবে দিয়েছে পড়শি কামালের মা। হাজেরা বিবির সে কী আফসোস, ‘বড় পুতের জন্য রাখছিলাম মইল্যা মাছগুলা, জাদুর রিজিকে পড়ল না। ফেলে দিতে হলো সব, আহা রে! বউ দুইটা আছে খালি খাওন আর ঘুমে। আগে খেয়াল রাখলে কি এত মাছ-মাংস পচত? টাকা কামানো কত কষ্টের তা বুঝলে তো, আমার ধনেরা বৈদেশে কেমন মেহনত করে আল্লাহ মালুম।’ হাজেরা বিবি দুই প্রবাসী পুত্রের কষ্টে এক চোট কেঁদে নেয় এই বেলা। তাতে দুই পুত্রবধূর বাড়ে বিরক্তি।
হাজেরা বিবির সে কী আফসোস, ‘বড় পুতের জন্য রাখছিলাম মইল্যা মাছগুলা, জাদুর রিজিকে পড়ল না। ফেলে দিতে হলো সব, আহা রে! বউ দুইটা আছে খালি খাওন আর ঘুমে। আগে খেয়াল রাখলে কি এত মাছ-মাংস পচত? টাকা কামানো কত কষ্টের তা বুঝলে তো!কী যেন নাম, ওহ, মোখা। আল্লাহর কী কেরামতি ঠিক বুঝতে পারে না দুই বউ। একেকবার ঘূর্ণিঝড় আসে একেকটা আজগুবি নামে। এসব ফাতরা নাম দেয় কে, অ্যাঁ? বাতাস বয় অসুরের বেগে, বৃষ্টি হয় বাজারের পুরান পাগলের মতো আর থেমে থেমে বজ্রপাত ভয় দেখায় দৈত্যের সুরত নিয়ে। এর ভেতর আবহাওয়া দপ্তর জানায়, এবারের বিশেষ মেহমান মোখা। লোকজন হাসে, নাম আর খুঁজে পাইল না! নাম যেমনই হোক, দশ নম্বর বিপৎসংকেতের সাথে বেড়ে চলে বাতাসের জোর। ভেঙে পড়ে গাছের ওপর গাছ। কোথাও–বা দেবে গেছে মাটির ঘর। উড়ে গেছে ঘরের চাল। রাস্তার ধারে, এমনকি বাড়ির উঠানের কোণে কি গোরস্তানের চিপায় দাঁড়িয়ে থাকা কারেন্টের খাম্বার গায়ে হেলান দিয়ে আরাম করতে থাকে গাছের কতিপয় ভাঙা ঢাল। কোথাও–বা সেই ভারে ছিঁড়ে গেছে দূরে চলে যাওয়া তারের দল। বিদ্যুৎ অফিস তো রাজ্যের লাসারা, তারা মওকা খোঁজে কেমনে লাগাবে লোডশেডিংয়ের ধাক্কা। গাছ ভাঙছে, তার গেছে ছিঁড়ে; সুতরাং বুঝুক এবার, কাকে বলে লোডশেডিং!
পক্ষকাল পার হয়ে মোখার কফিন কবরে খেয়ে ফেললেও উপজেলায় আসার নামগন্ধ নেই বিদ্যুৎবাবুর! এর ভেতরে উপজেলা বিদ্যুৎ অফিসে বার কয়েক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা হয়েছে, বিক্ষোভের বাণীতে ভরা ব্যানার টাঙিয়েছে, মাগার বিদ্যুৎ কবে নাগাদ আসবে, সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি অফিসের বড়কর্তা। তাদের এক কথা, সারা উপজেলায় যেই হারে গাছপালা, ঘরবাড়ি ভেঙে বিদ্যুতের লাইনে পড়েছে, তা পুরোপুরি ক্লিয়ার না করে বিদ্যুৎ দিলে বরং আরও বড় রকমের ক্ষতির আশঙ্কা আছে। সবুর ধরে কাজ করার সুযোগ না দিলে বিদ্যুৎ পেতে আরও দেরি হবে। কৌশল খাটিয়ে তারা বলে, ‘আপনাদের এই প্রতিবাদ সভা আমাদের রুটিন কাজে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।’ এরপর আর কথা বাড়ায় না উপজেলাবাসী প্রতিবাদকারী কেউই।
বিরস বদনে লোকেরা বাড়ি ফেরে খালি হাতে। বউ-ঝিরা বহু বছর আগে তুলে রাখা মরিচা-ধরা চেরাগ-হারিকেন নামায় মাচা থেকে। চার্জার লাইটের আলো কয়েক দিনের বিদ্যুৎ-বিরহে নিবু নিবু হয়ে নিজেদের অক্ষমতা জানান দিলে ঘরওয়ালিরা খেয়াল করে, ঘরে নেই কেরোসিনের পুরোনো বোতল! চারদিকে বিদ্যুতের ফকফকা আলো, তার ওপর চার্জার লাইট নামের আজব এক জিনিস বাজারে এসেছে, এক দিন চার্জ দিলে তিন দিন জ্বলে; বউ-ঝিরা কোন দুঃখে তবে পুরোনো বোতলের জঞ্জাল বাড়াবে ঘরের কোনায়? কাউয়ুমের বাপ পাড়ার দোকান থেকে কেরোসিনের ডিব্বা এনে বড় বউয়ের হাতে দিয়ে তাড়া লাগায়, ‘মাগরিবের ওয়াক্তে ঘরে চেরাগ জ্বালাতে হয়। ধরো, কেরোসিনে দ্রুত চেরাগ জ্বালাও বউয়েরা।’
পক্ষকাল পার হয়ে মোখার কফিন কবরে খেয়ে ফেললেও উপজেলায় আসার নামগন্ধ নেই বিদ্যুৎবাবুর! এর ভেতরে উপজেলা বিদ্যুৎ অফিসে বার কয়েক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা হয়েছে, মাগার বিদ্যুৎ কবে নাগাদ আসবে, সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি অফিসের বড়কর্তা।সেই চেরাগ-জ্বলা আদিম সন্ধ্যায় শহর থেকে ফেরে হাজেরা বিবির বড় ছেলে আব্দুল কাউয়ুম। ছোট থেকে পড়ালেখার মাথা ছিল তার বেশ, সেই সূত্রে স্টাডি শেষে ঢুকে পড়ে সরকারি চাকরিতে। লোকে বলে, এমনকি কাউয়ুমের বাপ স্বীকার করে, ‘পান বেচে কোনো রকমে চারটা ডাল-ভাত খেয়ে জীবন চালাইছি, কিন্তু সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি এনেছে বড় ছেলে কাউয়ুমই। তার ইনকামে বিদেশ পাঠাল ছোট দুই ভাই, জমি কিনে বড়সড় ভিটে হয়েছে, নিজেদের পাকা ঘরবাড়ি হয়েছে।’ কাউয়ুম জানায়, তার অফিসে বিশেষ ব্যস্ততা যাচ্ছে, তবু বাড়ি আসতে হলো কারও ফোনে সংযোগ না পেয়ে। দুরবস্থার কথা টিভিতে, মোবাইলে দেখা গেছে কিছু, তাই বলে এত খারাপ হবে কে জানত! বড় ছেলেরে কাছে পেয়ে বিলাপ শুরু করে দেয় হাজেরা বিবি। ‘অ পুত, এটা তো কারবালার ময়দান, নাই কারেন্ট, নাই পানি। তোর জন্য রাখছিলাম বড় দিঘির মইল্যা মাছ। শেষ, ফ্রিজের সব শেষ!’ গরমে, মশায়, চেরাগ-জ্বলা মৃদু আলোয় কারবালার একটা যোগ পেয়ে মায়ের সাথে সহমত পোষণ করতে ভোলে না কাউয়ুম। ছেলের এই সহমত মাকে আরও বেশি প্রলুব্ধ করে কান্নায়। মায়ের কান্না বাড়ে এই অবেলায়, সেই সাথে যুক্ত হয় হাজেরা বিবির পুরোনো কাশি।
রাতের উঠানে চেয়ার পেতে বসে কাউয়ুম। বহু বছর পর সে পরখ করে চারপাশ। গাছেদের সবুজ আশ্চর্য নীরবতায় ঘুমিয়ে আছে সারি সারি। কোথাও নেই সামান্য কোলাহল। আকাশে জেগে আছে চাঁদমামা আর অজস্র তারা। এমন সুন্দর আকাশ কাউয়ুম কেন, এলাকার কেউই দেখছে বলে মনে পড়ে না তার। আসলে গ্রামের কেউই রাতে সবুজ দেখার, আকাশ দেখার অবকাশ ইতিপূর্বে পায়নি এখনকার মতো করে। সন্ধ্যা হলেই বউ-ঝিরা বসে টিভি সিরিয়াল নিয়ে, পড়ুয়ারা পড়ার টেবিলে, বড়রা মোবাইলের স্ক্রিন কি চা-দোকানে। ফলে একা একা দিনযাপন করছিল গ্রামের সরল-সবল প্রকৃতি, আজ টের পায় কাউয়ুম। বয়ারের একেকটা হলকা মাঝেমধ্যে গায়ে লাগে তার। মরার দুষ্টু বাতাসই মনে করিয়ে দেয় পুকুরে মন ভরে সাঁতরানোর স্মৃতি। ইশ্, আজ যদি পুকুরে নামা যেত! হায়, গ্রামে কি এখন আর পুকুর রাখে লোকজন? আগের সেই ফসলে ভরা বিস্তৃত বিল মরে ভূত হয়ে আছে নতুন নতুন বাড়ি-ভিটের উপস্থিতিতে।
‘কাউয়ুম, কবে আসলা বাজান?’
পানির বোতল হাতে বাড়ি ঢোকে কাউয়ুমের বাপ। শহর চষে বেড়ানো ধুরন্ধর চালাক কাউয়ুম বুঝতে পারে, কারেন্ট নেই, মোটরে ওঠে না পানি। চাপকল গ্রাম থেকে উঠে গেছে সেই কবে! ভালো তো, এবার কিন্যা খাও পানি...
‘জে আব্বা, তোমাদের মোবাইলে পাই না আজ কত দিন, তাই সোজা চলে এলাম।’
‘বড় বউ, এদিকে আয় তো,’ রুম থেকে ডাক পাড়ে হাজেরা বিবি।
সকালের নাশতা খেয়ে শ্বশুর-আব্বা বেরিয়ে গেছে তখন। পালা মুরগিরাও খুত-কুড়া খেয়ে চলে গেছে তাদের চারণক্ষেত্রে। কাউয়ুমের ঘুম ভাঙেনি এখনো। বেচারা জার্নি করে এসেছে শহর থেকে। করে বড় চাকরি, কত ঝক্কি সামলাতে হয় তার! মেজ বউ দুপুরের রান্নার বন্দোবস্ত শুরু করে দিয়েছে রান্নাঘরে। বড় ছেলের আগমনে রান্নাঘর আজ অন্য দিনের চেয়ে অধিক চঞ্চল, বোঝা যায়। এ সময় সাধারণত আম্মা বউদের তালাশ করে না। এর কারণও আছে। হাজেরা বিবি রাতে তেমন ঘুমাতে পারে না টান আর কাশির যৌথ আক্রমণে। সকালে হালকা নাশতা সেরে ওষুধ আর ইনহেলার নিয়ে এক লাচা ঘুম তার হয়। এতে তার শরীরটা মোটের ওপর ভালো থাকে।
আগাগোড়া বড় বউকে একবার মেপে নেয় হাজেরা বিবি। শাশুড়ির এমন নিরীক্ষণের মুখে আর পড়তে হয়নি কাউয়ুমের বউকে। এই সপ্তাহে বা আজকাল বিরাট কোনো ভুল করছে কি না ইয়াদ করতে পারে না বড় বউ। তবে কেন ডাকলেন আম্মা!
‘ডাকছেন, আম্মা?’
‘অ্যাঁ, এই ঘরে বরকত আসবে কোত্থেকে? সাফসুরত থাকা লাগে ঘরের লোকদের, পাক-পবিত্র থাকা লাগে বউ-ঝিদের। কোন কাল আসল আল্লাহ মালুম। মেরে ফেলা হইছে সব পুকুর, পুকুরে গোসল কি শুধু, পুকুরের পানি খেয়েই জীবন পার করছি আমরা। পরে আসল চাপাকল, তাও গলা টিপে শেষ। ঘরে ঘরে মোটরের ঠেলায় চাপাকলে পানি আসবে কোন তালে? কদিন ধরে মইল্যাপিরার কারেন্ট হইছে হাওয়া, আসার নাম নাই! লাইনে তো নাই পানি, তাইলে পাক-পবিত্র হইবে কেমনে? বুঝি না আমরা, চুল কি হাওয়ায় পাকছে, অ্যাঁ!’ রাগে গরগর করতে থাকে হাজেরা বিবি। হঠাৎই শাশুড়ির এমন আক্রমণে যেন–বা বোবা হয়ে যায় বড় বউ। কী বলে আম্মা? একজন শাশুড়ি এমনভাবে কথা কেমনে বলে?
বড় বউ রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে শোনে শাশুড়ির উচ্চস্বর, ‘কিচ্ছু নাই, হায়া-শরম নাই, ইমান-আমল নাই। ফরজ গোসল না করে নিমাতারা সেজে থাকলে ঘরে ফেরেশতা ঢুকবে কেমনে, অ্যাঁ?’