ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প
Published: 3rd, November 2025 GMT
নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন আগামীকাল মঙ্গলবার। ‘বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে প্রথমবার এমন একজন মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি এক ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলছেন।
জোহরান মামদানি শ্বেতকায় নন, তিনি বাদামি রঙের দক্ষিণ এশীয়। তিনি খ্রিষ্টান নন, একজন মুসলিম। তিনি অবশ্যই রক্ষণশীল নন, তিনি খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতে দ্বিধা করেন না।
‘মামদানি একজন ভয়ানক মানুষ’, সাবধান করে বলেছেন অ্যান্ড্রু কুমো, মঙ্গলবারের নির্বাচনে যিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী। সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে তিনি এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।
ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও এই নির্বাচনে তিনি একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এই নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবেই দেখবেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। তাঁর বিবেচনায় মামদানি শুধু একজন পাক্কা কমিউনিস্টই নন, রীতিমতো উন্মাদ। এমন একজনকে নির্বাচিত করা হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মামদানি একজন অবৈধ অভিবাসী। তা প্রমাণিত হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি যদি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলতি অভিযানে বাধা দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।
শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি।ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়
শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও অন্তত তিনটি রাজ্যে নির্বাচন হবে আগামীকাল, যার ফলাফল ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ব্যাপারে একটি রেফারেন্ডাম বা জনরায় হবে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদেও ভোট গ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যই ডেমোক্রেটিক রাজনীতির সমর্থক, বা ‘ব্লু স্টেট’। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই রাজ্যেই ট্রাম্পের হার হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় তিনি অনেক ভালো ফল করেন। দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে এই দুই রাজ্যে ট্রাম্পের জনসমর্থন এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে।
এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার ফলে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে আরও পাঁচটি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হবে ভাবা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘ব্লু স্টেট’ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ন্যুসামের নির্দেশে নির্বাচনী ম্যাপ বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ভোটারদের মনে থাকবেন ট্রাম্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি বাধা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে সেনাসদস্যদের পাঠাচ্ছেন তিনি। যেসব ডেমোক্রেটিক নেতাকে শত্রু মনে করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। কোনো যুক্তি বা কারণ ছাড়াই ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ভোট দেয়নি এমন ডেমোক্রেটিক রাজ্যের কেন্দ্রীয় অনুদান বাতিল করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একাধিক সরকারি দপ্তর আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক পাচার বন্ধের নামে ভেনেজুয়েলার সমুদ্রসীমায় সামরিক হামলা চালাচ্ছেন। আমদানি শুল্কের নামে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, তার ফলে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।
গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।এসব কার্যকলাপের ফলে সারা দেশে ট্রাম্পের জনসমর্থন কমেছে। অধিকাংশ জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থন ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১০ মাসের মাথায় অন্য আর কোনো প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনে এমন ধস নামেনি।
এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প কোনো রাজ্যেই ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রচারে আসেননি। এমনকি রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে সরব সমর্থনও জানাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, জয়ী হবেন এমন প্রার্থীর সমর্থন দিতেই ট্রাম্প ভালোবাসেন। আগামীকালের নির্বাচনে তেমন সম্ভাবনা কম।
এই নির্বাচন যে ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়, তার আরেক প্রমাণ নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অংশগ্রহণ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জাতীয় নেতা বলতে তিনিই সবেধন নীলমণি। শনিবার নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী মাইকি শেরিলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। একই দিন ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী এবিগেইল স্প্যানবার্গারের পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। উভয় রাজ্যেই ওবামা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণেই আমেরিকা আজ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি।
জনমতে এগিয়ে মামদানি
ওবামা মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেননি। তবে তিনি যে মামদানির পাশে আছেন, সে কথাও গোপন রাখেননি। মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ওবামা নিজেই ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর (মামদানির) বিজয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, মামদানির নির্বাচনী প্রচার ‘ইম্প্রেসিভ’ বা নজরে পড়ার মতো।
কুমো ক্যাম্প থেকে অহোরাত্রি তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে প্রচার সত্ত্বেও মামদানি যেসব জনমত জরিপে এগিয়ে, তার একটি বড় কারণ মাঠপর্যায়ে তাঁর এই ‘ইম্প্রেসিভ’ প্রচারণা। শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি। এতে তিনি ফল পাচ্ছেন, গত দুই সপ্তাহে মামদানির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ১০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। নিউইয়র্কের চলতি মেয়র নির্বাচন থেকে এরিক অ্যাডামস সরে দাঁড়ানোয় কুমোর লাভ হয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখনো মামদানির সঙ্গে যে ১৬-১৭ পয়েন্টের ব্যবধান রয়েছে, তা অতিক্রম করা কার্যত অসম্ভব, এই মত অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের।
ভূমিধস পরিবর্তন
একটা বিষয় স্পষ্ট। মেয়র নির্বাচনে মামদানি জয়ী হলে তা মার্কিন রাজনীতিতে প্রজন্মগত ও নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। ভূমিধস পরিবর্তন আসবে ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে। মধ্যপন্থী ও ডানঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এই দল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই দলে যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ, করপোরেট আমেরিকার কাছে এদের হাত-পা বাঁধা। ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের সমর্থন এখনো আগের মতো নতজানু।
পিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল প্রশ্নে এখন নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যা তিন বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একইভাবে ধনতন্ত্রের প্রতিও আমেরিকানদের সমর্থন নিম্নগামী। গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।
অন্যদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি খোলামেলাভাবে অভিবাসনবিরোধী, দক্ষিণপন্থী, খ্রিষ্টবাদী ও রক্ষণশীল। চলতি সপ্তাহের নতুন উদ্বাস্তু নীতিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতকায় ও ইউরোপীয় আশ্রয়প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় নাগরিকবৃন্দ, ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে যারা সে দেশের সরকারের বৈষম্যের শিকার।
এই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির বিপরীতে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য ওকাসিও-কর্তেজ ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। সবাই মানেন, মামদানির মতো তরুণ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।
এই সম্ভাবনার কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর কথায়, এই দেশ করপোরেট আমেরিকার নির্দেশে চলবে, না তার রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ‘যদি আমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাই, করপোরেট আমেরিকার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের মামদানির পাশে দাঁড়াতে হবে।’
কোন পথ বেছে নেবে নিউইয়র্ক, মঙ্গলবারেই তা নিশ্চিত হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র প বল ক ন প র ট ন উইয়র ক আম র ক র ম মদ ন র পর য য় র জন ত কর ছ ন সরক র র সমর
এছাড়াও পড়ুন:
‘মামদানি মডেল’ কি নিউইয়র্কের বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে
জোহরান মামদানি বেড়ে উঠেছেন বলা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে। ২০১৬ সালে বার্নি স্যান্ডার্সের প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার প্রচার দেখে তিনি সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন। ওই বছরটি শেষ পর্যন্ত আমাদের ট্রাম্পের ‘প্রথম সংস্করণ’কে উপহার দিয়েছিল।
গত বছর নভেম্বর মাসে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পরপরই মামদানি ভোটারদের কাছে যান এই প্রশ্ন নিয়ে—কেন তাঁরা এই লোকটিকে ভোট দিলেন? তাঁদের সঙ্গে সেই কথোপকথনগুলোই তাঁকে নিউইয়র্কের মেয়র হিসেবে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিল। সেই আলাপচারিতার ভিডিওটিও সময়ের রাজনীতিকে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক দলিল।
আমরা যারা বিল ক্লিনটন আর টনি ব্লেয়ারের রাজনৈতিক কৌশলের বিষয়ে জানি, তারা হয়তো এমন ‘জনতার কথা শোনা’ ধাঁচের অনুষ্ঠানের বিষয়ে সন্দিহান থাকি। কারণ, এ ধরনের অনুষ্ঠানে ক্ষমতার প্রতিনিধি এবং তাঁর সহযোগীরা আলোঝলমলে হলঘরে ‘জনতার পাশে’ থাকার অভিনয় করেন। কিন্তু মামদানির প্রচার একেবারেই তেমন নয়।
আরও পড়ুনমামদানি দেখালেন কীভাবে নির্বাচিত হতে হয়০৬ নভেম্বর ২০২৫মামদানি ব্রঙ্কসের এক রাস্তার মোড়ে হাতে একটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন; যেন তিনি এক দৃঢ়বিশ্বাসী ধর্মপ্রচারক। তিনি প্রচলিত রাজনৈতিক বুলি আওড়াননি। তিনি সরাসরি কথা বলেছেন সেই সব মানুষের সঙ্গে যাদের চেহারায় ক্লান্তি, শরীরে নাগরিক শ্রান্তি। তাঁরা আগে কখনো কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতাধর লোকের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেননি, এমনকি মামদানির মতো ছোট পরিসরের কোনো আইনপ্রণেতার সঙ্গেও নয়।
এই মানুষেরা মামদানিকে মন খুলে বলেছেন, কেমন করে জীবনের প্রতিদিনের চাহিদাগুলো পূরণ করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে; কীভাবে রাজনীতি তঁাদের জীবনকে সংকীর্ণ করে ফেলছে। এই মানুষেরা রাজনীতিকদের ব্যর্থ লোক হিসেবেই দেখেন। জনগণের এই হতাশাই একসময় ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে তুলেছিল। এই হতাশার কারণেই মামদানি আজ আমেরিকার বৃহত্তম শহর নিউইয়র্কের মেয়র।
বিশ্লেষকেরা প্রায়ই ট্রাম্প আর মামদানিকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের বক্তব্য ‘দুজনেই টিকটকে জনপ্রিয়’ বা ‘দুজনেই পপুলিস্ট’—ধরনের কথায় গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু এই তুলনার গভীরে আরও বড় বিষয় আছে। দুজনেই নিউইয়র্কের মানুষ। কিন্তু তাঁরা এই শহরের দুই বিপরীত দিককে তুলে ধরেন। ট্রাম্প তুলে ধরেন ম্যানহাটানের দালানকোঠার ছবি। আর মামদানি হন সাধারণ মানুষের পাড়া-মহল্লার প্রতিনিধি। তাঁদের দুজনকে দেখলে মনে হয়, আমেরিকার দুই ভিন্ন ভবিষ্যৎ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
বিজয় ভাষণে তিনি কৃতজ্ঞতা জানানোর পর বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ট্রাম্পের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষতবিক্ষত একটি জাতিকে দেখাতে পারে কীভাবে তাকে পরাজিত করতে হয়, তবে সেই শহরই পারে, যে শহর ট্রাম্পকে তৈরি করেছিল।’ট্রাম্প টেনে নিচ্ছেন দেশকে জাতিগত বিভাজন আর নির্মম অর্থনীতির পথে। আর মামদানি অভিবাসী ও সাধারণ নাগরিকদের পাশে এমন এক শহরের স্বপ্ন নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, যেখানে সবার জন্যই বেঁচে থাকা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মামদানি বুঝতে পেরেছেন, শহরের শ্রমজীবী মানুষ মানে শুধু শ্বেতাঙ্গ নয়; তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামি ও অভিবাসীরাও আছেন।
ট্রাম্পের মতো লোকেরা যে ভয়াবহ বিপদের প্রতীক, তা গভীরভাবে ভাবলেই বোঝা যায়। আর সেটি বোঝা গেলেই বোঝা যায়, কেন মানুষ মামদানির মধ্যে এতটা আশা খুঁজে পেয়েছে। কয়েকটা উদাহরণ দিই—গত সেপ্টেম্বর ট্রাম্পের দেহরক্ষীরা হুন্দাই কারখানা থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকজন প্রকৌশলীকে ধরে নিয়ে যান। সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকার পরও জোর করে তাঁদের দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার পরের মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ ভিসা নিয়ে ভ্রমণরত এক ব্রিটিশ সাংবাদিককে আইসিই কর্মকর্তারা ধরে নিয়ে যান। কারণ, তিনি ইসরায়েলের নৃশংসতার সমালোচনা করেছিলেন।
মামদানির জনপ্রিয়তার উৎস শুধু তাঁর তারুণ্য, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব নয়। তাঁর প্রতি এই প্রবল আগ্রহের মূল কারণ হলো, তিনিই প্রথম বামপন্থী রাজনীতিক, যিনি দেখিয়েছেন ট্রাম্পবাদের মুখোমুখি দাঁড়ানোই শুধু নয়, সেটিকে পরাজিত করাও সম্ভব। এটাই আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ—আর নিউইয়র্কের নতুন মেয়র তা ভালোভাবেই জানেন।
আরও পড়ুনমামদানির জয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি যেভাবে বদলে দিতে পারে০৫ নভেম্বর ২০২৫বিজয় ভাষণে তিনি কৃতজ্ঞতা জানানোর পর বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ট্রাম্পের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষতবিক্ষত একটি জাতিকে দেখাতে পারে কীভাবে তাকে পরাজিত করতে হয়, তবে সেই শহরই পারে, যে শহর ট্রাম্পকে তৈরি করেছিল।’
এক বছর ধরে ট্রাম্পের দ্বিতীয় আমলে মধ্যপন্থী ও মধ্য-বাম রাজনীতিকদের সেরা মেধাবীরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কীভাবে ট্রাম্পকে মোকাবিলা করবেন, তা তাঁরা বুঝে উঠতে পারেননি। ওবামা প্রায় কিছুই বলেননি। কমলা হ্যারিস আত্মজীবনী লেখায় ব্যস্ত ছিলেন।
মামদানিকে সবচেয়ে তীব্র আক্রমণ করেছেন তাঁর নিজের দিকের মানুষেরাই। ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে হেরে গিয়ে যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িত অ্যান্ড্রু কুমো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান এবং এই নির্বাচনে প্রকাশ্যে ট্রাম্পের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালান। এই প্রচারে নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র হতে চাওয়া মামদানিকে নিয়মিতভাবে ‘সন্ত্রাসবাদে সহানুভূতিশীল’ বলে অপবাদ দেওয়া হয়েছে।
ইউরোপজুড়ে এখন দেখা যাচ্ছে সামাজিক গণতন্ত্রের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘চরমপন্থার প্রধান’ ট্রাম্পের সামনে মাথা নত করছেন। ব্রিটেনের কিয়ার স্টারমার ট্রাম্পকে অভূতপূর্ব কায়দায় স্বাগত জানিয়েছেন। আর ন্যাটোর প্রধান মার্ক রুতে তাঁকে ‘ড্যাডি’ পর্যন্ত বলেছেন। পাঁচ বছর আগেও মার্কিন গণমাধ্যমের মালিকেরা বৈচিত্র্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। এখন তারা হাঁটু গেড়ে বসছে এক বর্ণবাদী গালিবাজের সামনে।
ট্রাম্পবাদের বিরুদ্ধে যখন দুই দিনব্যাপী বিশাল বিক্ষোভে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ অংশ নেয়, তখন মার্কিন কলামিস্ট আর পডকাস্টাররা পরিবেশ বদলের গল্প শুনিয়েছেন। এ অবস্থায় মামদানির জয় প্রমাণ করে জনগণ এখনো প্রতিরোধে আস্থা রাখে।
আদিত্য চক্রবর্তী দ্য গার্ডিয়ান-এর কলামিস্ট
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত