দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথমবারের মতো তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এর পর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে প্রাণঘাতী এ রোগের বিস্তার। হাসপাতালে ভিড় বাড়ে রোগীর। করোনার প্রধান উপসর্গগুলোর একটি শ্বাসকষ্ট। তাই অক্সিজেনের চাহিদা দেখা দেয় প্রচুর। সংক্রমণ বাড়ার এক পর্যায়ে অক্সিজেনের ঘাটতি তীব্র হয়। সিলিন্ডার কিনতে বিভিন্ন স্থানে ছুটতে থাকেন রোগীর স্বজন। অন্যদিকে, ভারত থেকে অক্সিজেন আসা বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিপাকে পড়ে সরকার। বাধ্য হয়ে সরকারিভাবে ৯৯টি কেন্দ্রীয় অক্সিজেন প্লান্ট বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে খরচ পড়ে ২৪১ কোটি টাকা। করোনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে অধিকাংশ প্লান্ট পড়ে আছে। ব্যবহার না করায় অনেক যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে। কিছু জায়গায় স্থাপনের পর প্লান্ট চালুই হয়নি। এদিকে, অক্সিজেন সংকটে এখনও দেশে ১০০ জনে ২০ জন মারা যাচ্ছে।

খাত-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা চলে গেলেও অন্যান্য রোগের প্রকোপ আছে। তাই অক্সিজেনের চাহিদা কমেনি। করোনা মহামারির মধ্যে ২০২১ সালের মাঝামাঝি দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা ছিল ৪০০ টন। এখন এটি কমে ১৪০ থেকে ১৫০ টনে নেমেছে। বিভিন্ন কোম্পানি থেকে অক্সিজেন কিনে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। তবে সমন্বয়হীনতার কারণে সরকারি টাকায় বসানো অক্সিজেন প্লান্টগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ বলছে, অব্যবহৃত অক্সিজেন প্লান্ট সচলে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

কেন্দ্রীয় ঔষধাগার সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। করোনা মহামারি তখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বাধ্য হয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অক্সিজেন উৎপাদনের উদ্যোগ নেয় সরকার। পর্যায়ক্রমে ৯৯টি হাসপাতালে অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনে কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে বসানো হয়েছে ৪০টি। এতে ৯২ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মাধ্যমে কভিড-১৯ সংক্রান্ত সহায়তা তহবিল থেকে ৫১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৯টি এবং জাতিসংঘের অর্থায়নে ৯৭ কোটি ৫ লাখ টাকা দিয়ে ৩০টি অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করা হয়। পরিকল্পনা ছিল, একটি অক্সিজেন প্লান্ট প্রতি মিনিটে ৫০০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন উৎপাদন করা। পরে এই অক্সিজেন দিয়ে কমপক্ষে ৫০ রোগীকে মিনিটে ১০ লিটার নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ করা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনও আটটি প্লান্টের কাজ শেষ হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অক্সিজেন প্লান্টটি করোনার মধ্যে কিছুদিন ব্যবহার হলেও প্রায় দুই বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, আগের মতো অক্সিজেনের চাহিদা না থাকায় এটি ব্যবহার করা হচ্ছে না।
হাসপাতালটির উপপরিচালক ডা.

আশরাফুল আলম বলেন, ঢাকা মেডিকেলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রোগীর চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। তাই এই প্লান্ট এখন ব্যবহার হচ্ছে না। তবে শ্বাসকষ্টের রোগী বাড়লে ফের ব্যবহার করা যাবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে স্থাপিত অক্সিজেন প্লান্টটি এক দিনও ব্যবহার হয়নি। গত সোমবার বিএসএমএমইউতে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সি’ ব্লকের পাশে একটি কক্ষে অক্সিজেন প্লান্টের সব যন্ত্রপাতি আছে। কক্ষটি তালাবদ্ধ। প্লান্ট দেখভাল করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেশিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগ। এই বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘হাসপাতালে অক্সিজেনের চাহিদা অনেক। তবে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এখনও প্লান্টটি আমাদের কাছে হস্তান্তর করেনি। তাই এটি অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে।’

একই অবস্থা ঢাকার বাইরেও
চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অক্সিজেন প্লান্ট বসানো হয় ২০২২ সালে। এখনও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে এটি। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল গ্রিন অক্সিজেন লিমিটেডের। বর্তমানে কোম্পানিটি বন্ধ থাকায় অক্সিজেন প্লান্ট নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের প্লান্টও ব্যবহার হচ্ছে না। 
এদিকে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্টের কপার লাইন চুরি হয়ে গেছে। প্লান্টটি হাসপাতালের চারতলায় বসানো হয়। ওই তলা ব্যবহার না হওয়ায় 

তিন থেকে চারবার চুরির ঘটনা ঘটে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, স্থাপনের সময় আমি এখানে ছিলাম না। নতুন দায়িত্ব পেয়েছি, তাই আমার কাছে এ বিষয়ে তথ্য নেই।

খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অক্সিজেন প্লান্ট দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হতে বসেছে। শ্বাসকষ্টের রোগী না আসায় প্লান্ট ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় প্লান্টের অক্সিজেন সংযোগ লাইনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালে শ্বাসকষ্টের রোগী কম। 
একই অবস্থা রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অক্সিজেন প্লান্টের। স্থাপনের পর এটি একবারও চালু হয়নি। ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্লান্টটি ব্যবহার করা হচ্ছে না। এই হাসপাতালে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কাজল বিশ্বাস বলেন, অক্সিজেন প্লান্ট ব্যবহারে ওপর থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্লান্টে প্রায় ছয় মাস লিকেজ। ফলে অকেজো বা কাজে আসছে না এটি। সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে (সদর হাসপাতাল) প্লান্ট চালু রয়েছে। তবে প্লান্ট নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান। তিনি অক্সিজেনের ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। 
এহসানূর রহমান বলেন, এখনও অক্সিজেন সংকটে ১০০ জনে ২০ জনের মৃত্যু হয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কেন এসব প্লান্ট ব্যবহার করতে পাচ্ছি না। উত্তর– সমন্বয়হীনতা, পৃথক পৃথক প্রযুক্তি দিয়ে প্লান্ট তৈরি। এ ছাড়া প্লান্ট পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবলের অভাব। এসব প্লান্ট সচল করতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে যেসব কর্মী রয়েছেন, তাদের দ্রুত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্লান্টগুলো সচল করা। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে, প্লান্টের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপাদন করে অন্য হাসপাতালে সরবরাহ করা। এতে সরকার বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে যে অক্সিজেন কিনছে, তা অনেকাংশে কমে আসবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে, গোটা সিস্টেম একভাবে সাজানো এবং যথাযথ তদারকি করা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, অক্সিজেন প্লান্টগুলো কেন ব্যবহার হচ্ছে না, তা জানা নেই। খোঁজ না নিয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব না। যদি কারও গাফিলতির কারণে এসব বন্ধ থাকে, তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধি)

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ব স থ য কমপ ল ক স শ ব সকষ ট ন ব যবহ র সরক র অবস থ উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত

ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স। 

গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’

পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।

আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।

সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’ 

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’

তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে আত্মসমর্পণ ও অস্ত্রত্যাগের প্রস্তাব মাওবাদীদের
  • হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত