জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন মুসলিম জীবনে এক অপূর্ব আধ্যাত্মিক সময়। মহান আল্লাহ এই দিনগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন, যখন সৎকর্মের প্রতিদান বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এমন কোনো দিন নেই, যেদিন সৎকর্ম আল্লাহর কাছে এই দিনগুলোর (জিলহজের প্রথম ১০ দিন) তুলনায় বেশি প্রিয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৬৯)
দিনগুলো কেন এত বিশেষ
জিলহজের প্রথম ১০ দিনের মর্যাদা বহুমুখী। প্রথমত, এই সময়ে ইসলাম ধর্মের পূর্ণতা লাভ করে। পবিত্র কোরআনে আছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিয়েছি, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করেছি এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে মনোনীত করেছি।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৩)
দ্বিতীয়ত, ইমাম ইবনে হাজার (রহ.
১০ দিনের সর্বোত্তম ব্যবহার
জিলহজের এই দিনগুলোয় ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের অপার সুযোগ রয়েছে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল উল্লেখ করা হলো:
১. ফরজ পালন ও নফল আমল বৃদ্ধি: ফরজ ইবাদত পালন ও হারাম থেকে বিরত থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার বান্দা যে কাজ দিয়ে আমার সবচেয়ে কাছে আসে, তা হলো আমি তার ওপর যা ফরজ করেছি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫০২)
এর পাশাপাশি নফল আমল বাড়ানো উচিত। যেমন ছোট হলেও নিয়মিত দান করা। ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত জিকির করলে হজ ও ওমরাহর সওয়াব পাওয়া যায় (তিরমিজি, হাদিস: ৫৮৬)। সূর্য পুরোপুরি ওঠার পর থেকে জোহরের ১৫ মিনিট আগপর্যন্ত দুই থেকে আট রাকাত নামাজ পড়া, যাকে ‘দুহা নামাজ’ বলে। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করলে প্রতিটি হরফের জন্য ১০ গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। (তিরমিজি, হাদিস: ২,৯১০)
২. দোয়ার পরিমাণ বাড়ানো: দোয়া ইবাদতের মূল। সিজদা, রাতের শেষ তৃতীয়াংশ, রোজা ভাঙার আগে, আজান ও ইকামার মধ্যবর্তী সময় এবং বৃষ্টির সময় দোয়া কবুলের বিশেষ মুহূর্ত। এই সময়গুলোয় বেশি বেশি দোয়া করা উচিত।
৩. আরাফার দিনে রোজা: আরাফার দিনের রোজা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের রোজা বিগত ও আগামী এক বছরের গুনাহর কাফফারা হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯৮৮)। রোজার সময় দোয়াও কবুল হয় (তিরমিজি, হাদিস: ৩,৪৯৮)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এমন কোনো দিন নেই, যেদিন সৎকর্ম আল্লাহর কাছে এই দিনগুলোর (জিলহজের প্রথম ১০ দিন) তুলনায় বেশি প্রিয়।’(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৬৯)আরও পড়ুনহজযাত্রীদের জন্য বিনা মূল্যে প্রথম আলোর হজ গাইড১০ মে ২০২৫৪. জিকির বৃদ্ধি: জিলহজের এই দিনগুলোয় তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) ও তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি বলা উচিত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘এই ১০ দিনে তাহলিল, তাকবির ও তাহমিদ বৃদ্ধি করো।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ৭,৮৪৮)
৫. তওবা ও ক্ষমাপ্রার্থনা: মানুষ হিসেবে আমরা প্রায়ই পাপে লিপ্ত হই। তাই নিয়মিত তওবা করা জরুরি। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তান পাপ করে, আর পাপীদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা, যারা তওবা করে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪,২৫১)
তওবার শর্ত হলো অনুশোচনা, পাপ ত্যাগের দৃঢ় সংকল্প ও অন্যের হক নষ্ট হলে তা পূরণ করা।
৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক জোরদার করা: আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার আয় বৃদ্ধি ও আয়ু বৃদ্ধি কামনা করে, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১,৯২৯)
এমনকি যারা সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করাই প্রকৃত আত্মীয়তা। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৯৮৪)
এই সময়ে ক্ষোভ ও বিবাদ ভুলে আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে মিলনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
৭. সৎ গুণাবলি অবলম্বন: হজ পালনকারীরা এই সময়ে বিবাদ ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকেন। আমাদেরও তা–ই করা উচিত। কাউকে ক্ষমা করা, অসুস্থদের দেখতে যাওয়া, অভাবীদের সাহায্য করা এবং সত্য ও ন্যায়ের কথা বলা এই সময়ের বিশেষ আমল।
জিলহজের প্রথম ১০ দিন সময়ে সৎকর্মের প্রতিদান অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বহুগুণ বেশি। তাই আমাদের উচিত এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইবাদত, তওবা, দান ও সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগ দেওয়া।আরও পড়ুনসাঈ মানে সাতটি দৌড়০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫৮. চুল ও নখ না কাটা: কোরবানির উদ্দেশ্যে জিলহজ মাস শুরু হলে চুল ও নখ না কাটার নির্দেশ রয়েছে, এতে একটি কোরবানির সওয়াব পাওয়া যায়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৯৭৭)
৯. কোরবানি: পবিত্র ঈদুল আজহার দিন কোরবানি একটি মহান ইবাদত। এটি হজরত ইবরাহিম (আ.)–এর ত্যাগের স্মারক। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না; বরং তোমাদের তাকওয়া তাঁর কাছে পৌঁছে।’ (সুরা হজ, আয়াত: ২২: ৩৭)
কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের জন্য সওয়াব রয়েছে। (তিরমিজি, হাদিস: ১,৪৯৩)
৯. ঈদের নামাজ: জিলহজের দশম দিনে ঈদের নামাজ মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। রাসুল (সা.) সবাইকে, এমনকি ঋতুমতী নারীদেরও (নামাজ থেকে অব্যাহতি থাকলেও) ঈদগাহে উপস্থিত থাকতে উৎসাহিত করেছেন।
জিলহজের প্রথম ১০ দিন সময়ে সৎকর্মের প্রতিদান অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বহুগুণ বেশি। তাই আমাদের উচিত এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইবাদত, তওবা, দান ও সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগ দেওয়া। পাশাপাশি পাপ ও অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকা জরুরি, যাতে এই মহিমান্বিত দিনগুলোর পূর্ণ বরকত লাভ করা যায়।
সূত্র: মুসলিম ম্যাটার্স
আরও পড়ুনঈদুল আজহার নামাজ পড়ার নিয়ম১৬ জুন ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র ১০ দ ন র সৎকর ম এই সময় র জন য আল ল হ ক রব ন সওয় ব ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
গোপালগঞ্জে আমনের ক্ষতির শঙ্কা, ধান কাটার পরামর্শ কৃষি বিভাগের
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের সিলনা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস। এ বছর ৫৪ শতাংশ জমিতে আবাদ করেছিলেন আমন ধান। পেকে যাওয়া ধান কেটে ঘরে তোলার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। পরিকল্পনা ছিল, পরিবারের যোগান মিটিয়ে, কিছু ধান বিক্রি করে পুরো বছর চালাবেন ১০ জনের সংসার। তবে, তার সেই স্বপ্ন নষ্ট করে দিল দমকা হাওয়া ও প্রবল বৃষ্টি। ধান হেলে পড়ে পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তা এখন নষ্ট হতে বসেছে।
এই কৃষক বলেন, “সাংসারে স্ত্রী, ছেলে, নাতীসহ ১০ জন আছে। এ বছর ৫৪ শতাংশ জমিতে আমন ধানের আবাদ করেছি। জমির ধানও পেকেছিল। ভেবেছি, কয়েকদিন পর ধান কেটে ঘরে তুলব। এই ধান আর ঘরে তুলতে পারলাম না। ঝড়ো হওয়া আর বৃষ্টিতে হেলে পড়ে পানিতে তলিয়ে ধান এখন নষ্ট হতে বসেছে। সারা বছর কীভাবে চলব তা চিন্তাই করতে পারছি না।” শুধু সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাসই নয়, এমন অবস্থা কয়েকটি গ্রামের শতাধিক কৃষকের।
আরো পড়ুন:
খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টি, ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা
দিনাজপুরে টানা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, জনজীবন বিপর্যস্ত
কৃষি বিভাগ বলেছে, ধান দ্রুত কেটে নিলে ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর গোপালগঞ্জ জেলায় ১২ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমিতে আমান ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রীড জাতের ২ হাজার ২৪৫ হেক্টর, উফশী জাতের ৮ হাজার ২০৩ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ২ হাজার ৩১৭ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন কৃষকরা।
রবিবার (২ নভেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শনিবার সন্ধ্যায় জেলা জুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। তীব্র বাতাস বয়ে যাওয়ায় হেলে পড়ে পাকা আমন ধান। জমিতে জমে থাকা পানিতে কেটে রাখা ধান নষ্ট হওয়ার শঙ্কা দেখা গেছে। পাশাপাশি শ্রমিক সংকট থাকায় হেলে পড়া ধান কাটতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। দ্রুত পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে না পারলে তা মাঠেই নষ্ট হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
কৃষক মহানন্দ দে বলেন, “বৃষ্টি আগে ধান কাটা শেষ করতে পারলে বিঘা প্রতি ৪০ মণ পেতাম। ধান হেলে পড়ায় ও তলিয়ে যাওয়ায় ২০ মণ পাব কিনা সন্দেহ রয়েছে। ধান কাটতে আগে ৭-৮ জন শ্রমিক লাগলেও এখন লাগবে অন্তত ১৫ জন। ফলে আমরা ধান হারানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।”
জমি থেকে ধান কাটায় ব্যস্ত চাষিরা
সিঙ্গারকুল গ্রামের কৃষক বিশ্বম চন্দ্র সরকার বলেন, “পাকা ধান বৃষ্টির কারণে নষ্ট হতে বসেছে। এ ধান না যাবে খাওয়া, না যাবে বিক্রি করা। এমনকি খড় পচে যাচ্ছে যা গরুকেও খাওয়ানো যাবে না। দেনা করে ফসল ফলিয়েছি। এখন ধার কীভাবে মেটাব, আর সারা বছর কীভাবে চলব সেই চিন্তায় দিন কাটছে।”
কৃষক মফিজুর ইসলাম বলেন, “এমন একটা দুর্যোগ গেলেও কৃষি কর্মকর্তারা আমাদের খোঁজ নেননি। শুধু আজ নয়, কোনো সময়ই আমাদের খোঁজ রাখেন না তারা। আমরা কোনো পরামর্শও পাই না তাদের কাছ থেকে। এখন যদি সরকার আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দেয়, তাহলে আমাদের মরণ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।”
গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. মামুনুর রহমান বলেন, “গত শনিবারের বৃষ্টিতে জেলায় ধানসহ কিছু ফসলের ক্ষতি হয়েছে। কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে। ক্ষতি কমাতে দ্রুত ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করে প্রণোদনা দিতে ঊর্ধ্বতণ কর্মকর্তাদের জানানো হবে।
ঢাকা/বাদল/মাসুদ