‘আমরা দিচ্ছি পুরো ঢাকা শহরে শতভাগ হোম ডেলিভারি। নেট দিয়ে ঢেকে রেখে রস সংগ্রহ করি, যে কারণে নিপাহ ভাইরাসের কোনো ঝুঁকি আমাদের খেজুরের রসে নেই। ফ্রোজেন করে পাঠানো হবে, যে কারণে স্বাদ থাকবে অক্ষুণ্ন।’

এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে খেজুরের রস বিক্রি করছে ফেসবুকভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। শুধু এই একটি পেজ নয়, এমন অনেক ফেসবুক পেজ আছে, যেগুলো থেকে খেজুরের কাঁচা রস বিক্রির বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। কেউ কেউ বাগান থেকে রস পান করতে করতে ভিডিও করে তা পেজে দিচ্ছেন।

ভাইরাস বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্যবিদ ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, এভাবে খেজুরের কাঁচা রসের প্রচারে বিজ্ঞাপন জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। খেজুরের কাঁচা রস খেলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নেই বলে যেসব বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে, তা পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক, মিথ্যা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করলেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন।

আইইডিসিআর সম্প্রতি জানিয়েছে, গত বছর নিপাহ ভাইরাসে চার জেলায় (খুলনা, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ ও নওগাঁ) পাঁচজন আক্রান্ত হন। পরে ওই পাঁচজনই মারা গেছেন। এ নিয়ে দেশে ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৪৩ জন আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন, এর মধ্যে ৭১ শতাংশই মারা গেছেন।

কাঁচা রসের বাধাহীন প্রচার

শীত মৌসুম শুরুর পর থেকেই ফেসবুকে শুরু হয় খেজুরের কাঁচা রস বিক্রির বিজ্ঞাপন। অন্তত ১২টি ফেসবুক পেজের রস বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখেছেন এই প্রতিবেদক। এসব পেজের বক্তব্য প্রায় অভিন্ন। আর প্রায় প্রতিটি বিজ্ঞাপনেই জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, তাদের রস পান করলে নিপাহ ভাইরাস হবে না।

ঢাকার মালিবাগের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে হিমায়িত রস সরবরাহ করা হয়। অর্ডার দিলে দুই দিন পর রস পাওয়া যায় রাজধানীর যেকোনো স্থানে।

খেজুরের রস সরবরাহ করেন ফেসবুকভিত্তিক এমন একটি পেজের এক স্বত্বাধিকারী বলেন, ‘আমরা নেট দিয়ে পুরো বাগান ঢেকে ফেলি। আর আমরা তো খাচ্ছি, বিক্রি করছি। কেউ তো কোনো দিন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কথা বলেনি।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, নিপাহ ভাইরাস প্রাণী থেকে প্রথমে মানুষে ছড়ায়। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে আরেকজন আক্রান্ত হতে পারেন। খাদ্যের মাধ্যমেও এটি ছড়ায়। নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ধরন কিছুটা করোনাভাইরাসের মতো। তবে এতে মৃত্যুর হার করোনার চেয়ে অনেক বেশি। পেয়ারাসহ বিভিন্ন বাদুড়ে খাওয়া ফল থেকেও এ ভাইরাস ছড়াতে পারে।

বিজ্ঞানীদের কথা

নেট, জাল বা টিন, যা দিয়েই সুরক্ষার কথা বলা হোক না কেন, কোনোভাবেই বাদুড়ের হাত থেকে রসের সুরক্ষার উপায় নেই, এমন মন্তব্য গবেষকদের। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জাতীয় নিপাহ ভাইরাস সার্ভিল্যান্সের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সৈয়দ মঈনউদ্দিন সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাল বা টিন যা-ই হোক না কেন, এসব দিয়ে পানি চুঁইয়ে পড়ে। আমরা গবেষণায় দেখেছি, মূলত বাদুড়ের মূত্রই বেশি মেশে রসের সঙ্গে।’

প্রকৃতিগতভাবেই বাদুড়ের প্রস্রাব করার প্রবণতা বেশি। এর কারণ প্রসঙ্গে মঈনউদ্দিন সাত্তার বলেন, বাদুড়ের মূত্রথলি অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট। বাদুড় তাই রস খেতে খেতেই প্রস্রাব করে।

জাল বা টিন দিয়ে সুরক্ষায় আরেকটি ক্ষতিকর দিক আছে। আর তা হলো, বাদুড় যদি রস খেতে বাধা পায়, তবে বিরক্ত হয়। আর বিরক্ত হলে বাদুড়ের প্রস্রাব করার প্রবণতা আরও বেড়ে যায় বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে।

সরকার যা বলছে

আইইডিসিআর নিপাহ ভাইরাসের বিপদ থেকে বাঁচতে সতর্কবার্তা দিয়েছে, কিন্তু এর প্রচার তেমন নেই। এখন রসের যে ব্যাপক প্রচার হচ্ছে, তাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক তাহমিনা শিরীন। তাঁর কথা, এসব প্রচার বন্ধে আইনি ব্যবস্থা দরকার। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তা করতে পারে।

খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরি হয়। এ থেকে নানা পিঠা হয়। খেজুরের গুড়ের একটি বড় বাজার আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জ্বাল দেওয়া রস বা খেজুড়ের গুড় খেলে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু কাঁচা রস পান অবশ্যই পরিহার করতে হবে।

কাঁচা রসের প্রচারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকার কতটুকু তৎপর, এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই রস যে ক্ষতিকর, এমন বৈজ্ঞানিক তথ্য সরকারের পক্ষ থেকে পেলে এবং আইন তৈরির নির্দেশ পেলে আমরা সচেষ্ট হব; কিন্তু এর নির্দেশ তো আসতে হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে

চট্টগ্রামে এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব গত এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, আর এর সরাসরি ফল ভোগ করছেন নগরবাসী। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, এবার ডেঙ্গুর চেয়েও চিকুনগুনিয়া ঘরে ঘরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যা এক নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মশা নিধনে কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবই এ রোগের দ্রুত বিস্তারের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চট্টগ্রামে এভাবে জনস্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম নগর এডিস মশাবাহিত রোগের জন্য এখন অতি ঝুঁকিপূর্ণ। গত বছর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগ একই ধরনের জরিপ চালিয়েছিল। এই দুই জরিপের তুলনামূলক চিত্র আমাদের সামনে এক ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে—এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব দুটিই আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

২০২৪ সালে চট্টগ্রামে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব (ব্রুটো ইনডেক্স) ছিল ৩৬ শতাংশ, যা এবার আইইডিসিআরের গবেষণায় পৌঁছেছে ৭৫ দশমিক ২৯ শতাংশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান যেখানে ২০ শতাংশ, সেখানে চট্টগ্রামের এ চিত্র রীতিমতো ভয়াবহ। বাসাবাড়িতেও লার্ভার উপস্থিতি বেড়েছে। গত বছর ৩৭ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেলেও এবার তা প্রায় ৪৮ শতাংশে পৌঁছেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবার ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়ার রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেকের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটিই হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতি, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। চলতি বছরেই ৭৬৪ জনের চিকুনগুনিয়া ও ৭৯৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে এবং ডেঙ্গুতে আটজন প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ছয়জনই মারা গেছেন এই জুলাই মাসে।

সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, আইইডিসিআরের সুপারিশগুলো সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজ চলছে। সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম দাবি করছেন যে মশকনিধনে ক্রাশ কর্মসূচি চলছে এবং নতুন জরিপ অনুযায়ী হটস্পট ধরে কাজ করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হলো এ উদ্যোগগুলো কি যথেষ্ট? লার্ভার ঘনত্ব যেখানে তিন-চার গুণ বেশি, সেখানে গতানুগতিক কর্মসূচির ওপর নির্ভর করলে চলবে না।

মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার কোনো বিকল্প নেই। এ কাজে সিটি করপোরেশনকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। বাসাবাড়িতে নানা জায়গায় জমে থাকা স্বচ্ছ পানিও এডিস মশার প্রজননের জন্য যথেষ্ট। ফলে নাগরিকদের সচেতনতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম শহরকে মশাবাহিত রোগের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে হলে স্থানীয় প্রশাসন, নগর কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে; নগরবাসীকে দ্রুত তৎপর হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে