দেশে প্রতিবছর ১ লাখেরও বেশি মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ: গবেষণা
Published: 18th, January 2025 GMT
বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রভাবে প্রতিবছর ৫ হাজার ২৫৮ শিশুসহ ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জন মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। একই কারণে প্রতিবছর ৯ লাখ মায়ের অকাল প্রসব হচ্ছে এবং প্রায় ৭ লাখ কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করছে। আর এ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে প্রতিবছর ৬ লাখ ৭০ হাজার রোগী জরুরি বিভাগে ভর্তি হচ্ছেন, যার ফলে সম্মিলিতভাবে বছরে ২৬৩ মিলিয়ন কর্মদিবস হারাচ্ছেন। সেন্টার ফর রিসার্চ অন অ্যানার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
শনিবার (১৮ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবে সিআরইএ ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে `বাংলাদেশে সূক্ষ্মকণা বায়ু দূষণে জনস্বাস্থ্য প্রভাব‘ শীর্ষক আলোচনায় এই গবেষণা প্রকাশ করে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের শীর্ষ দূষিত দেশের তালিকায় স্থান হয়েছে বাংলাদেশের। যেখানে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বালু কণার বার্ষিক মান ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম; যা বার্ষিক জাতীয় মানদণ্ড ৩৫ মাইক্রোগ্রামের দ্বিগুণের বেশি। উচ্চতর স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস হচ্ছে। ২০১৯ সালে সার্বিকভাবে এই ব্যয়গুলো ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। যা বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ।
এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড ৫ মাইক্রোগ্রামের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি। বাতাসের এমন চরম দূষণ জনস্বাস্থ্যের ওপর অনিবার্য পরিণতি ডেকে আনছে। বিভিন্ন বয়সীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হবার পাশাপাশি ৫ বছর কম বয়সী শিশুদের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বায়ুদূষণের প্রভাবে উদ্বেগজনক স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যেই ২০২২ সালে সরকার প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধূলি কণার জাতীয় মান ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; যা গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টির পাশাপাশি বায়ুর মান অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে বলেও মনে করছেন গবেষকরা।
সিআরইসিএ-এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় বায়ুমানের মানদণ্ড (৩৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার) পূরণ করা সম্ভব হলেও তা বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এতে মৃত্যুহার ১৯ শতাংশ, আয়ুষ্কাল জনিত সমস্যা ২১ শতাংশ এবং অক্ষমতার সাথে বসবাস করা বছর ১২ শতাংশ কমতে পারে।
এ ছাড়া ডব্লিউএইচও-এর ২০২১ সালের কঠোর নির্দেশিকা বায়ুর মান প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম অর্জন করা সম্ভব হলে মৃত্যুহার ৭৯ শতাংশ হ্রাস পাবে। যা প্রতি বছর ৮১ হাজার ২৮২ মানুষের জীবন রক্ষা করবে। সেইসঙ্গে হাঁপানি-শ্বাসকষ্ট প্রায় সমস্ত জরুরি চিকিৎসক ভিজিট, অকাল প্রসব এবং বার্ষিক ২৬৩ মিলিয়ন কর্মদিবস অসুস্থতাজনিত ছুটি এড়ানো যাবে।
সুপারিশ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে নিজস্ব জাতীয় নির্দেশিকা মেনে চলার পাশাপাশি তা প্রয়োগ করতে হবে। মাঝারি মেয়াদে ২০০৫ সালে ডব্লিউএইচও এর নির্দেশিকা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ মাইক্রোগ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হিসাবে ২০২১ সালের ডব্লিউএইচও নির্দেশিকা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম অর্জন করা উচিত।
কয়লা ও ডিজেলের মত কার্বণ নিঃসরণকারী জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসাহিত করা উচিত। এছাড়া ক্লিন পরিবহন ব্যবস্থা ও শিল্প সম্প্রসারণ দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কঠোর শিল্প নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যানবাহন এবং কলকারখানার নির্গমন মান বাড়াতে হবে। ভূমিভিত্তিক এবং স্যাটেলাইট ডেটা একত্রিত করে জাতীয় পর্যবেক্ষণ কাঠামো তৈরি করতে হবে, স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ধারণে সহায়ক হবে।
সিআরইএ এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ্লেষক এবং প্রধান লেখক ড্যানিয়েল নেসান বলেছেন, বিভিন্ন বায়ু মানের মানদণ্ড, বাংলাদেশের বর্তমান মান এবং ২০০৫ ও ২০২১ সালের ডব্লিউএইচও এর নির্দেশিকা তুলনা করে দেখা গেছে যে, পিএম ২.
সিআরইএ এর বায়ু মান বিশ্লেষক ড. জেমি কেলি বলেন, বাংলাদেশের বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার অপরিণত শিশু, কম ওজনের শিশুর জন্ম এবং শিশু মৃত্যু ঘটছে। এই পরিস্থিতি এমন হস্তক্ষেপের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, যা সবচেয়ে অরক্ষিতদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম। দূষণ প্রতি বছর প্রায় ২৬৬ মিলিয়ন কর্মদিবসের ক্ষতি সৃষ্টি করে, যা উৎপাদনশীলতার বড় ধরনের ক্ষতি করে ব্যবসা ও পরিবারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে দেয়। বাংলাদেশের বায়ু দূষণ সমস্যার সমাধান জনস্বাস্থ্য এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের সমতুল্য।
ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বর্তমানে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে গিয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা শুধু মানুষের শরীরেই প্রভাব ফেলছে না, বরং বিপর্যস্ত করে তুলছে মানসিক স্বাস্থ্যকেও। এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৪ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর মানুষের গড় আয়ু ২ দশমিক ৭ বছর হ্রাস পেয়েছে। তবে উক্ত প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে নাগরিকদের গড় আয়ু হ্রাস পেয়েছে ৪ দশমিক ৮ বছর।
ঢাকা/হাসান/এনএইচ
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
চিম্বুকে ভালুকের আক্রমণে একজন আহত, ৫ বছরে ১০ জন হামলার শিকার
বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কের পোড়াবাংলা পটোসিংপাড়ায় আজ শুক্রবার সকালে ভালুকের আক্রমণে একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁকে উদ্ধার করে বান্দরবান সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
বন বিভাগ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ২০২১ সাল থেকে ভালুকের আক্রমণ বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে ১০ জন আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের অধিকাংশ ম্রো জনগোষ্ঠীর। ভালুকের কারণে আহত হওয়ার ঘটনায় আবেদন না করায় এই পর্যন্ত কেউ ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পোড়াবাংলা পটোসিংপাড়ার কাইনপ্রে ম্রো (৩৫) পাড়া থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে জুমখেতে কাজ করতে যান। সেখানে জুমের পাশে কলাবাগানে কাজ করার সময় হঠাৎ কালো রঙের একটি ভালুক তাঁর ওপর আক্রমণ করে। ভালুকটি তাঁর পেটে ও মুখে আঘাত করতে থাকে। তাঁর চিৎকারে আশপাশে জুমের লোকজন এগিয়ে আসেন।
আহত কাইনপ্রে ম্রোর ভাই তনরুই ম্রো জানিয়েছেন, আশপাশের লোকজনের এগিয়ে আসা দেখে ভালুকটি কাইনপ্রে ম্রোকে ছেড়ে দিয়ে বনে পালিয়ে যায়। তাঁরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে কাইনপ্রে ম্রোকে উদ্ধার করে দুপুরে বান্দরবান সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পোড়াবাংলা পটোসিংপাড়া জেলা শহর থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরে। পাড়াটি রুমা উপজেলার গালেংগ্যা ইউনিয়নে পড়েছে।
বান্দরবান সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আহত কাইনপ্রে ম্রোর পেটে ও মাথায় গভীর ক্ষত আছে। এ জন্য তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
জানা যায়, থানচি তিন্দু ইউনিয়নে মেনপই ম্রো নামের একজন ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল প্রথম ভালুকের আক্রমণের শিকার হন। ওই একজনসহ ২০২১ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৫ বছরে ১০ জন ভালুকের আক্রমণে আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে থানচিতে দুজন, রুমাতে তিনজন, আলীকদমে একজন ও বান্দরবান সদর উপজেলা চিম্বুক পাহাড়ে চারজন রয়েছেন। কারও মৃত্যু না হলেও তাঁদের মধ্যে কেউ চোখ হারিয়েছেন, কারও হাত–পা পঙ্গু হয়েছে। আহত ব্যক্তিরা একজন মারমা ও একজন খুমি ছাড়া অন্যরা সবাই ম্রো।
বন বিভাগের বান্দরবানের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আবদুর রহমান জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কেটে উদ্যান বাগান ও জুমচাষ করা এলাকাগুলোতে ভালুকের আক্রমণ বেড়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, বাগানের কারণে ভালুক ও অন্যান্য বন্য প্রাণীরা আবাসস্থল ও বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যসংস্থান হারাচ্ছে। জীবনের তাগিদে তারা মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হতে বাধ্য হচ্ছে। বন নির্ভর মানুষকে অন্যভাবে আয়ের সংস্থানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সংরক্ষণ না হলে বন্য প্রাণীর সঙ্গে সহাবস্থান গড়ে উঠবে না। এভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা না হলে বন্য প্রাণী ও মানুষ কারও জন্য মঙ্গলজনক হবে না।