আশির দশকের বিয়ে ‘তেলাই থেকে ঘুরানি’
Published: 22nd, February 2025 GMT
আশির দশক আমার কৈশোরের সোনালি আলো মাখা স্মৃতিতে ভেসে আছে। ওই সময়ের গ্রাম-গঞ্জের বিয়েতে যে রীতি ছিল তা আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানকে বলা হতো ‘তেলাই’। তখন বর-কনে উভয়কেই ‘তেলাই’ দেওয়া হতো।
কিন্তু এখনকার দিনে বর কনে উভয়কে যেমন সমান গুরুত্ব দিয়ে গায়ে হলুদ দেওয়া হয়, এই আনুষ্ঠানিকতা তখনকার দিনে কম হতো। বরের ক্ষেত্রে বিয়ের দিন গোসলের সময় মা হয়তো একটু হলুদ বেটে ছেলের কপালে লাগিয়ে দিতেন। তারপর গোসল করিয়ে নতুন লুঙ্গি, পাঞ্জাবী পরিয়ে বরকে প্রস্তুত করা হতো। কনের গায়ে হলুদে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। গায়ে হলুদে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হতো, সেগুলোর বেশিরভাগই ব্যবহার করা হতো কনের গায়ের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য। কনের গায়ে ও মুখে দেওয়া হতো হলুদ ও গিলা বাটা (এক ধরনের গাছে বীজ)। গিলা বাটা কনেকে গোসল করিয়ে নতুন শাড়ি পরানো হতো। তবে সেটা হলুদ শাড়ি হতেই হবে তেমন চল ছিল না। সাধারণত তাঁতের শাড়ি পরানো হতো। এই শাড়ি স্থানীয় তাঁতিদের তৈরি শাড়িই হতো। বিয়ের আগের দিন কনেকে এক ধরনের খাবার খাওয়ানো হতো। যাকে আইবুড়ো ভাত বলা হতো।
আরো পড়ুন:
বিশ্ব ইজতেমায় ৬৩ যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত
যেভাবে তৈরি করবেন ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’ প্ল্যান
বিয়েতে গীত গাওয়ার রীতি ছিল। গ্রামের যেসব নারী গীত গাইতে পারতেন তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিয়ে বাড়িতে আসতেন, গীত গাইতেন এরপর পান, সুপারি খেয়ে বিদায় নিতেন। হেঁটে, পালকি নিয়ে অথবা গরুর গাড়িতে বরযাত্রী যেত কনের বাড়িতে। বর্ষা ঋতুতে নৌকায় বরযাত্রী যাওয়ার দৃশ্য দেখা যেত। দেখা যেত যে বউকে নেওয়ার জন্য পালকি বা ডুলি আনা হতো। ডুলিতে শুধুমাত্র বউ বসতে পারতো। কারণ ডুলি আকারে ছোট। কিন্তু পালকি বড়-ছোট হতো। এমনও পালকি ছিল যে, চারজন বসতে পারতেন। সাধারণত ওই সময় কলা গাছ এবং দেবদারুর পাতা দিয়ে গেইট তৈরি করা হতো। এ ছাড়া রঙিন কাগজের ঝালর দিয়ে গেইটে, বর বসার জায়গা সাজানো হতো।
যথারীতি বর আসার পরে ‘গেইট ধরা’ হতো। সেখানে দরদাম হতো। ইংরেজিতে বাকোয়াজ হতো। অনেক সময় পরবর্তীতে দেখা যেতো যে দুই পক্ষের মুরব্বিদের সমঝোতায় টাকার মাধ্যমে সেটা মীমাংসা হতো। এরপর বর তার জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসতো। আরেকটি বিষয় ছিল বরের জুতা চুরি করা। শালা, শালি এমন স্থানীয় লোকেরা বরের জুতা চুরি করার ধান্ধায় থাকতো আর বরপক্ষের এমন এক্সপার্ট লোক থাকতো যার কাজই ছিল বরের জুতা চোখে চোখে রাখা। কিন্তু যেকোন ভাবেই বরের জুতা চুরি হয়েই যেত। এরপরে আবার ধ্যান-দরবার হতো যে, বর এখন কি পরবে? তখন আবার বরের বোন জামাই যে থাকতো দেখা যেত যে টাকা পয়সা দিয়ে বরের জুতা উদ্ধার করতো। কনের ‘আয়ো সিঙ্গারীরা’ কনেকে বিয়ের আগের দিন থেকে সম্পূর্ন দেখভাল করে রাখতো এবং বিয়ের কনে হিসেবে সাজিয়ে দিত। আর কনেকে সাজানোর জন্য বরের বাড়ি থেকে যেসব জিনিসপত্র পাঠাতো তার নাম ছিল খঞ্চা। খঞ্চায় আয়ো সিঙ্গারীদের জন্য আলাদা উপহার থাকতো। আরও থাকতো দাদী, নানীর শাড়ি। দেখা যেত যে যদি আপন দাদী, নানী নাও থাকতো তাহলে পাড়া প্রতিবেশি দাদি, নানিকে ওই শাড়ি দেওয়া হতো।
মুসলিম বিয়েতে বরযাত্রীদের জন্য গরুর মাংস, ভাত, সবজি, ডাল, দই, মিষ্টি দেওয়া হতো। তখন পোলাও তেমন দেওয়া হতো না। বর কনের বিয়ে পড়ানো হতো মুরব্বিদের উপস্থিতিতে। এরপর একটি গামলা পানিভর্তি করে তার মধ্যে কড়ি, আংটি কিংবা পয়সা দিয়ে দেওয়া হতো। একটা ওড়নায় বর-কনের মাথা ঢেকে তাদেরকে গামলা থেকে কড়ি খুঁজে বের করতে বলা হতো। দেখা যেত কড়ি বা পয়সা এক সময় বর পাচ্ছে, আরেকবার কনে পাচ্ছে। এরপর মিষ্টি মুখের পালা—বর কনেকে মিষ্টি খাইয়ে দিত এবং কনে বরকে মিষ্টি খাইয়ে দিত। তারপর হতো মালা বদলেন আনুষ্ঠানিকতা হতো। বিয়ে শেষে কনে বিদায়ের সময় প্রচণ্ড কান্নাকাটি হতো। কনে কান্নাকাটি করতে করতে অনেক সময় বেহুশ হয়ে যেতো। কনের সঙ্গে ছোট, ভাই বোন বা দাদি, নানি যেতেন। এই যাওয়াকে বলা হতো ‘কোল ধরা’। কনে শ্বশুরবাড়িতে চলে যেতো। এক বা দুইদিন পরে বউ ভাত হতো। ওই অনুষ্ঠানে কনেপক্ষের লোকজন মাছ, মিষ্টি, পান, সুপারি নিয়ে দাওয়াত খেতে যেতো। যেয়ে আবার বর কনেকে সহ নিয়ে আসা হতো মেয়ের বাবার বাড়িতে। যেটা ‘ফিরানি’ নামে পরিচিত। পরদিন নতুন জামাইকে বাজার করতে যেতো হতো। জামাই বাজারে গিয়ে ঝাকায় করে মাছ, মাংস, দুধ থেকে শুরু করে মসলা পর্যন্ত কিনে আনতো। অর্থাৎ যার যেমন সামর্থ। এই নিয়ে লোকজনেরা উৎসুক থাকতো। কার জামাই কত ভালো বাজার করলো এই দেখার জন্য পাড়াপরশিরা আসতো। তারা কিন্তু খেতে আসতেন না কিন্তু বাজার দেখতে আসতেন এবং এই নিয়ে চর্চা চলতো। নতুন বর শ্বশুরবাড়িতে দুই বা তিনদিন থেকে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতো। যাকে বলা হয় ‘ঘুরানি’। এই ঘুরানির মাধ্যমে শেষ হতো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর বর র জ ত র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
রোজার আগেই নির্বাচন, এরপর আগের কাজে ফিরে যাবেন
অন্তর্বর্তী সরকার সময়মতো ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র রমজানের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর তিনি তাঁর আগের কাজে ফিরে যাবেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে এসব কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন থেকে ভিডিও ফোনকলে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেন জর্জিয়েভা।
এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার, আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের পূর্ববর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।
আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এই কৃতিত্ব তাঁর নিজের।
অর্থনীতির সংকটকালীন পরিস্থিতি স্মরণ করে আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘আপনার অর্জন আমাকে মুগ্ধ করেছে। অল্প সময়ে আপনি অনেক কিছু করেছেন। যখন অবনতির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি ছিল, তখন আপনি দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তি।’
ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বিশেষভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা এবং রিজার্ভ পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের সাহসী পদক্ষেপ, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তনের প্রশংসা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের এক সংকটময় সময়ে আইএমএফ প্রধানের অবিচল সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘চমৎকার সহায়তার জন্য ধন্যবাদ।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, গত বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কথোপকথনে আইএমএফ প্রধান অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে গভীর সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘শক্ত অবস্থানে থাকতে হলে সংস্কার অনিবার্য। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য মুহূর্ত।’
অধ্যাপক ইউনূস জানান, তাঁর সরকার ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন এবং রাজস্ব সংগ্রহ জোরদারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এক বিধ্বস্ত ও সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কিছু ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে ব্যাগভর্তি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল নেপালে চলমান যুব আন্দোলন এবং আসিয়ানভুক্তির জন্য বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। অধ্যাপক ইউনূস আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি জোরদারের লক্ষ্যে ঢাকার বৃহৎ অবকাঠামো উদ্যোগ—যেমন নতুন বন্দর ও টার্মিনাল প্রকল্প—সম্পর্কেও অবহিত করেন।
আলোচনাকালে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।