শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড–এই আপ্তবাক্যের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এই অনিবার্য সত্যকে আরেকটু সম্প্রসারিত করে বলা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষার মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড না বলে ভিত্তি বললে সম্ভবত আরও লাগসই হবে। শিক্ষার ভিত্তি অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা যদি মজবুত না হয়, তাহলে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হতে বাধ্য। প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর অধিকার। তাই সরকার এটিকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করেছে। ঝরে পড়ার হার কমানোর জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত। এদিকে দেশের অলিগলিতে, নানা স্থানে বহুতল ভবনের কোণে ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে। বছরের শুরুতে নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করে তারা। বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। অভিভাবকদের অনেকে আজকাল নগদ ফল পেতে আগ্রহী। যে প্রতিষ্ঠানে ভালো ফল হয়, সেখানে সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য তারা অধীর হয়ে ওঠেন। ডোনেশন দিয়ে হলেও ভর্তি করাতে ব্যস্ত হন। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে উপজেলার অনেক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর আসন ফাঁকা থাকে। কেন এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রতি তাদের অনাগ্রহ? অন্যতম কারণ ফলাফলে কিন্ডারগার্টেনগুলোই এগিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। অনেক কিন্ডারগার্টেন অকারণে শিক্ষার্থীর খাতায় অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করে। শিক্ষকরা আন্তরিক হলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফল ভালো হতে বাধ্য।


প্রাথমিক শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে অনেক পরিবারে দারিদ্র্য অন্যতম প্রতিবন্ধক। যে বয়সে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে শিশুদের অনেক অভিভাবক ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত করেছেন। এতে সাময়িকভাবে দারিদ্র্য কিছুটা লাঘব হচ্ছে কিন্তু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বহু সম্ভাবনাময় জীবন। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) অন্যতম মানসম্মত শিক্ষা। এটি কখনোই নিশ্চিত করা যাবে না, যদি প্রাথমিক শিক্ষা অর্থাৎ শিক্ষার ভিত্তি মজবুত না হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সংকট নেই, বইয়ের সংকট নেই। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে খেলাধুলার স্থান রয়েছে। এরপরও এর প্রতি অভিভাবকদের আগ্রহ কম। আমি এমন অনেক শিক্ষককে চিনি, যিনি সন্তানকে নিজের বিদ্যালয়ে না পড়িয়ে অন্য কোনো কিন্ডারগার্টেনে পড়াচ্ছেন। এমন স্ববিরোধিতা মোটেই কাম্য নয়।


প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকমণ্ডলীই একটি বিদ্যালয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারেন। নিয়মিত পাঠদান ও নিবিড় পরিচর্যার মধ্য দিয়ে অভিভাবকদের আস্থা অর্জন করতে হবে তাদেরকে। এ কাজটি তারা যথাযথভাবে করছেন কিনা, সেটি নিশ্চিত করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। প্রশাসন ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তদারকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে সাহায্য করবে।


সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আরও মানসম্মত করার লক্ষ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইসিটি উপকরণ পৌঁছে দিচ্ছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের প্রচলন হয়েছে বহু বিদ্যালয়ে। শিক্ষকদের আইসিটির ওপর প্রশিক্ষণ ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ চালু করায় শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। তা ছাড়া সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে এবং ইতোমধ্যেই অনেক এলাকায় তা বাস্তবায়িত হয়েছে। বিনা বেতনে লেখাপড়া করার সুযোগ ছাড়াও রয়েছে বৃত্তি সুবিধা। অন্যদিকে কিন্ডারগার্টেনগুলোতে লেখাপড়া করা শিশুদের মাসে মোটা টাকা বেতন দিতে হয়, অতিরিক্ত বই কিনতে হয়। তারপরও সেখানেই অভিভাবকদের আস্থা জন্মেছে। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে তা দেখা যাচ্ছে না।


সরকারের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। এটি দূর করার জন্য বিদ্যালয়গুলোকে সৃজনশীল উদ্যোগ নিতে হবে। দীর্ঘ সময় শ্রেণিকক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমি ও ক্লান্তি দূর করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিভা রয়েছে। একজন ভালো শিক্ষকের অন্যতম দায়িত্ব শিক্ষার্থীর মধ্যকার সুপ্ত প্রতিভা আবিষ্কার করা। চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, সংগীত, বিতর্ক, খেলাধুলাসহ নানা বিষয়ে তারা পারদর্শী। এই গুণগুলোর পরিচর্যা করতে হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বহু শিক্ষার্থীর মধ্যে লেখালেখির প্রবণতা রয়েছে। তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে দেয়ালিকা প্রকাশ সম্ভব। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বাগানের উপস্থিতি শিশুর মনকে রঙিন করে। এককথায় বিদ্যালয়ের পরিবেশকে আনন্দদায়ক করতে হবে। সৃজনশীলতার চর্চা শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ের প্রতি অধিকতর আগ্রহী করে তোলে।


প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা যদি মজবুত না হয়, তাহলে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা হুমকির মধ্যে পড়বে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ধরে রাখা ও মানসম্মত পাঠদান অত্যন্ত জরুরি। এই বিদ্যালয় থেকে শুধু শ্রেণিকক্ষের পড়া নয়, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষাও গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা। এ সময়ে যদি তারা কোনো ভুল শিক্ষা পায়, এর মাশুল দিতে হয় সারাজীবন ধরে। সে জন্য প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে কোনো অবহেলা বা ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে আত্মঘাতী।

রাজীব কুমার সরকার: জেলা প্রশাসক, লক্ষ্মীপুর

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ন ড রগ র ট ন ন শ চ ত কর ব যবস থ দ র অন র অন ক সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের হামলায় ২০ ইসরায়েলি নিহত

ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলা চারদিন ধরে চলছে। এসব হামলায় উভয় দেশের মধ্যে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ইসরায়েলের জাতীয় পরিষেবা জানিয়েছে, আজ সোমবার ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গত শুক্রবার থেকে আজ সোমবার পর্যন্ত ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা  ২০ জনে পৌঁছুল। আজ সোমবার এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসি।

অন্যদিকে আল-জাজিরা বলছে, ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় রোববার পর্যন্ত ইরানে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২৪ জনে পৌঁছেছে।

ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি পরিষেবার প্রধান ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডমের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, মধ্য ইসরায়েলজুড়ে ইরানের হামলায় চারজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুইজন নারী। 

এর আগে সিএনএন ইসরায়েলের ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর দেয়। ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম কানের খবর বলছে, বন্দরনগরী হাইফায় অন্তত দুইজন আহত হয়েছেন। এছাড়া, তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন।

রোববার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানায়, ইরান থেকে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়েছে। একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছে ইসরায়েল। বর্তমানে হামলা প্রতিহত করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে আইডিএফ।

আজ সিএনএনের এক খবরে বলা হয়েছে, তেল আবিব ও জেরুজালেমসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে জরুরি সতর্ক সংকেত (সাইরেন) বাজতে শুরু করেছে। আইডিএফ সতর্ক করে বলেছে, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি অভেদ্য নয়।

সিএনএনের একজন প্রযোজক জেরুজালেমে সাইরেন এবং একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। তার তোলা ভিডিওতে আকাশে বহু ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে যেতে দেখা গেছে।

ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা সংস্থা ম্যাগেন ডেভিড আদোম জানিয়েছে, তাদের দলগুলো আক্রান্ত এলাকার দিকে রওনা দিয়েছে।

সারা দেশের নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে ঢুকতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকার আহ্বান জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেছে, বর্তমানে বিমানবাহিনী হামলা প্রতিহত করার পাশাপাশি পাল্টা হামলা চালানোর কাজ করছে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট নিউজ জানিয়েছে, মধ্য ইসরায়েলের পেতাহ টিকভা শহরের একটি ভবনে একটি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে। হামলার ফলে ওই স্থানে আগুন ধরে যায়। তবে এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

এদিকে মধ্য ইরানে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির সেনাবাহিনী এ তথ্য জানিয়েছে। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর দাবি, বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সফলভাবে মধ্য ইরানে অবস্থিত একাধিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। আমাদের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এসব স্থাপনা থেকে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছিল।’

তবে ইসরায়েলের এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান এখনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।

এদিকে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় রোববার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২৪ জনে পৌঁছেছে।

বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক। হামলায় ১ হাজার ২৭০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

এপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ১৩ জুন ইরানে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ওই হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ ও ইসফাহান অঞ্চলের পারমাণবিক স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। ইরানে বর্তমানে মসজিদ ও মেট্রো স্টেশনগুলোকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের তিন শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন। রোববার ইসরায়েল সরকারের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন।

ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ বলেছে, এছাড়া ইরানের হামলায় কমপক্ষে ৩৮৫ জন আহত হয়েছেন, যার মধ্যে সাত জনের অবস্থা গুরুতর।

এদিকে ইসরায়েলি পুলিশের বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, তেল আবিবের দক্ষিণে অবস্থিত বাত ইয়াম শহরে ৬ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। এছাড়া সাতজন এখনও নিখোঁজ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন জরুরি সেবাদানকারীরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ