শাহরুখ খান: গণহত্যার সময় বিলিয়নিয়ার হওয়ার অর্থ কী
Published: 3rd, November 2025 GMT
এ বছর শাহরুখ খানের জন্মদিনটা ভিন্নভাবে উদ্যাপিত হয়েছে এটা বলা যায়। রোববার যখন এই মেগাস্টার ৬০ বছরে পা দিলেন, তখন তিনি শুধু বলিউডের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘বাদশা’ হিসেবেই নয়, বরং একজন বিলিয়নিয়ার হিসেবে সর্বকালের সবচেয়ে ধনী ভারতীয় অভিনেতা হিসেবেও পরিচিত হবেন।
হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্ট অনুযায়ী, খান গত অক্টোবরেই বিলিয়নিয়ার স্তরে পৌঁছান, যা তাঁকে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.
সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়, ভারতের মূলধারার মিডিয়া তাঁর এই অর্জনকে উদ্যাপন করেছে—তার নিরলস পরিশ্রম, অনন্য প্রতিভা, ক্যারিশমা এবং ব্যবসায়িক দক্ষতার প্রশংসায়, যা তাঁকে রিয়েল এস্টেট, স্পোর্টস ফ্র্যাঞ্চাইজি এবং ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্টে বিস্তৃত বহুবিধ পোর্টফোলিও গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
‘এই অর্জন…বহু বছরের অবিরাম পরিশ্রমকে মুকুট পরিয়েছে…তাঁর ব্র্যান্ডকে পরিণত করেছে একটি শক্তিশালী সম্পদ-ইঞ্জিনে’, লিখেছে ইন্ডিয়া টুডে। হিন্দুস্তান টাইমস যুক্তি দিয়েছে: ‘শাহরুখ খানের বিলিয়নিয়ার ক্লাবে প্রবেশ—মাথা এবং হৃদয়—উভয়ের কাছেই সম্পূর্ণ অর্থবহ।’
একইভাবে ইকোনমিক টাইমস মন্তব্য করেছে: ‘তাঁর যাত্রা প্রমাণ করে, প্রতিভা, পরিশ্রম এবং স্মার্ট বিনিয়োগ পর্দার ভেতরে এবং বাইরে—উভয় জায়গায়—স্থায়ী উত্তরাধিকার তৈরি করতে পারে।’
কিন্তু খুব কম লোকই ভেবেছে—২০২৫ সালে বিলিয়নিয়ার হওয়ার অর্থ কী?
গত বছর গবেষকেরা সতর্ক করেছিলেন একটি ভারতে বৈষম্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের চেয়েও খারাপ অবস্থায় রয়েছে; যেখানে মধ্যবিত্তের সুযোগ-সুবিধা ভেঙে পড়ায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে এবং যেখানে তাঁর (শাহরুখ খান) মতো মুসলমান পরিচয়ের মানুষেরা ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি।
আরেকটি প্রশ্ন এর ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে: ভারত, গাজা বা কাশ্মীরে সামাজিক-রাজনৈতিক উথালপাতালের মুখে শাহরুখের নীরবতা—তাঁর সম্পদ বৃদ্ধিতে কি ভূমিকা রেখেছে? আসলেই, এমন সময়ে বিলিয়নিয়ার হওয়া শাহরুখ খান সম্পর্কে কী বলে?
শাহরুখের সম্পদের গল্প
খানের উত্থান বুঝতে হলে, শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী ভারতের ইতিহাস দেখতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সমাজে হিন্দু জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়, আর হিন্দি জনপ্রিয় সিনেমা বিনা সংকোচে বহুজাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটি আকাঙ্ক্ষিত ভারতের স্বপ্ন তৈরি করে।
শাহরুখ খান হয়ে ওঠেন এক সেতু—সংরক্ষণশীল অতীত থেকে মুক্ত বাজারের ভবিষ্যতের দিকে। সবকিছুই দেখতে নির্দোষ মনে হতে পারে। স্বজনপ্রীতির ওপর দাঁড়ানো একটি ইন্ডাস্ট্রিতে বহিরাগত হিসেবে তাঁর সাফল্য অনেকের জন্য আশার গল্প হয়ে ওঠে।
যেখানে ট্রিকল-ডাউন (চুইয়ে পড়া) অর্থনীতি ছিল এক প্রতারণা, সেখানে বোম্বেতে শাহরুখ খানের উত্থান মানুষকে ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস রাখতে এবং ‘ইন্ডিয়া’ ধারণাকে বিশ্বাস করতে সাহায্য করেছিল।
হিন্দু জাতীয়তাবাদ যখন ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন রাজ, রাহুল এবং পরবর্তী সময়ে বীর—তাঁর জনপ্রিয় চলচ্চিত্র চরিত্রগুলো—দক্ষতার সঙ্গে বর্ণ-ধর্মীয় বিভাজনকে আড়াল করেছিল এবং অসমতাকে রাজনৈতিক প্রশ্ন নয়, বরং ব্যক্তিগত সামর্থ্যের প্রশ্নে রূপ দিয়েছিল।
তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের সাফল্যের প্রতীক। এটি সাধারণ মানুষকে নিশ্চিত করেছিল—তারা চাইলে সাফল্য পেতে পারে, আধুনিক হতে পারে এবং ভারতীয় হতে পারে।
একজন বিনোদন সাংবাদিক ২০২৩ সালে ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, ‘তাঁর (শাহরুখ) ব্যক্তিগত জীবন “ইন্ডিয়া”র ধারণার প্রতিচ্ছবি। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু দেশে একজন মুসলমান, হিন্দু নারীকে বিয়ে করেছেন এবং তাঁর সন্তানেরা তাঁদের ইচ্ছামতো ধর্ম গ্রহণ করে বড় হচ্ছেন।’
কিন্তু আসলে তিনি যা ছিলেন—এটি তার চলচ্চিত্রেও দেখা যায়—তিনি ছিলেন মুসলমানের একটি নিরাপদ রূপ, এমন এক চরিত্র, যা হিন্দু রাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করে যে ভারতের ভূখণ্ডে মুসলমান হওয়ার একটি গ্রহণযোগ্য উপায় আছে: ভদ্র, রাষ্ট্র-অনুগত, ভোক্তাবান্ধব দেশপ্রেমিক।
ডানপন্থীরা তাঁকে ঘৃণা করলেও তাঁর বিনয়ী আনুগত্য এবং ‘মুসলিম সোশ্যাল’ চরিত্রে অভিনয়ের প্রবণতা—যেখানে মুসলমানিত্ব সীমাবদ্ধ থাকে পোশাক, রুচি এবং ভদ্রতায়—ভারতের উদার লিবারেলদের সুযোগ দেয় নিজেদের সহনশীল ও প্রগতিশীল ভাবতে। তাঁরা দেখতে চান না—মুসলমানদের প্রতি তাঁদের নিজেদের বিশ্বস্ততার দাবি। যখন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ব রাষ্ট্রশক্তিতে রূপ নেয়, বৃহৎ করপোরেশনদের সঙ্গে একাকার হয়ে—তখন শাহরুখ খান তাঁর অসাধারণ সাফল্যের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছেন।
ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে, ইসরায়েলি কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে—ভাগ করা, নিয়ন্ত্রণ এবং দমন করার জন্য এবং নতুন নীতিতে উপত্যকার জনসংখ্যাগত গঠন পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। যখন ভারত মুসলমানদের জন্য নরকে পরিণত হয়েছে, শাহরুখের নীরবতা আরও গভীর হয়েছে।নীরবতা, সহায়তা আর খলনায়কত্ব২০১৫ সালে, মোদি ক্ষমতায় আসার এক বছর পর এবং ঘৃণা যখন প্রকাশ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে, তখন শাহরুখ খান দেশে ‘অসহিষ্ণুতা বাড়ছে’ বলে সামান্য মন্তব্য করেছিলেন। সেই মানুষ, যার সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে তিনি শ্রেণি, ধর্ম, জাত, ভাষা ও ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে উঠেছেন, তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হলো—আসলে তিনি শুধু একজন ভারতীয় মুসলমান।
বেশি সময় লাগেনি বাস্তবতা স্পষ্ট হতে—তাঁর সম্পদ নির্ভর করছে এই সক্ষমতার ওপর যে তিনি মনোযোগী, নতজানু, বাধ্য মুসলিম শিল্পী হয়ে থাকতে পারেন কি না। এটি ছিল একটি ফাউস্টিয়ান চুক্তি, যা শেষ পর্যন্ত তাঁর জন্য খুবই লাভজনক হয়ে ওঠে।
শাহরুখের প্রযোজনা সংস্থা রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট ক্রমাগত বড় হতে থাকে। তাঁর ক্রিকেট দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের সহ-স্বত্বাধিকারী জুহি চাওলা, যিনি মোদির মুসলমানবিরোধী নীতির কিছু বিষয়ে সমর্থন দিয়েছেন। তাঁদের দল আইপিএলের সবচেয়ে আইকনিক এবং সবচেয়ে লাভজনক দলগুলোর একটি হয়ে ওঠে।
২০১৫ সালের পর কয়েক বছর খান কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি—যে সময়টিকে ‘কঠিন সময়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তারপরও তিনি ভারতের ভোক্তা জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে স্থাপন করার নতুন পথ খুঁজে পান। ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্টের ক্ষেত্রে শাহরুখ খান এখনো সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন মুখ। খান পরিবারের উপস্থিতি দেখা যায় কো-ওয়ার্কিং স্পেস থেকে শুরু করে আর্থিক সেবাতেও।
তিনি তিন ডজনের বেশি পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর—যার অনেকগুলোই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত অথবা ফিলিস্তিন দখলে ভূমিকা রাখার কারণে বয়কট তালিকায় আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতীয় কনগ্লোমারেট টাটা এবং রিলায়েন্স—যাদের ইসরায়েলের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হুন্দাই, যার যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি ভাঙতে।
খান ক্যাস্ট্রল অয়েলেরও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। এই অটোমোটিভ অয়েল ও লুব্রিকেন্ট কোম্পানির মালিক ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি), যাকে গত মার্চে ইসরায়েল ভূমধ্যসাগরে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের লাইসেন্স দিয়েছে।
এ কথা বাড়িয়ে বলা হবে না যে খান অনেক আগেই শুধু অভিনেতা নন। তিনি কেবল একটি ব্র্যান্ডও নন। তিনি একটি সাম্রাজ্য। আর অন্য বিলিয়নিয়ারের মতো, তিনি তাঁর ভাবমূর্তি ধোয়ার জন্য দান-খয়রাতকে ব্যবহার করেন—অ্যাসিড-অ্যাটাক বেঁচে যাওয়া নারীদের সহায়তা, শিশুদের সাক্ষরতা বৃদ্ধি এবং শিশুস্বাস্থ্যসেবাকে সমর্থন করে।
ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস আগস্টে লিখেছিল, ‘তাঁকে ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের ওয়ারেন বাফেট বলা সম্পূর্ণ ভুল হবে না।’ কিন্তু ভক্তরা যখন এখনো তাঁকে তাঁর চরিত্রগুলোর মূল্যবোধ—সাধারণ মানুষ, পরিবার, আনুগত্য, ভালোবাসা—এর সঙ্গে যুক্ত করে, তিনি নিঃশব্দে তাঁদের সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে শোষণকারী শ্রেণির অংশে পরিণত হয়েছেন।
ভক্তদের মাঝে শাহরুখ খানউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চলচ চ ত র ইসর য় ল ম সলম ন স ফল য ইন ড য় চর ত র য কর ছ কর ছ ল সবচ য়
এছাড়াও পড়ুন:
যদি ঠিক পথে থাকো, সময় তোমার পক্ষে কাজ করবে: এফ আর খান
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রায়ই তরুণদের দেখা যায় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ভুগতে। ফলে অনেক সময় যথেষ্ট মেধা, আগ্রহ ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারেন না। তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাতে প্রথম আলো ডটকম ও প্রাইম ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পডকাস্ট শো: লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের সঞ্চালনায় নবম পর্বে অতিথি হিসেবে অংশ নেন বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এফ আর খান। আলোচনার বিষয় ছিল ‘রিয়েল এস্টেটে সততা, বিশ্বাস, পরিবার ও মানবিক মূল্যবোধ।’
‘কাজের ক্ষেত্রে প্রফেশনাল আর সৎ থাকতে হবে। যদি মনে করেন আপনি কোনো কাজে ভালো, তাহলে চেষ্টা কখনো বিফলে যাবে না।’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের উদ্দেশে এ পরামর্শ দেন বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এফ আর খান।
পডকাস্ট শো: লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচে অতিথি হিসেবে এসে তরুণদের এই পরামর্শ দেন তিনি। পডকাস্ট শোর এ পর্বটি গতকাল শনিবার প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রচারিত হয়।
পডকাস্টের শুরুতেই সঞ্চালক প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশে রিয়েল এস্টেট সেক্টর নিয়ে আজ থেকে চার দশক আগে আপনার ধারণা কী ছিল?
উত্তরে এফ আর খান বলেন, ‘১৯৭৯ সালে বুয়েট থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর আমি বুয়েটেই প্রথম কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করি। সে সময় ঢাকায় বেশ কয়েকটি সুপরিচিত ভবনের নকশা করার সুযোগ পাই। কিছুদিন পর আমি মাস্টার্স করার কথা ভাবি, কারণ বুঝেছিলাম—আরেকটি উচ্চতর ডিগ্রি ছাড়া পেশাগতভাবে নিজেকে আরও এগিয়ে নেওয়া কঠিন। সেই সময় স্কলারশিপের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছিল, তাই এর মধ্যেই আইবিএতে ভর্তি হই। সেখানে ম্যানেজমেন্ট ও বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দারুণ এক্সপোজার পাই। এদিকে কিছুদিন পরই বিদেশে পড়ার স্কলারশিপও পেয়ে যাই। দেশে ফিরে এসে আমি ইস্টার্ন হাউজিংয়ে যোগ দিই।’
এফ আর খান আরও বলেন, ‘ইস্টার্ন হাউজিংয়ে যোগ দিয়েই বুঝলাম, আরে, এটা তো দারুণ! এখানে নিজেই নকশা করতে পারি একজন স্ট্রাকচারাল ডিজাইনার হিসেবে, নিজেই সেটি নির্মাণ করতে পারি আবার বিক্রিও করতে পারি। শুধু তা–ই নয়, গ্রাহকের জন্য সার্ভিস এবং বিক্রয়–পরবর্তী সেবা দেওয়ারও সুযোগ আছে। অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়াটিই একধরনের ইকোসিস্টেম, যেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে।’
প্রসঙ্গক্রমে বিটিআইয়ের যাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলে এফ আর খান বলেন, ‘আমি এবং আমার দুজন সহকর্মী মিলে বিটিআই প্রতিষ্ঠা করি। তাঁদের মধ্যে একজন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন। তিনি বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন তিনি পুরো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন। আরেকজন সহকর্মী ছিলেন, যিনি আইবিএ থেকে পড়াশোনা করেন, তিনি মার্কেটিং দেখতেন। আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দায়িত্ব নিই। এভাবেই আমরা ১৯৮৫ সালে বিটিআই শুরু করি।’
এই দীর্ঘ যাত্রায় সবচেয়ে বড় শেখাটা কী ছিল? জানতে চাইলে এফ আর খান বলেন, সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলেই সফলতা আসে। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের বড় শিক্ষা এটিই—যদি তুমি ঠিক পথে থাকো, সময় তোমার পক্ষে কাজ করবে।’
এরপর সঞ্চালক জানতে চান, আপনি বাংলাদেশের ফ্ল্যাট মালিকানা আইন ও মান নিয়ন্ত্রণে যে কাজ করেছেন, সেটার পেছনে অনুপ্রেরণা কী ছিল?
উত্তরে এফ আর খান বলেন, ‘জাপানে পড়তে গিয়ে আমি দেখেছি, ওরা সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্স বেজড সিস্টেমে চলে। এই মানসিকতাই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। দেশে ফিরে দেখি মালিকানা আইন তখনো অস্পষ্ট। আমরা পার্লামেন্টে গিয়ে আইন পাস করাই, যাতে অ্যাপার্টমেন্ট মালিকেরাও জমির আনুপাতিক মালিক হন। পরবর্তী সময়ে ব্যাংক লোন, ইনভেস্টমেন্ট, শেয়ার বণ্টন—সবকিছু আমরা আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে সক্ষম হই।’
আপনি নীতিনিষ্ঠ ব্যবসা নিয়ে সব সময় কথা বলেন। এই নীতি রক্ষা করে ব্যবসা চালানো কতটা কঠিন? জানতে চাইলে এফ আর খান বলেন, এটি কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। অনেক সময় চাপে পড়তে হয়েছে; কিন্তু কখনো শর্টকাট নেননি তিনি। তাঁর মতে, সঠিক পথে চললে লাভ একটু দেরিতে আসে কিন্তু স্থায়ী হয়।
আপনার দাদা এবং আপনার পরিবারের মূল্যবোধ আপনাকে কতটা প্রভাবিত করেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে এফ আর খান বলেন, ‘অত্যন্ত গভীরভাবে। আমার দাদা ছিলেন একজন গণিতজ্ঞ, খুব নীতিমান মানুষ। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে শিখেছি, মানুষকে কীভাবে সম্মান দিতে হয়। এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিটা পরে জাপানে পড়তে গিয়ে আরও গভীর হয়েছে। এই মানসিকতাই আমার ব্যবসার ডিএনএতে আছে। আমার চাচা প্রয়াত ড. ফজলুর রহমান খান, বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার। তিনিও আমার জীবনে অসাধারণ প্রভাব ফেলেছেন। উনিই আমার নাম রেখেছিলেন। উনি ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা। তাঁর কাজ, তাঁর বিনয় আর সৃষ্টিশীলতা আমাকে শিখিয়েছে যে প্রকৌশল মানে কেবল কাঠামো নয়—এটা মূল্যবোধ ও মানবিকতার মেলবন্ধন।’
এই সেক্টরকে অনেকে শুধু মুনাফার ক্ষেত্র হিসেবে দেখে। আপনি কীভাবে ভারসাম্য রাখেন নৈতিকতা ও ব্যবসার মধ্যে? সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের উত্তরে এফ আর খান বলেন, ‘নীতির সঙ্গে ব্যবসা করলে একটি দীর্ঘমেয়াদি আস্থা তৈরি হয়। গ্রাহক যদি বুঝতে পারেন আপনি সৎ, তাহলে তাঁরা বারবার ফিরে আসবেন। আমরা বিটিআইতে এই বিশ্বাসেই কাজ করি।’
সঞ্চালক এ পর্যায়ে বলেন, আজকাল স্মার্ট হোম, টেকনোলজি—এসব নিয়ে আলোচনা হয়। আপনি মানবিক সংবেদনশীলতার কথা বলেন। এই ভারসাম্য কীভাবে দেখেন?
উত্তরে এফ আর খান বলেন, প্রযুক্তি মানুষের জন্য, মানুষ প্রযুক্তির জন্য নয়। আর নিয়ম ও আইনকানুন—সবই তৈরি হয় সমাজ ও মানুষের উন্নতির জন্য। তাই নিয়ম মেনে চললে কিন্তু মানবিকতার জায়গাটা কখনো হারায় না। ক্লায়েন্টের প্রতি সহানুভূতি রাখতে হবে। প্রয়োজনে কঠোরতা থেকে নমনীয়তায় যেতে হবে—এটাই মানবিক দৃষ্টিকোণ।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে সঞ্চালক জানতে চান, আপনার জীবনে কোনো অপূর্ণ ইচ্ছা আছে কি না?
এ বিষয়ে এফ আর খান বলেন, ‘অপূর্ণ ইচ্ছা বলতে চাই না। কারণ, এখনো চেষ্টা করছি এটি নিয়ে এবং আমার বিশ্বাস এটি পূর্ণ হবে। তা হলো অ্যাফোর্ডেবল হাউজিং—সাধারণ মানুষের জন্য বাসস্থান। শুনতে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার মনে হলেও এর পেছনে কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই বললে ভুল হবে। তবে আমি আমার টেকনিক্যাল এবং প্রফেশনাল জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আমাদের কোম্পানিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’