বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান দুই শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এক অবিশ্বাস্য প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার মুখোমুখি। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি নিয়ে তাদের সৃষ্ট প্রতিযোগিতা পৃথিবীকে একটি নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে পারে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক প্রভাব বজায় রাখতে চায়; অন্যদিকে চীন বর্তমান বিশ্ব শাসন ব্যবস্থা ভেঙে নতুন পৃথিবী তৈরি করতে চায়। তাই প্রযুক্তির এই সর্বাধুনিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতা শুধু প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি বৈশ্বিক রাজনীতির ভারসাম্যেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই প্রতিযোগিতার মধ্যে ঝুঁকি ও সম্ভাবনার সমন্বয় ঘটছে। তবে এটি নির্ভর করে বাংলাদেশ কীভাবে এই প্রতিযোগিতাকে নিজের উপকারে ব্যবহার এবং কীভাবে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে পারবে, তার ওপর।

গত ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর চীন যখন নজর কাড়ার মতো এক ঘটনা ঘটায়, তখন তা শুধু মার্কিন অর্থনীতির জন্য শঙ্কা তৈরি করেনি; বরং বৈশ্বিক প্রযুক্তি ভারসাম্যে এক নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করে। রিপোর্ট অনুযায়ী, চীনের তৈরি উন্মুক্ত ভাষা মডেল ডিপসিক সক্ষমতায় মার্কিন চ্যাটজিপিটি৪-এর তুলনায় অগ্রসর এবং কম খরচে তৈরি, যা যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার নাসডাকে ৩.

১ শতাংশ এবং এসঅ্যান্ডপি ৫০০-এ ১.৫ শতাংশ পতন ঘটিয়েছে। শুধু মার্কিন অর্থনীতি নয়; এ ঘটনা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নতুন সংকটে ফেলেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এমন একটি প্রযুক্তি, যা বিশ্বব্যাপী প্রতিটি খাতে বিপ্লব ঘটানোর ক্ষমতা রাখে এবং এ ক্ষেত্রে যে দেশ প্রথম অবস্থানে থাকবে, তার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পারে। ২০১৮ সাল থেকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলতে থাকা বাণিজ্য যুদ্ধ শুধু অর্থনৈতিক না, বরং এটি প্রযুক্তিগত যুদ্ধেও রূপ নেয়। চীন তার প্রযুক্তি খাতকে উৎসাহিত করতে বিনিয়োগ করেছে। যেমন আলিবাবা, টেনসেন্ট ও বাইদুর মতো চীনা কোম্পানি বিশ্বব্যাপী মার্কিন প্রযুক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রও এই চীনা প্রযুক্তি বৃদ্ধির প্রতি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে এবং চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মার্কিন-চীন এআই প্রতিযোগিতা নানাবিধ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের দুটি প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। এই দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার সংকুচিত হতে পারে। আর দ্বিতীয়ত,  বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষি, তৈরি পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। এআই প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে অনেক ঐতিহ্যবাহী চাকরি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। তৃতীয়ত, মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতার ফলে বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে সতর্ক থাকতে হবে। এ দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যে কোনো এক দেশের পক্ষ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়েই বাংলাদেশে তাদের প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা-বিষয়ক প্রভাব বিস্তার করতে চায়, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।  
এটি কিছু সম্ভাবনাও তৈরি করে। প্রথমত, বাংলাদেশ এআই প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে। এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিল্প খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ এআই প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে। তৃতীয়ত, মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতার ফলে বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে সুবিধা আদায় করতে পারে। এ দুই পরাশক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে বাংলাদেশ উভয় পক্ষের কাছ থেকে সহযোগিতা ও বিনিয়োগ পেতে পারে।  

মার্কিন-চীন এআই প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, বাংলাদেশকে এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। তৃতীয়ত, বাংলাদেশকে এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। 
বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন এই প্রতিযোগিতার ঝুঁকি মোকাবিলা করা এবং সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো। এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে, যদি সঠিক কৌশল ও নীতি গ্রহণ করা হয়।

ড. সুজিত কুমার দত্ত: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ল দ শ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

ভোগবাদী যুগে ইসলামে সুখের খোঁজ

আপনার বাড়িতে কি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্তূপ জমে আছে? জানেন কি, এর থেকে মুক্তির পথ আছে ইসলামের সরল জীবনধারায়? আধুনিক বিশ্বে ভোগবাদের তীব্র ঝড়ে আমরা প্রায়ই নিজেদের দেখি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরে।

নতুন ফ্যাশনের পোশাক, সর্বশেষ প্রযুক্তির গ্যাজেট বা মধ্যরাতে এক ক্লিকে কেনা অপ্রয়োজনীয় পণ্য—এসব আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইসলাম আমাদের ন্যূনতম একটি সরল জীবনধারার পথ দেখায়, যা পার্থিব লোভ থেকে মুক্ত করে আমাদের আল্লাহর পথে নিবেদিত হতে উৎসাহিত করে।

আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০সংযম কেন জরুরি

মিনিমালিজম বা ন্যূনতাবাদ এমন একটি জীবনধারা, যেখানে আমরা শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর নির্ভর করব এবং অতিরিক্ত ভোগবিলাস থেকে দূরে থাকব। ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ না হয়ে শুধু যেটুকু না হলেই জীবন চলে না, সেটুকু নিজের কাছে রাখব।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান, প্রত্যেক নামাজের সময় বেশভূষা সৌন্দর্য গ্রহণ করো, খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আ’রাফ, আয়াত: ৩১)।

এই আয়াত আমাদের জীবনে সংযম ও সরলতার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।

আরও পড়ুনদুনিয়ার ভোগ–বিলাস নিয়ে সুরা তাকাসুরের সতর্কতা১০ এপ্রিল ২০২৩

বিজ্ঞাপনের প্রলোভন আজকাল আমাদের অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার দিকে ঠেলে দেয়। প্রায়ই এমন জিনিস কিনে ফেলি, যেমন একটি ইউএসবি মগ হিটার বা জামাকাপড়, যা তারপর বছরের পর বছর অব্যবহৃত পড়ে থাকে।

বাড়িতে জমে থাকে প্যাকেট না খোলা গ্লাস–বক্স, অপঠিত বইয়ের স্তূপ। প্রশ্ন করে দেখি তো, আমাদের আসলেই কি এগুলো প্রয়োজন ছিল?

মহানবী (সা.)-এর সাদাসিধা জীবন

মহানবীজি (সা.) এবং তাঁর সাহাবারা সরল জীবনযাপনের উজ্জ্বল উদাহরণ। হজরত আয়েশা (রা.)-কে নবীজি বলেছিলেন, ‘হে আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো। ধনীদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে সাবধান থাকো এবং কোনো পোশাককে তখনই জীর্ণ হয়ে গেছে মনে করো, যখন তুমি তাতে প্যাঁচ লাগিয়েছ (মানে যখন পুরোনো হয়ে যাওয়ার কারণে পেঁচিয়ে যায়)।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০)।

এই হাদিসে নবীজি (সা.) স্পষ্টভাবে সরল জীবনযাপন এবং অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।

ইসলাম আমাদের শেখায় যে পার্থিব সম্পদ ক্ষণস্থায়ী এবং এটি আমাদের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য প্রস্তুতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। নবীজি (সা.) কখনো অপ্রয়োজনীয় সম্পদ সঞ্চয় করেননি এবং সব সময় দানশীলতার মাধ্যমে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করেছেন।

দানের সংস্কৃতি

আজকের বিশ্বে ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের জীবনকে জটিল করে তুলেছে। ক্রেডিট কার্ড, সহজলভ্য ঋণ এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ করে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, যেমন আমাদের দাদা-দাদিরা, সীমিত সম্পদের মধ্যে সরল জীবন যাপন করতেন। কিন্তু গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আমাদের ভোগবাদী প্রবৃত্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুনখাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা০৯ জুন ২০২৫

কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায়, প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করা লোভ ও কৃপণতার দিকে নিয়ে যায়, যা একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়।

ইসলাম আমাদের জীবনকে সরল করার পাশাপাশি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করে। আমরা চাইলে মাসিক বাজেটের একটি অংশ দানের জন্য বরাদ্দ করতে পারি।

যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪

বিয়ের মতো উৎসবে আমরা বিলাসবহুল আয়োজনের পরিবর্তে সরলতা বেছে নিতে পারি। উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪)।

আমাদের ভালো কাজ এবং দানশীলতা পরকালে যেমন উপকারে আসবে, তেমনি সমাজের জন্যও হবে কল্যাণকর। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দানশীলতার দিকে মনোযোগ দিলে সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জীবন উন্নত হবে।

ভোগবাদী জীবন মানুষকে অস্থির করে তোলে এবং ন্যূনতম খরচের জীবনধারা মানুষকে তৃপ্তির জীবন উপহার দেয়। এটি একই সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনেরও একটি পথ।

আমরা যদি আমাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আল্লাহর পথে ব্যয় করি, তবে তা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। ন্যূনতমবাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রকৃত সুখ পার্থিব সম্পদে নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের প্রস্তুতিতে নিহিত।

আরও পড়ুনআধুনিক এই প্রবণতার শিকড় ইসলামে২০ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ