মিয়ানমারে গত কয়েক দশকের মধ্যে আঘাত হানা অন্যতম বিধ্বংসী ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলছে। রোববার দেশটির সামরিক জান্তা সরকার বলেছে, ভূমিকম্পে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৭০০ জনের প্রাণহানির তথ্য পাওয়া গেছে। আর আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডক্রস বলেছে, সাত দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারে মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। দেশটিতে প্রতি ঘণ্টায় সহায়তার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মিয়ানমারে গত শুক্রবার দুপুরে আঘাত হানা ভয়াবহ এ ভূমিকম্পের প্রভাব পড়েছিল প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ডেও। এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, কম্বোডিয়া ও চীন পর্যন্ত এর কম্পন অনুভূত হয়েছে।

তবে ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মিয়ানমারের প্রাচীন রাজধানী মান্দালয়ে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল সাগাইংয়ের কাছাকাছি ছিল বলেই মান্দালয়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। 

জাতিসংঘের ভূমিকম্প ঝুঁকি মূল্যায়ন অনুসারে, ১৯৩০ সালে মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বাগো ভয়াবহ ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল। ৭ দশমিক ৩ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে ৫৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর পর থেকে দেশটিতে বেশ কয়েকবার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে।

যে কারণে ভূমিকম্পন হয় 

পৃথিবী তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত। এগুলো হলো কোর, ম্যান্টল ও ক্রাস্ট। পৃথিবীর কেন্দ্র হলো কোর। গলিত এই অংশের বেশিরভাগই ধাতব দিয়ে তৈরি। কোরের ওপরের উত্তপ্ত প্রায় কঠিন শিলার স্তর দিয়ে তৈরি ম্যান্টল। আর এর বাইরের বিশেষ আকৃতির ভূতত্ত্বকে বলা হয় ক্রাস্ট। এটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল টেকটনিক প্লেট দিয়ে গঠিত। পিচ্ছিল আবরণের ওপর বিভিন্ন গতিতে এবং বিভিন্ন দিকে এসব টেকটনিক প্লেটের চলাচলের কারণে শক্তি তৈরি করে। টেকটনিক প্লেটগুলো একটির ওপর থেকে আরেকটি সরে গেলে পুঞ্জীভূত শক্তি নির্গত হয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠে কম্পন অনুভূত হয়, যাকে আমরা ভূমিকম্প বলি। যখন এই শক্তি সমুদ্রের নিচে নির্গত হয়, তখন এটি একের পর এক দৈত্যাকার তরঙ্গ তৈরি করে, যাকে আমরা সুনামি বলে জানি।

ইউএসজিএসের ভূকম্পনবিদ উইল ইয়েকের মতে, ভূমিকম্পের মূল ধাক্কার কারণে পৃথিবীর চাপের যে পরিবর্তন হয়, তার কারণে আফটার শক বা পরাঘাত হয়।

কী আছে মিয়ানমারের ভূপৃষ্ঠের নিচে

দুটি টেকটোনিক প্লেট—ভারত ও ইউরেশিয়া প্লেটের মধ্যে মিয়ানমারের অবস্থান, যা দেশটিকে ভূমিকম্পের বিশেষ ঝুঁকিতে ফেলেছে।

এ দুটি প্লেটের মধ্যবর্তী সীমানাকে সাইগং ফল্ট বলা হয়। বিশেষজ্ঞরা এটিকে মিয়ানমারের মান্দালয় ও ইয়াঙ্গুনের মতো শহরগুলোর মধ্য দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার (৭৪৫ মাইল) দীর্ঘ একটি সরলরেখা হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা লাখো মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

ইউএসজিএসের মতে, ভারত ও ইউরেশিয়া প্লেটের মধ্যে ঘর্ষণের কারণে মিয়ানমারে ভূমিকম্প হয়েছিল, যাকে ‘স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্টিং’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

লন্ডনভিত্তিক সায়েন্স মিডিয়া সেন্টারের উদ্ধৃতি দিয়ে ইম্পিরিয়াল কলেজ লন্ডনের টেকটোনিকস বিশেষজ্ঞ ড.

রেবেকা বেল দুটি প্লেটের মধ্যবর্তী সীমানাকে ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের কারণে ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের নর্থরিজে মারাত্মক ভূমিকম্প হয়েছিল।

ড. রেবেকা বেল বলেন, লম্বা ও সোজা প্রকৃতির ফল্টের অর্থ হলো ভূমিকম্প বৃহৎ এলাকাজুড়ে ফাটল তৈরি করতে পারে। আর ফল্টের ক্ষেত্র যত বড় হবে, ভূমিকম্পও তত বড় হবে।

ইউএসজিএস অনুমান করেছে, মিয়ানমারে প্রায় আট লাখ মানুষ ভয়াবহ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বসবাস করছেন। ফলে আগামী দিনগুলোতে মৃতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কতটা ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে

ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল তুলনামূলক কম, মাত্র ১০ কিলোমিটার (ছয় মাইল) গভীরতায়।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়্যাল হলোওয়ের আর্থ সায়েন্সেস বিভাগের ড. ইয়ান ওয়াটকিনসনকে উদ্ধৃত করে সায়েন্স মিডিয়া সেন্টার জানিয়েছে, অগভীর ভূমিকম্প অনেক বেশি ক্ষতি করতে পারে। কারণ, ‘গভীরতা থেকে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছানো পর্যন্ত ভূমিকম্পের শক্তি খুব বেশি নষ্ট হয় না।’

ক্যালিফোর্নিয়া, জাপানসহ বিশ্বের সক্রিয় ফল্টলাইন বরাবর কিছু অঞ্চলে ভূমিকম্প সহনীয় বিল্ডিং কোড তৈরি করা হলেও শুক্রবারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের অবকাঠামো অপেক্ষাকৃত কম ভূমিকম্প সহনীয় ছিল।

ওয়াটকিনসন বলেছেন, শুক্রবারের ভূমিকম্প ২০২৩ সালে দক্ষিণ তুরস্কে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের মতো ক্ষয়ক্ষতি করতে পারত। বছরের পর বছর অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণের কারণে ওই ভূমিকম্পে অনেক ভবন ভেঙে পড়েছিল।

সূত্র: আল জাজিরা 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ ম কম প র র ভ ম কম প ভ ম কম প র ফল ট র

এছাড়াও পড়ুন:

আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে নিহত বেড়ে ২০, আহত তিন শতাধিক

উত্তর আফগানিস্তানে ৬ দশমিক ৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ২০ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রায় ৩২০ জন আহত হয়েছেন। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য  জানিয়েছে। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।

মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শরাফাত জামান আজ সোমবার এক ভিডিও বার্তায় বলেন, বালখ এবং সামাঙ্গান প্রদেশে প্রাথমিকভাবে নিহত ও আহতের সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।

আরো পড়ুন:

ভূমি অফিসকে আস্থার প্রতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে: সিনিয়র সচিব

ফিলিপাইনে শক্তিশালী ভূমিকম্পে নিহত বেড়ে ৬৯

ক্ষতি প্রত্যক্ষকারী এএফপির সাংবাদিকের মতে, ভূমিকম্পে ১৫ শতকের স্মৃতিস্তম্ভ মাজার-ই-শরিফের নীল মসজিদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল আফগানিস্তানের খুলম থেকে ২২ কিলোমিটার (১৪ মাইল) পশ্চিম-দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং ২৮ কিলোমিটার গভীরে। স্থানীয় সময় রাত ১২ টা ৫৯ মিনিটে এটি আঘাত হানে বলে জানিয়েছে ইউএসজিএস।

আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় বলেছে, উদ্ধার ও জরুরি সহায়তা দলগুলো বালখ এবং সামাঙ্গান প্রদেশের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছেছে। আহতদের স্থানান্তর ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তাসহ উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, ভূমিকম্পে মাজার-ই-শরিফের নীল মসজিদ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এএফপি জানিয়েছে, অলঙ্কৃত কাঠামোর টুকরো, বিশেষ করে এর একটি মিনার ভেঙে মাটিতে পড়ে গেছে।

শতাব্দী প্রাচীন এই স্থানটি আফগানিস্তানের সবচেয়ে সম্মানিত ধর্মীয় নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি এবং ইসলামিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবের সময় একটি প্রধান সমাবেশস্থল। এটি দেশটির কয়েকটি পর্যটন স্থানের মধ্যে একটি।

রাজধানী কাবুল এবং আফগানিস্তানের আরো কয়েকটি প্রদেশেও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, পাহাড় থেকে পাথর পড়ার কারণে কাবুলের সঙ্গে মাজার-ই-শরিফের সংযোগকারী একটি প্রধান মহাসড়ক কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, তবে পরে রাস্তাটি পুনরায় খুলে দেওয়া হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগানিস্তান ধারাবাহিকভাবে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশটি প্রায়শই এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় অসুবিধার সম্মুখীন হয়, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

গত ৩১ আগস্ট পাকিস্তান সীমান্তের কাছে পূর্ব আফগানিস্তানে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ২ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। তালেবান সরকারের মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ৬ দশমিক ৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প এবং তার পরে শক্তিশালী আফটারশকে কমপক্ষে চার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে নিহত বেড়ে ২০, আহত তিন শতাধিক
  • আফগানিস্তানে মধ্যরাতে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাত