ভারতের বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা, নেতিবাচক প্রচার-প্রপাগান্ডা এবং মাঝেমধ্যেই সামরিক হুমকি-ধমকি, বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার আগ্রাসী প্রবণতা এবং বাংলাদেশবিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার কর্মীকে অবৈধভাবে ভারতে আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া, এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার সামর্থ্য কোনো একক রাজনৈতিক দলের নেই। কোনো একক রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেও সর্বগ্রাসী এই সুনামি রুখে দেওয়া কঠিন হবে। হয় তারা ভারতের হাতের পুতুল হয়ে আগের সরকারের মতো আত্মঘাতী চুক্তি সই করবে, বাংলাদেশকে ভারতের একচেটিয়া বাজারে পরিণত করবে অথবা কঠোর হতে গিয়ে ব্যর্থ সরকারে পর্যবসিত হবে। এমন শক্তি মোকাবিলা করার জন্য দরকার সুদৃঢ় দেশপ্রেম, জাতীয় ঐক্য এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিশ্ববরেণ্য কোনো ব্যক্তির নেতৃত্ব। 

 

আজ বাংলাদেশের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্বে প্রফেসর ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি না থেকে অন্য যে কেউ থাকলে বাংলাদেশকে উগ্র মৌলবাদী দেশের তালিকায় ফেলে দেওয়া হতো। এই লক্ষ্যে ভারতের মদদে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন, কিন্তু ড. ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং সততার কাছে সব খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে। বিশ্বনেতারা ড. ইউনূসের কথা কখনোই অবিশ্বাস করেন না। তিনি যা বলেন তা-ই তারা গ্রহণ করেন। এটি আমাদের বড় সৌভাগ্য।

 

এবার রমজানে সম্ভবত গত ৫৪ বছরের বাংলাদেশে এই প্রথম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কমেছে, মানুষ স্বস্তিতে আছে। এখানেও আওয়ামী লীগের কর্মীরা সরকারের সততা ও আন্তরিকতার প্রশংসা না করে সমালোচনা করছেন। বলছেন, এত দাম কমে গেলে কৃষক মারা যাবে। কেউ বলছেন, এ বছর মার্চে রোজা হওয়ায় শীতের সবজি এখনও বাজারে আছে, উৎপাদনের মৌসুমে রোজা হয়েছে বলেই কৃষিপণ্যের দাম কম। কিন্তু মার্চ মাসে তো রোজা আরও হয়েছে, প্রতি ৩৫-৩৬ বছরে একবার রোজা পুরো বছর ঘুরে আবার আগের জায়গায় আসে। কই আর কখনও তো এমন হয়নি। 

দাম কমার কারণ দুটি। প্রথমত, কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াত যেসব মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যাবসায়ী-সিন্ডিকেট, সেটা ভেঙে পড়েছে। সরকারের সততা এবং সদিচ্ছার কারণেই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি খুব ইন্টারেস্টিং, এটা কেউ ভেবে দেখেননি। রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় থাকে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে, মানুষের হাতে ছিল মাত্রাতিরিক্ত অবৈধ অর্থ। এই অবৈধ অর্থের একটা আগ্রাসী ক্রয়ক্ষমতা প্রতিফলিত হতো বাজারে। দুর্নীতি কমে আসায় কৃত্রিম চাহিদা এখন বাজারে অনুপস্থিত। কৃষিপণ্যের দাম কমে গেছে, কৃষক মরে যাচ্ছে– এই হা-হুতাশ যারা করেন, তাদের জন্য বলি, আগেও আমরা দেখেছি কৃষক মাথায় করে বাজারে এক টুকরি টমেটো এনেছে, বিক্রি করতে না পেরে বাজারেই ঢেলে ফেলে দিয়ে গেছে, কারণ দাম এত কম যে বোঝা বয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিতেও চায়নি তারা। তখনও কিন্তু শহরের বাজারগুলোতে টমেটোর দাম কমেনি। কারণ মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের দাপট ছিল তীব্র।


আওয়ামী লীগ দাবি করে তাদের ও অঙ্গসংগঠনের কর্মী সংখ্যা কোটির ওপরে। হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাসহ প্রায় ৪৫ হাজার নেতাকর্মী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অধিকাংশই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই ৪৫ হাজারের সঙ্গে আরও অনেকেই অদূর ভবিষ্যতে যুক্ত হবেন। তাদের ভারত প্রশিক্ষণ দিয়ে এমনভাবে তৈরি করবে, যাতে তারা আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় বসাতে পারে। দেশের ভেতরে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মীরা ক্রমাগত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করবেন। অতীতের মতো কখনও বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়বেন, কখনও লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালাবেন, শাহবাগী গ্রুপ, ব্লগার গ্রুপ তৈরি করবেন, কখনও ভবনে আগুন দেবেন। এসব নাশকতামূলক কাজ তারা করতেই থাকবেন। এই দ্বিমুখী অরাজকতা এবং দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড মোকাবিলা করা কোনো একক রাজনৈতিক দলের সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। 

ঠিক এ রকম এক সময়ে আমাদের দুটি কাজ করতে হবে। সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তির একটি ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি চীন এবং অন্যান্য বৃহৎ শক্তির সঙ্গে কৌশলগত কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে। 

 

বৃহৎ ঐক্য টেকসই হবে তখনই যখন ঐক্যবদ্ধ শক্তির সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হবে। এই মুহূর্তে যদি নির্বাচন হয় এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদি একটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তাহলে ঐক্য ধরে রাখা যাবে না। এমনকি কোনো জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করার পরেও এই ঐক্য টিকবে না। টেকসই ঐক্য গড়তে হবে একটি জাতীয় সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে।

 

আমার প্রস্তাব হলো, সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল এক হয়ে আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা হোক। সেই সরকারের রাষ্ট্রপতি থাকবেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি থেকে প্রধানমন্ত্রীসহ ১৫ জন, জামায়াতে ইসলামী থেকে ১০ জন, এনসিপি থেকে ১০ জন, অন্যান্য দল থেকে ১৫ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী থাকবেন। এই ৫০ জনের ক্যাবিনেট আগামী পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এবং সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করবে। মন্ত্রিপরিষদের ওপরে একটি সুপ্রিম কাউন্সিল থাকবে। প্রতিটি জেলা থেকে দু’জন প্রতিনিধি, সব রাজনৈতিক দল থেকে মন্ত্রিপরিষদের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশপ্রধানকে নিয়ে গঠিত হবে সুপ্রিম কাউন্সিল। এই কাউন্সিল জাতীয় সরকারে পার্লামেন্টের ভূমিকা পালন করবে। তবে শুধু রুটিন কাজের বাইরে রাষ্ট্রীয় বড় ইস্যুগুলোতে সুপ্রিম কাউন্সিল মিটিংয়ে বসবে এবং সিদ্ধান্ত নেবে। 

 

এই পাঁচ বছরের মধ্যে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে হত্যকাণ্ড ঘটানোসহ তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা এবং খুন, গুম, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ সব অপরাধের বিচার করাও সম্ভব হবে। এরপর একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বাংলাদেশে পুনরায় পার্টি পলিটিকস শুরু করা যাবে। 

 

এই পাঁচ বছরে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করে একটি নৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো যাবে, বিদেশ নীতিও একটি সুস্পষ্ট ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় উঠে যাবে।

কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি ও জাতিসংঘ কর্মকর্তা


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ষমত ক ষমত য় সরক র র ইউন স র দ ম কম মন ত র র কর ম চ বছর র ওপর আওয় ম বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’

এবারের বাবা দিবস আমার কাছে একটু অন্যরকম। চারপাশ যেন কিছুটা বেশি নিস্তব্ধ, হৃদয়ের ভেতর যেন একটু বেশি শূন্যতা। কারণ এবার প্রথমবারের মতো আমার আব্বাকে ছাড়াই কাটছে দিনটি। আব্বা চলে গেছেন গত জানুয়ারিতে। ফলে বাবা দিবস এখন আর কেবল উদযাপনের দিন নয়– এটি হয়ে উঠেছে স্মরণ, অনুধাবন ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উপলক্ষ। আব্বা না থেকেও আছেন, তবে এক ভিন্ন অনুভবে– আমার নীরব নিঃশব্দ অভিভাবক হয়ে।    

আমাদের সমাজে কিংবা বলা যায় পারিবারিক সংস্কৃতির বাবারা সবসময় প্রকাশের ভাষায় ভালোবাসা বোঝান না। তাদের স্নেহ, দায়িত্ববোধ ও নিবেদন অনেক সময়েই নীরব থাকে, তবে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। আমার আব্বাও ছিলেন তেমনই একজন। আব্বা ছিলেন আমার দিকনির্দেশক, আমার রক্ষাকবচ, আমার জীবনপথের চুপচাপ ভরসা। 

আব্বার অ্যাজমা ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতেন, আমাদের প্রতিও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আমি কিংবা আমার মেয়ে সামান্য অসুস্থ হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর যখন ৭৯ বছর বয়স, তখনও আমি ডাক্তারের কাছে একা যেতে গেলে বলতেন, ‘তুমি একা যাবে কেন? আমি যাচ্ছি।’ এই কথা বলার মানুষটাকে প্রতি পদে পদে আমার মনে পড়ে, যেন দূর থেকে দেখছেন সবই। আর আমিও তাঁর কনুই-আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছি জীবনের পথে।    

আব্বা ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ধার্মিক মানুষ। শৈশব থেকে নামাজের গুরুত্ব তিনি আমার মধ্যে গভীরভাবে বপন করার চেষ্টা করে গেছেন। কখনও নরম সুরে, আবার কখনও খুব জোর গলায়। তখন মনে হতো তিনি চাপ দিচ্ছেন; কিন্তু এখন তাঁর অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতায় আমি সেই কণ্ঠস্বরের জন্য আকুল হই।

অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে কিংবা আত্মীয়ের বা বন্ধুর বাসায় গেলে বাবার ফোন আসত, ‘কোথায়? কখন ফিরবি?’ সেসব ফোন একসময় মনে হতো আব্বার বাড়াবাড়ি। এখন মনে হয়, একটাবার হলেও যদি ফোনে তাঁর নামটা দেখতাম! ছোট ছোট এসব প্রশ্ন– এই উদ্বেগই তো ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। এগুলোই ছিল বাবার নিজের মতো করে যত্ন নেওয়ার ভাষা। সেই ভাষাটাই আজ আর শোনা যায় না। আব্বা নেই, এখন জীবনযাপনে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।

আব্বা ছিলেন একজন ব্যাংকার। হয়তো চেয়েছিলেন আমি তাঁর পেশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। কিন্তু কোনোদিন চাপ দেননি। বরং নিজের ইচ্ছেমতো পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। আব্বাই আমাকে নিজের ওপর আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন। বিয়ে করেছি, বাবা হয়েছি, নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়েছি– তবুও বাবার সেই গাইডেন্স কখনও ফুরায়নি। আব্বা কখনও অর্থ বা অন্য কোনো সহায়তার কথা বলেননি; বরং সবসময় নিজে থেকেই পাশে থেকেছেন। মনে পড়ে, একবার মেয়ের অসুস্থতার সময় আমি অর্থকষ্টে ছিলাম, কিছু বলিনি তাঁকে। কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন, পাশে থেকেছেন।

এখন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে হয়, ‘বাবা হলে কী করতেন?’ তাঁর শিক্ষা, অভ্যাস, স্নেহ– সবকিছু এখন আমার আচরণে, আমার সিদ্ধান্তে, আমার ভালোবাসায় প্রতিফলিত হয়। তাঁকে ছুঁতে না পারলেও আমি প্রতিদিন তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি– স্মৃতিতে, নৈঃশব্দ্যে, নানা রকম ছোট ছোট মুহূর্তে।

এই বাবা দিবসে আব্বার কোনো ফোন আসবে না, থাকবে না কোনো উপহার বা আলিঙ্গনের মুহূর্ত; যা আছে সেটি হলো আব্বার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসা। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সন্তানদের শুধু দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চাননি কখনোই। তাঁর জীবনদর্শন আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি– এগুলোই নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হয়তো পুরোপুরি পারছি না; কিন্তু আমার মনে হয় এ চেষ্টাটাই আমার জীবনে শৃঙ্খলা এনেছে।

বাবাকে হারানোর শোক যেমন গভীর, তেমনি গভীর তাঁর রেখে যাওয়া ভালোবাসা। নিজের অনুভবকে চাপা না দিয়ে, বরং বাবাকে নিজের ভেতরে জায়গা দিন। বাবার কথা বলুন, তাঁর শেখানো পথে হাঁটুন। কারণ প্রিয় মানুষরা চলে যান বটে, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা থেকে যায় সবসময়।

লেখক: কমিউনিকেশনস প্রফেশনাল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’
  • বর্ষার শুরুতেই সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টির বার্তা
  • টানা সাত দিন সারাদেশে বৃষ্টি ঝরবে