নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অস্পষ্টতা কতটা কাটল
Published: 15th, April 2025 GMT
ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন, নাকি আগামী বছর জুনের মধ্যে– এ নিয়ে সংশয় আছে এখনও। তা সত্ত্বেও প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে এ সময়সীমার বাইরে ক্ষমতায় না থাকার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত হওয়া স্বস্তির। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সঙ্গে বৈঠকে তিনি ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের আগে সংস্কার কাজ দ্রুত সম্পন্নের তাগিদ দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ঘিরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে দেখা গেল, তিনি আগের ঘোষণাতেই অটল। অর্থাৎ ‘কম সংস্কার’ হলে ডিসেম্বর; ‘অধিকতর সংস্কার’ হলে আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ভুল স্বীকার করলেও তার সমালোচনা হয়েছে। কারণ নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে তিনি সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলবেন, এমন দাবি এখন আরও জোরালো। মাঝে কোনো কোনো সাক্ষাৎকার ও সভায় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিক ইচ্ছার কথা তিনি জানিয়েছিলেন। এ অবস্থায় প্রেস উইংয়ের প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আসায় লোকে ‘নতুন কিছু’ পেয়েছে বলে ধরে নিয়েছিল। সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে স্বভাবতই হতাশ হয় তারা। প্রশ্ন ওঠে, প্রধান উপদেষ্টা কি নিজে তাঁর বক্তব্য বদলেছেন, নাকি অন্য কিছু ঘটেছে?
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বসে প্রধান উপদেষ্টা আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন করার লক্ষ্যে কাজকর্ম গুছিয়ে নেওয়ার কথা বললেও সেটা গুরুত্ববহ। কেননা, এর মধ্যে ফেসবুক থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়াজ উঠেছে– রোডম্যাপের বাইরেও অন্তর্বর্তী সরকারের থাকা প্রয়োজন। তার সপক্ষে হচ্ছে তত্ত্বায়ন। এর মধ্যে রয়েছে গণঅভ্যুত্থানের সরকারকে নির্বাচিত সরকারের চাইতেও মর্যাদাসম্পন্ন করে দেখানো। উপদেষ্টাদেরও কেউ কেউ বিভিন্ন উপলক্ষে এমনভাবে কথাবার্তা বলছেন; তাতে মনে হচ্ছে, দুইয়ের যোগসূত্র রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আশা করা হচ্ছিল, প্রধান উপদেষ্টা নিজে স্পষ্ট করে কিছু বলবেন। সে কারণে তাঁর এ বক্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ– আগের ঘোষণামতোই আগামী জুনের পর সরকারটি আর থাকছে না।
গণঅভ্যুত্থানের পর যে পরিস্থিতিতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেটা ছিল তাঁর দিক থেকে সাহসী পদক্ষেপ। যাদের কথায় তিনি এমন দায়িত্ব গ্রহণে রাজি হন, তারাও সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। এতে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিতর্ক বেড়েছে ক্রমে। সরকারে থেকে তাদের রাজনৈতিক দল গঠন হয়েছে বিশেষভাবে বিতর্কিত। এই ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার কিছু বক্তব্যেও বেড়েছে সমালোচনা। তদুপরি উপদেষ্টা পরিষদের ‘পারফরম্যান্স’ নিয়ে সন্তুষ্টি বেশি নেই। আট মাস পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার না হওয়ার কথা স্বীকার করা হচ্ছে সরকারিভাবেই। সামনে রয়েছে গ্রহণযোগ্য বাজেট প্রণয়নের চ্যালেঞ্জ। আগামী বছর জুন পর্যন্ত থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারকেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। তার তো বিচার আর সংস্কারের এজেন্ডাও রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা জোগানোও চ্যালেঞ্জিং।
ভারতের বক্তব্য না হয় আলাদাভাবে বিবেচ্য। এর বাইরে যারা আমাদের ‘উন্নয়ন সহযোগী’ বলে পরিচিত, তারাও কি যথাসম্ভব দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণের তাগাদা দিচ্ছে না? দেশে যে বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল, সেখান থেকে প্রাপ্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেও কি সুনির্দিষ্ট মেয়াদের সরকার থাকা জরুরি নয়? দৃঢ়ভাবে জনপ্রশাসন পরিচালনায়ও নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে কার্যত পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। থেমে থেমে এখনও চলছে ‘মব ভায়োলেন্স’। বিনিয়োগ সম্মেলন চলাকালে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানে যেসব হামলা হয়েছে, সেটাও দেশের ভাবমূর্তির জন্য নেতিবাচক। এতদিন পরও কেন সরকার এসব বন্ধ করতে পারছে না– তার সদুত্তর নেই। এ অবস্থায় ভালো হতো ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হলে। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন সরকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা। যতদূর জানা যায়, নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা ধরে নিয়েই কাজকর্ম গোছাচ্ছে। সরকারের দিক থেকে তেমন ‘ইঙ্গিত’ তারা পেয়েছে বলেই অনেকের ধারণা। এমনও হতে পারে, তারা যে কোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি রাখতে চায়। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কাজেও কিছু সংস্কারের প্রশ্ন রয়েছে। ন্যূনতম যেটুকু সবাই চাইছে, তা হলো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। আগামীতে নির্বাচন যেন কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্যই এটা চাওয়া। দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছিল বলেই অপশাসন ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল– এটা কার না জানা! গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হাতবদল হতে থাকলেও দেশ গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতিতে উপনীত হতো– এমনটা কেউ বলছেন না। সে কারণেই ‘জরুরি সংস্কার’ সেরে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনেই সরকারকে মনোনিবেশ করতে হবে। কোনো সংস্কার করতে না পারলেও তাকে কেউ দায়ী করবে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে না পারলে ইউনূস সরকার হয়ে থাকবে প্রশ্নবিদ্ধ। দেশও অধিকতর সংকটে নিপতিত হবে।
অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের এসব মনে করিয়ে দেওয়ার অবশ্য কিছু নেই। তারা দেশের সম্মানিত ও যোগ্য নাগরিক। বিদেশ থেকেও এক দল বাছাইকৃত মানুষ এসে এই ক্রান্তিকালে ইউনূস সাহেবের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা নিয়ে কম মানুষের মনেই সন্দেহ আছে। নজিরবিহীন জটিল পরিস্থিতিতে এ টিমের কাছে প্রত্যাশাও সীমিত। এ অবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা তৈরি করে ব্যর্থ হওয়া কারও জন্য ভালো হবে না। দেশের জন্য সেটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়েরও আগে রাজনৈতিক সংলাপ সেরে সংস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে দ্রুত এর বাস্তবায়নই কাম্য। ‘প্রয়োজনীয় সব সংস্কার’ কোনো সরকারের আমলেই করা সম্ভবপর হবে না। এ নিয়ে বিতর্কও চলতে থাকবে। সব সংস্কার টেকসই হবে, এমনও নয়। মানসম্মত বিধিবিধানের দেশেও কিন্তু সুশাসন আর গণতন্ত্রের অবনমন হচ্ছে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়ে প্রত্যাশিত সবকিছু করিয়ে নিয়ে চিরদিনের জন্য নিরাপদ থাকার সুযোগ কার্যত অনুপস্থিত। রাজনৈতিক দলগুলোকেই বরং বেশি দায়বদ্ধ করা দরকার রাষ্ট্র সংস্কারে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায় হলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে এর অনুকূল পরিবেশ করে দেওয়া। নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এ ক্ষেত্রে তাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।
নির্বাচিত সরকার সংস্কারের কিছুই করবে না– এমন আশঙ্কা কি রয়েছে, নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের পরও? যদি থাকে তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার করে গেলেও তারা সেগুলো অক্ষত রাখবে না। তাই এসব অহেতুক প্রশ্ন না তুলে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষেই অবস্থান নিতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার উচিত তাঁর সহকর্মী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে নির্বাচনের সময়সীমা চূড়ান্ত করে ফেলা। এর মধ্যে বিচার ও সংস্কার কার্যক্রম যেটুকু এগিয়ে নেওয়া যায়, সেটাও দৃঢ়তার সঙ্গে করা। এ অবস্থান নিতে পারলে তার প্রভাব পড়বে গোটা শাসন পরিস্থিতিতে। অস্বস্তি কাটবে সংশ্লিষ্ট সব মহলে। অর্থনীতি আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও আসবে
কাঙ্ক্ষিত গতি।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন র পর স থ ত ত র জন ত ক বছর জ ন সরক র র ন র সময এ অবস থ ন র পর ক র কর ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
জামায়াত-এনসিপি নাখোশ
শুধু বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করায় অসন্তুষ্ট জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনও। অন্যদিকে বৈঠককে ইতিবাচক উল্লেখ করে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশ এলডিপি, খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি দল।
জামায়াতে ইসলামী এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে দলটির এক শীর্ষ নেতা সমকালকে বলেছেন, শুধু বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্য দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে অবমূল্যায়ন ও ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। সর্বদলীয় আলোচনায় নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করা উচিত ছিল।
এনসিপি বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপির বর্ধিতাংশে পরিণত হয়েছে। তারা নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। এ অবস্থায় সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা– সংশয় রয়েছে।
গতকাল শুক্রবার লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দেন তারেক রহমান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ২০২৬ সালের রমজান শুরুর আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।
এর আগে সংস্কার ও বিচারের অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
আগামী বছরের ১৭ বা ১৮ ফেব্রুয়ারি পবিত্র রমজান শুরু হবে। লন্ডন বৈঠকের যৌথ বিবৃতির পর ধারণা করা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট হতে পারে। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। গত ৬ জুন তিনি আরেক ভাষণে জানান, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে।
এপ্রিলে তাপপ্রবাহ, পাবলিক পরীক্ষাসহ নানা কারণ দেখিয়ে বিএনপি ও তাদের সমমনারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিএনপি আগের অবস্থান থেকে সরে রমজানের আগে বা ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভোট চেয়েছে লন্ডনের বৈঠকে।
বিএনপিকে ‘তোয়াজে ক্ষুব্ধ’ জামায়াত
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান গত এপ্রিলে দাবি করেছিলেন, রমজানের আগেই যেন ভোট গ্রহণ হয়। পরে দলটি অবস্থান নেয় ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের। প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে স্বাগত জানায় জামায়াত।
ড. ইউনূস-তারেক বৈঠক নিয়ে আগে থেকেই নীরব বিএনপির নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার চেষ্টায় থাকা জামায়াত।
জামায়াতের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা গত রাতে সমকালকে বলেন, জামায়াতই প্রথম বলেছে, রমজানের আগে নির্বাচন হওয়া উচিত। তাই নির্বাচনের যে নতুন সময়সীমা বলা হচ্ছে, এ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু সরকার যেভাবে শুধু বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে সময়সীমা নির্ধারণ করেছে, তা অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, বিএনপিকে তোয়াজ করতে লল্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে– ঠিক আছে। কিন্তু আলোচনার পর ঢাকায় সর্বদলীয় বৈঠক করে রমজানের আগে ভোটের ঘোষণা দিলে সব দল এবং সরকারের জন্য ভালো হতো। লন্ডন বৈঠকের পর ঘোষণা দেওয়ায় মানুষের কাছে বার্তা গেল– বিএনপিই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি। বিএনপির কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবে ইউনূস সরকার। এ বার্তার কারণে অন্য দলগুলো নির্বাচনের মাঠে প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিবন্ধকতায় পড়বে। তিনি বলেন, এক-এগারো সরকারের তথাকথিত ‘সেফ এক্সিট’ পরিকল্পনার কারণেই ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ অস্বাভাবিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।
সরকার ও বিএনপির যৌথ বিবৃতি নিয়েও নাখোশ জামায়াত। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, এর মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে– সরকার এবং বিএনপি সমশক্তি। এর পর আর সরকারের নিরপেক্ষতা থাকে না। এ বক্তব্য ড. ইউনূসকে জানাবে জামায়াত।
লন্ডনের বৈঠক নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সমকালকে বলেন, জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় বক্তব্য জানাবে।
সরকার বিএনপির হয়ে গেছে– অভিমত এনসিপির
লন্ডনে বসে বাংলাদেশের নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি সমকালকে বলেন, শুধু বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারিত হতে পারে না। এর মাধ্যমে সরকার বিএনপির প্রতি ঝুঁকে গেছে। তাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা– এ প্রশ্নও উঠবে।
এনসিপি আনুপাতিক পদ্ধতির সংসদীয় উচ্চকক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসসহ ‘মৌলিক সংস্কার’ কার্যক্রমে জোর দিচ্ছে। নাসীরুদ্দীন বলেছেন, এনসিপি নির্বাচনের বিরোধী নয়। কিন্তু মৌলিক সংস্কার, জুলাই গণহত্যার বিচারে কোনো বার্তা নেই। একটি দলকে খুশি করতে সংস্কার; বিচারের চেয়ে নির্বাচনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা গণঅভ্যুত্থান চেষ্টার সঙ্গে যায় না।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যখন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছে, সেই সময়ে বিদেশে একটি দল বা ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত।
গত রাতে এক বিবৃতিতে এনসিপি বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন-সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। এসব ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণঅভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পরিণত এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের জনআকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে।
‘যৌথ বিবৃতি’ নিয়ে প্রশ্ন ইসলামী আন্দোলনের
সরকার-বিএনপির বৈঠককে সমঝোতার জন্য ইতিবাচক আখ্যা দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন। দলটি নির্বাচনের সময়সীমা বিষয়ে অবস্থান পুনর্বিবেচনার জন্য ড. ইউনূস এবং তারেক রহমানকে ধন্যবাদ জানালেও যৌথ বিবৃতির সমালোচনা করেছে।
সংস্কার, বিচার ও জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপির নীতিগত সমর্থনকে স্বাগত জানিয়ে দলটির মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বিবৃতিতে বলেছেন, ড. ইউনূস সরকারপ্রধান, তারেক রহমান একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। তারেক রহমান দেশের রাজনীতির একক প্রতিনিধিত্ব করেন না। বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ হলেও সরকারপ্রধানের সঙ্গে একজন রাজনৈতিক নেতার সংলাপকে যৌথ বিবৃতি আখ্যা দেওয়া বিস্ময়কর! বিএনপির একক মতামতের ভিত্তিতে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণও শোভনীয় নয়।
অন্যরা স্বাগত জানিয়েছে
বিএনপির সমমনা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বিবৃতিতে বৈঠককে ঐকমত্যের সূচনা আখ্যা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন। মৌলিক সংস্কারের জন্য দ্রুত জাতীয় সনদ প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে জেএসডি। নির্বাচন এগিয়ে আনার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, ‘কয়েকজন উপদেষ্টা ও বিএনপি নেতার অপরিণামদর্শী বক্তব্য সরকার এবং দলটির মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে তুলছিল। লন্ডন বৈঠকে তা আপাতত কাটল।’ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠা দূর হয়ে সমঝোতার পথ তৈরি হয়েছে।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বিচার ও সংস্কারে অগ্রগতি অর্জনের আলোচনা ইতিবাচক। এখন এসব বিষয় জাতীয় ঐকমত্য তৈরিতে মনোযোগ পাবে বলে আশা করি।
বিএনপির সমমনা ১২ দলীয় জোট বিবৃতিতে বলেছে, জাতির জন্য স্বস্তির বার্তা এনেছে লন্ডন বৈঠকের যৌথ বিবৃতি। স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ, হেফাজতে ইসলামের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব প্রমুখ।
যদিও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়েছে; দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে সমকালকে বলেন, বিচারের অগ্রগতি ও সংস্কার করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব।