নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অস্পষ্টতা কতটা কাটল
Published: 15th, April 2025 GMT
ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন, নাকি আগামী বছর জুনের মধ্যে– এ নিয়ে সংশয় আছে এখনও। তা সত্ত্বেও প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে এ সময়সীমার বাইরে ক্ষমতায় না থাকার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত হওয়া স্বস্তির। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সঙ্গে বৈঠকে তিনি ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের আগে সংস্কার কাজ দ্রুত সম্পন্নের তাগিদ দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ঘিরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে দেখা গেল, তিনি আগের ঘোষণাতেই অটল। অর্থাৎ ‘কম সংস্কার’ হলে ডিসেম্বর; ‘অধিকতর সংস্কার’ হলে আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ভুল স্বীকার করলেও তার সমালোচনা হয়েছে। কারণ নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে তিনি সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলবেন, এমন দাবি এখন আরও জোরালো। মাঝে কোনো কোনো সাক্ষাৎকার ও সভায় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিক ইচ্ছার কথা তিনি জানিয়েছিলেন। এ অবস্থায় প্রেস উইংয়ের প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আসায় লোকে ‘নতুন কিছু’ পেয়েছে বলে ধরে নিয়েছিল। সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে স্বভাবতই হতাশ হয় তারা। প্রশ্ন ওঠে, প্রধান উপদেষ্টা কি নিজে তাঁর বক্তব্য বদলেছেন, নাকি অন্য কিছু ঘটেছে?
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বসে প্রধান উপদেষ্টা আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন করার লক্ষ্যে কাজকর্ম গুছিয়ে নেওয়ার কথা বললেও সেটা গুরুত্ববহ। কেননা, এর মধ্যে ফেসবুক থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়াজ উঠেছে– রোডম্যাপের বাইরেও অন্তর্বর্তী সরকারের থাকা প্রয়োজন। তার সপক্ষে হচ্ছে তত্ত্বায়ন। এর মধ্যে রয়েছে গণঅভ্যুত্থানের সরকারকে নির্বাচিত সরকারের চাইতেও মর্যাদাসম্পন্ন করে দেখানো। উপদেষ্টাদেরও কেউ কেউ বিভিন্ন উপলক্ষে এমনভাবে কথাবার্তা বলছেন; তাতে মনে হচ্ছে, দুইয়ের যোগসূত্র রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আশা করা হচ্ছিল, প্রধান উপদেষ্টা নিজে স্পষ্ট করে কিছু বলবেন। সে কারণে তাঁর এ বক্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ– আগের ঘোষণামতোই আগামী জুনের পর সরকারটি আর থাকছে না।
গণঅভ্যুত্থানের পর যে পরিস্থিতিতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেটা ছিল তাঁর দিক থেকে সাহসী পদক্ষেপ। যাদের কথায় তিনি এমন দায়িত্ব গ্রহণে রাজি হন, তারাও সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। এতে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিতর্ক বেড়েছে ক্রমে। সরকারে থেকে তাদের রাজনৈতিক দল গঠন হয়েছে বিশেষভাবে বিতর্কিত। এই ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার কিছু বক্তব্যেও বেড়েছে সমালোচনা। তদুপরি উপদেষ্টা পরিষদের ‘পারফরম্যান্স’ নিয়ে সন্তুষ্টি বেশি নেই। আট মাস পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার না হওয়ার কথা স্বীকার করা হচ্ছে সরকারিভাবেই। সামনে রয়েছে গ্রহণযোগ্য বাজেট প্রণয়নের চ্যালেঞ্জ। আগামী বছর জুন পর্যন্ত থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারকেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। তার তো বিচার আর সংস্কারের এজেন্ডাও রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা জোগানোও চ্যালেঞ্জিং।
ভারতের বক্তব্য না হয় আলাদাভাবে বিবেচ্য। এর বাইরে যারা আমাদের ‘উন্নয়ন সহযোগী’ বলে পরিচিত, তারাও কি যথাসম্ভব দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণের তাগাদা দিচ্ছে না? দেশে যে বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল, সেখান থেকে প্রাপ্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেও কি সুনির্দিষ্ট মেয়াদের সরকার থাকা জরুরি নয়? দৃঢ়ভাবে জনপ্রশাসন পরিচালনায়ও নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে কার্যত পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। থেমে থেমে এখনও চলছে ‘মব ভায়োলেন্স’। বিনিয়োগ সম্মেলন চলাকালে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানে যেসব হামলা হয়েছে, সেটাও দেশের ভাবমূর্তির জন্য নেতিবাচক। এতদিন পরও কেন সরকার এসব বন্ধ করতে পারছে না– তার সদুত্তর নেই। এ অবস্থায় ভালো হতো ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হলে। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন সরকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা। যতদূর জানা যায়, নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা ধরে নিয়েই কাজকর্ম গোছাচ্ছে। সরকারের দিক থেকে তেমন ‘ইঙ্গিত’ তারা পেয়েছে বলেই অনেকের ধারণা। এমনও হতে পারে, তারা যে কোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি রাখতে চায়। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কাজেও কিছু সংস্কারের প্রশ্ন রয়েছে। ন্যূনতম যেটুকু সবাই চাইছে, তা হলো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। আগামীতে নির্বাচন যেন কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্যই এটা চাওয়া। দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছিল বলেই অপশাসন ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল– এটা কার না জানা! গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হাতবদল হতে থাকলেও দেশ গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতিতে উপনীত হতো– এমনটা কেউ বলছেন না। সে কারণেই ‘জরুরি সংস্কার’ সেরে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনেই সরকারকে মনোনিবেশ করতে হবে। কোনো সংস্কার করতে না পারলেও তাকে কেউ দায়ী করবে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে না পারলে ইউনূস সরকার হয়ে থাকবে প্রশ্নবিদ্ধ। দেশও অধিকতর সংকটে নিপতিত হবে।
অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের এসব মনে করিয়ে দেওয়ার অবশ্য কিছু নেই। তারা দেশের সম্মানিত ও যোগ্য নাগরিক। বিদেশ থেকেও এক দল বাছাইকৃত মানুষ এসে এই ক্রান্তিকালে ইউনূস সাহেবের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা নিয়ে কম মানুষের মনেই সন্দেহ আছে। নজিরবিহীন জটিল পরিস্থিতিতে এ টিমের কাছে প্রত্যাশাও সীমিত। এ অবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা তৈরি করে ব্যর্থ হওয়া কারও জন্য ভালো হবে না। দেশের জন্য সেটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়েরও আগে রাজনৈতিক সংলাপ সেরে সংস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে দ্রুত এর বাস্তবায়নই কাম্য। ‘প্রয়োজনীয় সব সংস্কার’ কোনো সরকারের আমলেই করা সম্ভবপর হবে না। এ নিয়ে বিতর্কও চলতে থাকবে। সব সংস্কার টেকসই হবে, এমনও নয়। মানসম্মত বিধিবিধানের দেশেও কিন্তু সুশাসন আর গণতন্ত্রের অবনমন হচ্ছে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়ে প্রত্যাশিত সবকিছু করিয়ে নিয়ে চিরদিনের জন্য নিরাপদ থাকার সুযোগ কার্যত অনুপস্থিত। রাজনৈতিক দলগুলোকেই বরং বেশি দায়বদ্ধ করা দরকার রাষ্ট্র সংস্কারে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায় হলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে এর অনুকূল পরিবেশ করে দেওয়া। নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এ ক্ষেত্রে তাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।
নির্বাচিত সরকার সংস্কারের কিছুই করবে না– এমন আশঙ্কা কি রয়েছে, নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের পরও? যদি থাকে তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার করে গেলেও তারা সেগুলো অক্ষত রাখবে না। তাই এসব অহেতুক প্রশ্ন না তুলে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষেই অবস্থান নিতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার উচিত তাঁর সহকর্মী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে নির্বাচনের সময়সীমা চূড়ান্ত করে ফেলা। এর মধ্যে বিচার ও সংস্কার কার্যক্রম যেটুকু এগিয়ে নেওয়া যায়, সেটাও দৃঢ়তার সঙ্গে করা। এ অবস্থান নিতে পারলে তার প্রভাব পড়বে গোটা শাসন পরিস্থিতিতে। অস্বস্তি কাটবে সংশ্লিষ্ট সব মহলে। অর্থনীতি আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও আসবে
কাঙ্ক্ষিত গতি।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন র পর স থ ত ত র জন ত ক বছর জ ন সরক র র ন র সময এ অবস থ ন র পর ক র কর ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কারের একাল-সেকাল
ওয়ান-ইলেভেনকালে জরুরি অবস্থার গর্ভে জন্ম নেওয়া সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘সংস্কারের জিগির’ তোলা হয়েছিল। সে সংস্কারের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা, যা ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ হিসেবে চিহ্নিত।
দল দুটির যেসব নেতা ওই তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তারা ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হন। এক পর্যায়ে ‘সংস্কারপন্থি’ শব্দটিই রাজনৈতিক গালিতে পরিণত হয়।
সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। ২০০৭ সালের নিন্দিত ‘সংস্কার’ ২০২৪ সালে এসে নন্দিত ‘সংস্কার’ হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, লন্ডভন্ড নির্বাচন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে আর যাতে কোনো দল সরকারে গিয়ে আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায় এবং এ জন্য পর্যাপ্ত সময় ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
ধারণা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানকে গণমুখী করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী করতে বিধিবিধান পরিবর্তনের মধ্যেই সংস্কার কার্যক্রম সীমিত রাখবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অস্ত্রোপচার করে রাষ্ট্রের আকার-আকৃতি, চেহারা-সুরত পাল্টে দেওয়ার এক মহাযজ্ঞের সূচনা করেছে। গঠন করেছে ছোট-বড় ১১টি সংস্কার কমিশন: সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, পুলিশ, জনপ্রশাসন, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য খাত, শ্রম, নারীবিষয়ক, স্থানীয় সরকার এবং গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। আবার এসব বিষয়ে যাতে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠিত হয় সে জন্য গঠন করা হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’।
সন্দেহ নেই, জাতীয় স্বার্থে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। সাধারণত প্রয়োজনের নিরিখে সে ঐক্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার প্রয়োজনে। এবারও দেশকে আক্ষরিক অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে এমনিতেই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। সে জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার প্রয়োজন কেন হলো, বোধগম্য নয়।
গঠিত ১১টি কমিশনের বেশ কয়েকটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে সরকারের কাছে। সেসব প্রস্তাব নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রস্তাবগুলোর কিছু বিষয়ে সবাই একমত হলেও অধিকাংশ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। বিশেষত একই ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বা একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা না হওয়ার যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এসব সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর হাত-পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার শামিল। কেননা, একটি দল সরকারে গেলে সরকারপ্রধান, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান কে হবেন বা থাকবেন, সেটা সংশ্লিষ্ট দলের গঠনতান্ত্রিক বিষয়। রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন প্রণীত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলো এখন নিয়ন্ত্রিত। নতুন করে রাজনৈতিক বিধিবিধান গণতন্ত্র বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পেশ করেছে, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছে কয়েকটি সংগঠন। ১৫টি মূল বিষয়সহ ৪৩৩টি প্রস্তাবনার একটিতে জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য মোট আসন ৬০০ করে ৩০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। নারীদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখার সুপারিশকে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে করছেন অনেকে। কেননা, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলোপের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনই পরবর্তী সময়ে রূপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে।
এটা বলা অসমীচীন নয়, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্তরে কোটা পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে প্রত্যাখ্যাত কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের সুপারিশ নারী কমিশন কেন করল, বোধগম্য নয়। তা ছাড়া এ ধরনের কোটা নারীদের জন্য অবমাননাকর নয় কি? জাতীয় সংসদে নারীদের কোটায় আবদ্ধ রাখার অর্থ তাদের অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করা। অথচ আমাদের দেশের নারীরা এখন রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে আমাদের গ্রামের মাথার বাস স্টপেজকে কেন্দ্র করে একটি ছোট্ট বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে আজিমের চায়ের দোকানে প্রায়ই আড্ডা জমে। ঢাকা থেকে গেলে আমিও অংশীজন হই। সেদিনও সে আড্ডায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছিল। কবে সংস্কার শেষ হবে, কবে নির্বাচন হবে– তা নিয়ে একেকজন তাদের জ্ঞানগর্ভ অভিমত ব্যক্ত করছিলেন। এরই মধ্যে কলেজপড়ুয়া এক কিশোর ফোড়ন কেটে বলল, এর পর হয়তো সরকার ‘জাতিসংঘ সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বলবে, নির্বাচন ওই সংস্কারের পর। ছেলেটির কথায় হাসির ফোয়ারা ছুটল আসরে। কারও কারও কাপ থেকে ছলকে পড়ে গেল কিছুটা চা।
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক