ছোঁয়াচে রোগের হাসপাতালে কেন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
Published: 19th, April 2025 GMT
যক্ষ্মা একটি ছোঁয়াচে রোগ। এই রোগের সংক্রমণ-ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে ৬০ বছর আগে শহর থেকে কিছুটা দূরে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে স্থাপন করা হয় ১০০ শয্যার বক্ষব্যাধি হাসপাতাল। তখন সেখানে জনবসতি ছিল কম, প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল নিরিবিলি। ২৮ দশমিক ২৯ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল এলাকায় ছিল পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, ছিল পুকুর, গাছগাছালি। পরে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি), ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনো (আইএইচটি)। এতে করে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আয়তন সংকুচিত হয়েছে, নিরিবিলি পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, জনসম্পৃক্ততা বাড়ায় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সেবা ও চিকিৎসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তার ওপর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জায়গায় স্থাপিত হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ তলাবিশিষ্ট ভবনে স্থানান্তর করার কথা। ২০১৮ সালে হাসপাতালের সমস্ত স্থাপনাসহ খালি জমি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করা হয়। এতে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সেবা ও চিকিৎসা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসম্পৃক্ত স্থানে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। যক্ষ্মা রোগীদের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ বাধ্যতামূলক।
এ ব্যাপারে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক তত্ত্বাবধায়ক ডা.
বর্তমানে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের অধীনে আছে মাত্র সাত একর জমি। খালি জায়গা আছে ৯ একর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৬০ বছরে বারবার সংকুচিত হয়েছে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিধি। ফলে যক্ষ্মা রোগীর যে পরিবেশে চিকিৎসা পাওয়ার কথা সেটা পাবেন না বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ফৌজদারহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতালে সাধারণ যক্ষ্মা, এমবিআর যক্ষ্মা, প্রিএক্সডিআর যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
জানা যায়, ফৌজদারহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জায়গায় চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ১০ তলা ভবন তৈরির কথা রয়েছে। বর্তমানে স্থাপিত তিনতলা ভবনে চলছে মেডিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
সরেজমিন দেখা গেছে, হাসপাতালে আন্তঃবিভাগ প্রায় প্রতিদিন রোগীতে ভর্তি থাকে। ভবনের নিচতলায় পুরুষ ও দ্বিতীয় তলায় নারী রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে ৩৫ জন যক্ষ্মা রোগী ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্য জনবল কর্মরত রয়েছেন।
যক্ষ্মা রোগীদের কফ পরীক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালে রয়েছে জিন এক্সপার্ট নামের কফ পরীক্ষার আধুনিক মেশিন। হাসপাতালে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন ও অডিও মেট্রিক মেশিনও রয়েছে।
২০২৪ সালে ৫৮৯ জন, ২০২৩ সালে ৭২০ জন, ২০২২ সালে ৫৯৫ জন যক্ষ্মা রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব রোগী এমডিআর ও এক্সডিআরে আক্রান্ত। তাদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগের দূর-দূরান্ত থেকেও রোগীরা এ হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রতিদিন ৫০-৬০ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন।
জানা যায়, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল স্থানান্তর করা হবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ তলা বিশিষ্ট ভবনে। হাসপাতাল স্থানান্তর নিয়ে যক্ষ্মা রোগীর অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ। আর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জনসম্পৃক্ত স্থানে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। যক্ষা রোগীদের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ বাধ্যতামূলক। তাই যক্ষ্মা রোগী ও তাদের স্বজনদের দাবি করছে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যেন অন্য কোন স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়।
বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক এবং ব্যক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. দিদারুল আলম বলেন, ‘যেসব রোগী ছয় মাসেও চিকিৎসায় ভালো হয় না, তাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। যক্ষ্মা শতভাগ নিরাময়যোগ্য রোগ। এই রোগীদের চিকিৎসা নিরিবিলি ও জনসম্পৃক্ত নয় এমন হাসপাতালে হওয়া দরকার।
এদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলছে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসা। প্রায় ৬০ বছর আগে নির্মিত হাসপাতাল ভবন ৭ বছর আগে ব্যবহার অনুপযোগী ঘোষণা করে গণপূর্ত বিভাগ। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলছে চিকিৎসা সেবা। গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালটির বিভিন্ন অবকাঠামো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লেও নতুন স্থাপনা নির্মাণে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। ভূমিকম্প হলে স্থাপনা ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জনসম প ক ত র জন য পর ব শ
এছাড়াও পড়ুন:
‘সেবার রাজনীতি’ যেভাবে ‘খয়রাতি মন’ তৈরি করে
উচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে ছাত্র সংসদ (ডাকসু ও জাকসু) নির্বাচনের পর দেশজুড়ে নাগরিক সমাজে অনেক ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। যে বিতর্কগুলো জাতীয় নির্বাচনের বেলায়ও প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সে জন্য সমাজে এসব আলোচনা হওয়া দরকার আছে।
সব বিতর্ক একসঙ্গে আলোচনায় না এনে আলাদাভাবে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে পারি আমরা। যেমন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দান-অনুদানের কদর ও নির্বাচনে তার প্রভাব নিয়ে কথা হচ্ছে। আপাতত এ বিষয় এবং এর রাজনৈতিক–অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে পারি আমরা।
ডাকসু, জাকসু ও রাকসু হলো শিক্ষার্থীদের ইউনিয়ন। পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দর–কষাকষি করে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস জীবন স্বস্তিকর করাই এসব ইউনিয়নের প্রকৃত লক্ষ্য। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাত্রদের দাবিদাওয়া আদায় করে দেওয়াই ছাত্র সংসদের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থায় সংসদের বিধান সে জন্যই রাখা হয়েছে। এটা অনেকটা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ‘সিবিএ’র মতো।
কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে একাধিক শ্রমিকসংগঠন থাকতে পারে; কিন্তু শ্রমিকেরা তাদের মধ্য থেকে কালেকটিভ বার্গেনিং এজেন্ট বা সিবিএ হিসেবে বেছে নেয় কয়েকজন কর্মীকে। ডাকসু, জাকসু ও রাকসুতেও শিক্ষার্থীদের তা–ই করার কথা।
ডাকসু, জাকসু ও রাকসুর কাজ হলো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দেওয়া। এখন প্রশ্ন হলো ইউনিয়ন নেতৃত্ব যদি সরকার, রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দাবিদাওয়া আদায়ের বদলে নিজেরাই ভিন্ন কোনো উৎস থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের জন্য সেবা ও সুবিধা বাড়াতে চেষ্টা করে, তাহলে সমস্যা কী? এর কি বিশেষ কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্বাচনী অধ্যায়ের পূর্বাপর অনুসন্ধান করে অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলছেন, বিদ্যাপীঠগুলোতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি বাছাইয়ের নির্বাচনে দান-অনুদানে যুক্ত সংগঠন ও প্রার্থীরা ভোটে এগিয়ে ছিলেন। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দর–কষাকষির চেয়ে নিজেরাই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব কিছু পদক্ষেপ নিয়ে সেবাধর্মী সংগঠনগুলো বাড়তি ভোট পেয়েছে। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প থেকে শুরু করে হলে পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র বসানো পর্যন্ত অনেক কাজ করছে কোনো কোনো সংগঠন। তাদের বক্তব্য, শিক্ষার্থীরা এসব কাজ পছন্দ করছেন। তাঁরা এরকম দান-অনুদানে যুক্তদের ভোটে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে।
এ রকম যুক্তি ও অনুমান যেহেতু অনেকের কাছে বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, সেই কারণে এই সিদ্ধান্তে আসাও সহজ হয় যে অতীতে শিক্ষার্থীরা যেসব বিষয় দেখে নেতৃত্ব পছন্দ করতেন, এখনকার পছন্দের মানদণ্ড তার চেয়ে ভিন্ন।
এর ফল হিসেবে পরের অধ্যায় অনুমান করা কঠিন নয়। জাতীয়ভাবেও হয়তো অনেক সংগঠন এখন দান-খয়রাতধর্মী সেবামূলক কাজের দিকে বেশি ঝুঁকবে। সে ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন তো উঠতে পারে, ক্যাম্পাসে হোক বা অন্যত্র হোক, এসব সেবাধর্মী কাজের খরচ কারা জোগান দেবে বা দিচ্ছে?
শিক্ষার্থীদের পক্ষে ওয়াশিং মেশিন কিনে হলগুলোর তলায় বসানো সম্ভব নয়। হঠাৎ হঠাৎ গরু কিনে জিয়াফত আয়োজনও সহজ নয়। তাহলে নিশ্চয়ই বাইরের কোনো উৎস থেকে তারা এই অর্থ পাচ্ছে বা নিচ্ছে।
শত শত শিক্ষার্থীকে ইফতার করানো বা উপঢৌকন দেওয়াও বাইরের আর্থিক–সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। তার মানে এ ধরনের সেবাধর্মী তৎপরতা শুধুই ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিশুদ্ধ কোনো বিষয় নয়। এর ক্যাম্পাস–বহির্ভূত একটি অন্তর্জাল অবশ্যই আছে; কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের এত অন্তর্জাল খোঁজার ‘টাইম নেই’। সুবিধাটা নগদ নগদ তাঁরা পছন্দ করছেন।
সেবাধর্মী রাজনীতির একটি অনিবার্য পার্শ্বফল হলো সামাজিক বৈষম্য আড়াল হওয়া। সমাজে সম্পদের যে অসম বণ্টন এবং পুঁজির শোষণ রয়েছে, দানের রাজনীতি তাকে ন্যায্যতা ও স্বাভাবিক চেহারা দেয়। দারিদ্র্য ও যাবতীয় সামাজিক দুর্দশা যে একটি কাঠামোগত সমস্যা, সেটি আড়াল করে তথাকথিত এই ‘সেবা’।যেমন এখন ঢাকা শহরে গণপরিবহনের স্বল্পতা একটি বিশাল সমস্যা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও খোদ রাজধানীতে সে রকম কোনো স্বস্তিকর ব্যবস্থা কোনো সরকার করতে পারেনি বা করেনি। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-দুঃখ আছে। এখন কোনো রাজনৈতিক দল বা তার ছায়ায় পুষ্ট কোনো ‘সামাজিক সংগঠক’ যদি ঢাকায় বিনা মূল্যে ১০০ বাস নামায়, তাতে সাধারণ মানুষ খুব খুশি হবেন।
এ রকম খরচ ও সেবার একটি রাজনৈতিক-অর্থনীতি থাকতে পারে। নিদেনপক্ষে এর মাধ্যমে সমাজে মতাদর্শিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা তো থাকবেই; কিন্তু বিপন্ন মানুষ, নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের অত কিছু খেয়াল করলে চলে না। যে দল বা সংগঠন এ রকম সেবা দেবে, তারা ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান বা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে, সেটি ভাবার চেয়ে মানুষ দ্রুততার সঙ্গে ওই সেবা নেবেন এবং সেবাদানকারীও তাঁদের পছন্দনীয় হয়ে উঠবে।
এ রকম আরও সেবাদানকারী তখন এগিয়ে আসতে পারে এ রকম কাজে। কারণ ‘পছন্দ’ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে অনেক লোভনীয় জিনিস; কিন্তু তাতে গণপরিবহন–ব্যবস্থার দাবি খুব একটা এগোবে না। একাধিক দল একই সেবা দিতে নামলে ওই দাবি বরং হারিয়ে যাবে।
আরও পড়ুনডাকসু নির্বাচন, ফলাফল ও তরুণ মনের চাওয়া১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫কিন্তু এ রকম মডেল রাষ্ট্রের খুব পছন্দ; অন্যান্য ‘কর্তৃপক্ষের’ও পছন্দ। সমাজে দারিদ্র্য কমানো, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা, বৈষম্য হ্রাস করা, শিক্ষার অধিকার কিংবা স্বাস্থ্যসুবিধা বাড়ানোর দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে এসব বিষয়ে ভূমিকা রাখার লক্ষ্যেই। আর সরকার গঠিত হয় রাষ্ট্রের সেসব দায় বাস্তবায়নের জন্য।
কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র বা বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র সেসব দায়িত্ব মেটাতে পারছে না। তাতে জন–অসন্তোষ আছে। এ ধরনের রাষ্ট্রে নাগরিকেরা বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইতে পারেন। সে অবস্থায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের ‘বিকল্প’ হিসেবে সেবাধর্মী কাজ, দান, অনুদান ও খয়রাত রাষ্ট্রের জন্য একটি ভালো ডিফেন্সলাইন। এতে রাষ্ট্রের গায়ে ক্ষোভের আঁচড় কম লাগে। প্রশাসন তার ব্যর্থতা আড়াল করতে পারে।
যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খাবারের মান ও পরিমাণ বাড়ানো দেশের সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এটা রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দের অগ্রাধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখন এমন হতে পারে ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে শক্তিশালী কোনো সংগঠন তাদের মূল দল বা দেশ-বিদেশের সহযোগী বন্ধুদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ এনে নিজেরাই হলে হলে বাড়তি খাবার সরবরাহ করল। এটা শিক্ষার্থীরা খুব পছন্দ করবে। আবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রও খুব পছন্দ করবে।
কেবল ক্যাম্পাসে নয়, কয়েক বছর ধরে গ্রামাঞ্চলেও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধে৵ কিছু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন এভাবে ‘দরিদ্রবান্ধব সেবাধর্মী কাজ’ করছে। জাতীয় নির্বাচন হলে তারও চমকপ্রদ কিছু ফল দেখব আমরা। এ রকম সবকিছুর প্রাপ্তি হিসেবে সেবাধর্মী দান-অনুদানের একটি প্রতিযোগিতাও হয়তো দেখব আমরা চারদিকে। এতে জনসমাজে পদ্ধতিগত বঞ্চনার রাষ্ট্রীয় সমাধানের দাবি ক্রমে অবলুপ্ত হতে বাধ্য। এ রকম সমাধানচিন্তার প্রস্তাবকারীদেরও স্বভাবত সামনে দুর্দিন।
এ রকম আর্থসামাজিক অবস্থা রাষ্ট্রের জন্য একটি সুযোগের মতো। ক্ষমতার রাজনীতিতে উচ্চ আকাঙ্ক্ষী ধনাঢ্য সমাজের জন্যও অনুরূপ। জনসমাজ সেবা পেয়ে খুশি থাকলে শিক্ষা খাত বা স্বাস্থ্য খাতে ব্যায় না বাড়িয়ে বাড়তি টাকা রাষ্ট্র সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র শক্তিশালী করায় বিনিয়োগ করতে পারে। এতে ‘রাষ্ট্র’ ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে এবং সমাজের পুরোনো অধিকারবাদী, পরিবর্তনবাদী রাজনীতিকেও কোনঠাসা করতে পারে।
সেবাধর্মী রাজনীতিতে রাষ্ট্রের লাভ তাই দ্বিবিধ। ফলে আন্তরিকভাবেই এ রকম ‘কাজ’ রাষ্ট্রের সব ‘কর্তৃপক্ষের’ সমর্থন, সহায়তা ও সহযোগিতা পায় ও পাবে। সব দেশে সেটিই হয়। কারণ, একদিকে এতে সব ‘কর্তৃপক্ষের’ সুরক্ষা বাড়ে। অন্যদিকে এতে তাদের শক্তিও বাড়ে। কুলীন সমাজ এ রকম রাষ্ট্রকে দিয়ে খুব সহজে কর্তৃত্ববাদী একটি শাসনও কায়েম করতে পারে।
আরও পড়ুনশিবিরের এই সাফল্য জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে সুবিধা দেবে কি২০ ঘণ্টা আগেকুলীন সমাজ ও করপোরেটদের জন্য দান-অনুদান কর্মকাণ্ডের রাজনৈতিক সুবিধা রাষ্ট্রের মতোই ব্যাপক ও সম্পূরক। সে বিষয়েও দু–চার কথা বলা দরকার।
সেবাধর্মী রাজনীতির একটি অনিবার্য পার্শ্বফল হলো সামাজিক বৈষম্য আড়াল হওয়া। সমাজে সম্পদের যে অসম বণ্টন এবং পুঁজির শোষণ রয়েছে, দানের রাজনীতি তাকে ন্যায্যতা ও স্বাভাবিক চেহারা দেয়। দারিদ্র্য ও যাবতীয় সামাজিক দুর্দশা যে একটি কাঠামোগত সমস্যা, সেটি আড়াল করে তথাকথিত এই ‘সেবা’।
‘সেবার রাজনীতি’ জনসমাজকে এই বার্তাই দেয়—‘ধনাঢ্যরা কীভাবে আয় করছেন, রাষ্ট্র সম্পদের সুষম বণ্টনে ব্যর্থ কি না, সেসব দেখার দরকার নেই তোমার। বৃহত্তর সমাজের কথা বাদ দাও। ধনাঢ্যরা তোমাকে যা দিচ্ছেন, তাতে তোমার ভালোই চলে যাবে। তুমি এতে সন্তুষ্ট থাকো। শোকর করো এবং দাতাদের তোমার অভিভাবক হতে দাও।’
এভাবে সেবার পথে, অধিকারবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিনা যুদ্ধে ধরাশায়ী করে কুলীন সমাজ রাষ্ট্র ও রাজনীতির অভিভাবকত্ব পায়। তবে এ রকম ‘সেবাবাদ’ দুইভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষতি করে। রাষ্ট্রকে জনস্বার্থে সম্পদ বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায় আরও ন্যায্য ও দক্ষ হতে বাধাগ্রস্ত করে এটা। জনগণের তরফ থেকে এ লক্ষ্যে চাপ কমতে থাকায় রাষ্ট্র ক্রমে একটি ক্ষুদ্র সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর নিজস্ব হাতিয়ারে পরিণত হয়। গুটিকয়েকের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবনকে তখন সমস্যা মনে করা হয় না। এতে রাষ্ট্রের ভেতর সমান্তরাল অর্থনৈতিক বিকাশ সীমিত থেকে যায়।
দ্বিতীয়ত সমাজ ও রাষ্ট্রকে অধিকতর সুষম ও ন্যায়ানুগ করার ক্ষেত্রে জনসমাজের রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও আইনি অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত করে দান-অনুদান মডেল। সুবিধাবঞ্চিত সমাজ যেহেতু বাস্তব কারণে সেবা-দান-অনুদান অগ্রাহ্য করতে পারে না; বরং এটা পাওয়ার জন্য ন্যায্য ভিন্নমতও চেপে যায়, সে কারণে এই মডেল গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশও রুদ্ধ করে।
এটা জনসমাজে সৃষ্টিশীল উদ্যমের বদলে ‘খয়রাতি মন’ তৈরি করে চলে, বিশেষ করে সুবিধাগ্রহীতাদের মধ্যে। এ অবস্থায় মানুষ ভাবতে শুরু করে—তার বা তাদের অবস্থার পরিবর্তন বাইরের কোনো শক্তির দয়াদাক্ষিণ্যনির্ভর। নিজেরা বা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান অবস্থার বদলে সক্ষম নয়। তাদের সে রকম লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হওয়ারও দরকার নেই। এ রকম মনোভাব সহজে সুবিধাপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাবানদের পুরোনো কর্তৃত্ব ও শক্তিকে উৎপাদন-পুনরুৎপাদন হতে সহায়তা করে চলে।
‘সেবা-মডেল’ সমাজের ক্ষমতা-সম্পর্ক অপরিবর্তনশীল করে রাখতে চায় এবং সেবার আদলে নতুন ধরনের একটি উপনিবেশ-সংস্কৃতি জারি করে ও তাকে প্রতিমুহূর্তে প্রয়োজনীয় মনে করায়। ‘সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিরা’ এতে চিরকাল নির্ভরশীল ও অপরের মুখাপেক্ষী থেকে যায় এবং তাঁদের দেশের ‘প্রতিষ্ঠানগুলো’র প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়নও আর হয় না। এতে সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণের বদলে ‘সুবিধা’ পাওয়ার সর্বব্যাপক আকুতি দেখা দেয়। এসব বিবেচনায় সমাজে ‘সেবা’ বিশেষ ধরনের একটি রাজনৈতিক বিনিয়োগ এবং নিশ্চিতভাবে কৌশলগত ও হেজিমনিক বিনিয়োগও বটে।
আলতাফ পারভেজ, গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব