সীতাকুণ্ডে ১২৫ জাহাজভাঙা কারখানা বন্ধ, তবু নতুন জায়গার আবেদন
Published: 27th, April 2025 GMT
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলে ২০২১ সালে জাহাজভাঙা কারখানা (ইয়ার্ড) ছিল ১৫০টি। এর মধ্যে ১০৫টি কারখানাকে পরিবেশবান্ধব (গ্রিন) করার লক্ষ্যে উন্নয়নকাজ করার অনুমোদন দিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত গ্রিন সনদ পেয়েছে মাত্র সাতটি কারখানা। আরও ১৭টি কারখানা গ্রিন করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। তবে নানা সংকটে বাকি কারখানাগুলো ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। কারখানা বলতে রয়েছে কেবল জমি আর সামান্য যন্ত্রপাতি।
সীতাকুণ্ড উপকূলের সাতটি মৌজা নিয়ে গঠিত জাহাজভাঙা অঞ্চলে এসব কারখানার অবস্থান। কারখানা বন্ধ থাকায় এই সাত মৌজার বেশির ভাগই যেখানে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, সেখানে নতুন করে জাহাজভাঙা অঞ্চল বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে। সীতাকুণ্ডের বোয়ালিয়া নামক আরও একটি মৌজায় জাহাজভাঙা কারখানার জন্য ২০০ একর জমি বরাদ্দ চেয়েছেন কয়েকজন ব্যক্তি। ১০ বছর আগে এ আবেদন করা হলেও সম্প্রতি জেলা প্রশাসন থেকে আবেদনটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
নতুন করে জাহাজভাঙা অঞ্চল বাড়ানো হলে পরিবেশগত দূষণের পাশাপাশি আকিলপুর এলাকায় গড়ে ওঠা সৈকত নষ্ট হবে বলে অভিমত স্থানীয় বাসিন্দাদের। এ ছাড়া জাহাজভাঙা কারখানামালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) শুরু থেকে নতুন জাহাজভাঙা অঞ্চলের বিরোধিতা করে আসছে। তাদের ভাষ্য, এত ইয়ার্ড ও নতুন অঞ্চলের দরকার নেই। বরং বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা সরকারি সহযোগিতায় অন্য কোনো ব্যক্তি নতুন করে চালুর উদ্যোগ নিতে পারেন।
২০১১ সালের ২০ অক্টোবর শিল্প মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন দিয়ে জাহাজভাঙার জন্য সীতাকুণ্ড উপকূলের সাতটি মৌজাকে নির্ধারণ করে দেয়। তাতে বলা হয়, সীতাকুণ্ড উপজেলার উত্তর ছলিমপুর, ভাটিয়ারি, জাহানাবাদ, শীতলপুর, দক্ষিণ সোনাইছড়ি, মধ্য সোনাইছড়ি ও উত্তর সোনাইছড়ি এই সাত মৌজায় জাহাজভাঙা কাজের জন্য ইজারা দেওয়া খাসজমি অন্তর্ভুক্ত করে পরিবেশসম্মত জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চল ঘোষণা করা হলো। মূলত পরিবেশ দূষণরোধ, নিরাপদ শ্রম পরিবেশ নিশ্চিতের জন্য এই প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল মন্ত্রণালয়।
বোয়ালিয়া মৌজাকে জাহাজভাঙা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেন মাদার স্টিল নামে একটি জাহাজভাঙা কারখানার মালিক আবুল কাশেমসহ কয়েকজন ব্যক্তি। মাদার স্টিল ছাড়াও কাশেমের আরও তিনটি কারখানা রয়েছে। ওই তিনটি কারখানা এখন পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব করা না হলেও নতুন মৌজায় কারখানার আবেদন করেছেন তিনি।
২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসন বরাবর করা একটি আবেদনে আবুল কাশেম লিখেছেন, ‘আমি বোয়ালিয়া মৌজায় কয়েক বছর আগে কিছু জায়গা কিনেছি। এটা পরিবেশ সম্মত জাহাজভাঙা কারখানার উপযুক্ত হলেও সরকারি অনুমোদনের অভাবে ওই মৌজায় জাহাজভাঙা কারখানা স্থাপন করা যাচ্ছে না। এই মৌজায় জাহাজভাঙা কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিলে ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারব।’ গেজেটভুক্ত হওয়ার প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে করতে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন বলেও আবেদনে কাশেম উল্লেখ করেন।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর কাশেমসহ কয়েকজন ইয়ার্ডমালিক আবার নতুন করে তদবির শুরু করেন। আবেদনের বিষয়ে জেলা প্রশাসন বিএসবিআরএর মতামতও নেয়। কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন তাঁদের আবেদনটিতে মতামত দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় বরাবরে পাঠিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বোর্ডের মহাপরিচালক এ এস এম শফিউল আলম তালুকদারের নেতৃত্বে একটি দল আজ রোববার সীতাকুণ্ডে ইয়ার্ডের জন্য বিদ্যমান মৌজা এবং প্রস্তাবিত মৌজা পরিদর্শনে গেছে।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো.
জানতে চাইলে আবেদনকারী আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই এলাকায় ইয়ার্ড হলে ভাঙা বেড়িবাঁধ রক্ষা হবে। আমার লাভ নয়, এতে দেশের লাভ হবে। সবাই মনে করছে আমার আগ্রহ বেশি। অথচ জেলা প্রশাসন যে পরিমাণ জায়গার সুপারিশ করেছে বলে শুনেছি, তাতে আমার জায়গা পড়েনি। আমরা ১০ বছর আগে মৌজা বাড়ানোর আবেদন করেছিলাম। বন্ধ হয়ে যাওয়া ইয়ার্ডে কারখানা চালু করতে ব্যাংকঋণসহ নানা ঝামেলা হবে।’
২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন ও শিল্প মন্ত্রণালয় বরাবরে চারটি চিঠিতে জাহাজভাঙা কারখানামালিকদের সংগঠন বিএসবিআরএ নতুন করে ইয়ার্ডের অঞ্চল না বাড়ানোর আবেদন জানায়। পাশাপাশি তারা রুগ্ণ ইয়ার্ডকে কীভাবে চালু করা যায়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। এ বিষয়ে সংগঠনটির কোনো সদস্য বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। তবে একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, লিখিত আবেদনের বক্তব্যগুলোই তাঁদের বক্তব্য।
২০০১ সালের ২০ মে শিল্প মন্ত্রণালয় বরাবর বিএসবিআরএর সভাপতি আবু তাহের স্বাক্ষরিত আবেদনে ১৫০টি ইয়ার্ড রয়েছে উল্লেখ করা হয়েছিল। আবেদনে বলা হয়, ‘বোয়ালিয়া মৌজাকে অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা না করে সাতটি মৌজার বন্ধ ইয়ার্ডগুলোকে সরকারি সহযোগিতায় সচল করা এবং অঞ্চলের অবশিষ্ট ভূমিতে আরও ইয়ার্ড স্থাপন করা সমীচীন হবে।’ ২০২৩ সালের ৭ মে ও ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবর পৃথক আরও দুটি চিঠি দেওয়া হয় বিএসবিআরএর পক্ষ থেকে। এতে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কামাল উদ্দিন আহমেদ। এই দুই চিঠিতেও একই আবেদন জানানো হয়। সবশেষ এ বছরের ১৩ এপ্রিল শিল্পসচিব বরাবর একটি আবেদন জানানো হয়। এতে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জহিরুল ইসলাম। এই আবেদনে বলা হয়, ‘বর্তমান ঘোষিত অঞ্চলে নানা কারণে ৬০ থেকে ৭০টি ইয়ার্ড কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। তা ছাড়া অঞ্চলের ভেতর যে পরিমাণ খালি জায়গা রয়েছে, সেখানে নতুন করে আরও বেশ কিছু ইয়ার্ড করা সম্ভব হবে। তাই জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের অঞ্চল বর্ধিতকরণের পরিবর্তে বিদ্যমান অঞ্চলে যেসব ইয়ার্ড বন্ধ আছে, সেগুলো চালু এবং খালি জায়গায় সরকারি সহযোগিতায় নতুনভাবে ইয়ার্ড স্থাপন সম্ভব।’ জাহাজভাঙা অঞ্চল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে পরিবেশসহ নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার সৃষ্টির আশঙ্কাও করা হয় চিঠিতে।
২০০ জাহাজের জন্য ৫০ ইয়ার্ড যথেষ্ট২০২৪ সালে বাংলাদেশে পুরোনো জাহাজ আসে ১৩৬টি। আগের বছর ২২৩ সালে আসে ১৬৬টি। গত এক দশকে প্রতিবছর গড়ে ১৮৯টি করে পুরোনো জাহাজ আমদানি হয়েছে। বাংলাদেশে যেসব জাহাজ আমদানি হয়, সেগুলো ভাঙতে একটি ইয়ার্ডের তিন মাস সময় লাগে। একটি কারখানায় একসঙ্গে একাধিক জাহাজ ভাঙার কাজ খুব কম হয়। তবে গ্রিন ইয়ার্ডে একসঙ্গে একাধিক জাহাজ ভাঙার সক্ষমতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৬০টি জাহাজভাঙা কারখানা ব্যবহার করে বছরে ২০০টির বেশি জাহাজ ভাঙা যায়।
শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত দিক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা। ইপসার সমন্বয়কারী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এতগুলো ইয়ার্ড বেকার পড়ে রয়েছে। সেখানে নতুন করে কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। নতুন করে ইয়ার্ড হোক, এলাকার লোকজন তা চান না। কারণ, এটা বড় একটা দূষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। এলাকার লোকজনের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত নানা সমস্যা দেখা দেয়। নতুন করে অঞ্চল বাড়ানো কোনোভাবে উচিত হবে না।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য পর ব শ ব এসব সরক র বর বর স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা
মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে প্রায়ই বিজ্ঞান, স্থাপত্য বা শাসনব্যবস্থার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু এর মানবিক দিক অধরা রয়ে যায়। বিশেষ করে দরিদ্রদের প্রতি দয়া ও চিকিৎসাসেবার গল্প আড়ালে রয়ে গেছে সব সময়।
মুসলিম সভ্যতায় কীভাবে দরিদ্র ও অসুস্থদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা, আশ্রয় এবং মানসিক সান্ত্বনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা এক অপূর্ব কাহিনি।
বিমারিস্তান: দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসার আশ্রয়মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবায় ‘বিমারিস্তান’ নামের হাসপাতাল ছিল একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এগুলো শুধু চিকিৎসার জায়গা ছিল না, বরং দরিদ্রদের জন্য বিনা মূল্যে আশ্রয়, খাদ্য ও যত্নের ব্যবস্থা ছিল। বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত নগরে, বিশেষ করে বড় রাজধানীগুলোতে বিমারিস্তান ছিল। দামেস্কে বিমারিস্তানের নাম ছিল ‘নুরি’, বাগদাদে ‘আদুদি’।
প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহ.)প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকের সময়, ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি এতে চিকিৎসক নিয়োগ করেন এবং তাঁদের বেতনের ব্যবস্থা করেন। সমাজের স্বাস্থ্য রক্ষায় কুষ্ঠরোগীদের জন্য পৃথক স্থানে বিনা মূল্যে খাদ্য ও যত্ন দেওয়া হতো।
অন্ধদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা ও সাহায্যকারী নিয়োগ করা হতো। খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।’ (ইবনে আসাকির, তারিখে দিমাশক, ৪৪/১২৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)
আরও পড়ুন“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”০১ অক্টোবর ২০২৫ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালও ছিল, যা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হতো। দূরবর্তী অঞ্চলে মহামারি মোকাবিলায় ৪০টি উটের কাফেলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হতো।
মিসরে প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় আহমদ ইবন তুলুনের সময়, ৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে, ফুসতাতে। এর নাম ছিল ‘বিমারিস্তান আতিক’।
এর জন্য ওয়াক্ফ তহবিল রাখা হয়েছিল, এবং শর্ত ছিল যে এটি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য, সৈন্য বা দাসদের জন্য নয়। এর বার্ষিক খরচ ছিল ৬০ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)। ইবন তুলুন নিজে প্রতি সপ্তাহে এটি পরিদর্শন করতেন এবং জুমার দিনে মুসল্লিদের জন্য জরুরি সেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে ছিল ১ লাখের বেশি বইয়ের গ্রন্থাগার। (মাকরিজি, খিতাত, ২/৪০৫, দারু সাদির, কায়রো, ১৮৫৩)
সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।সালাহউদ্দিন আইয়ুবি বিমারিস্তান ‘নাসিরি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মিসর ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বিমারিস্তান ছিল মনসুর কালাউনের প্রতিষ্ঠিত বিমারিস্তান, ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। এখানে নারী-পুরুষ সবার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল, চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা ছিল না। এখানে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো।
সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। রাতের দীর্ঘ সময় রোগীদের জন্য কষ্টকর হতো, তাই ফজরের আজান দুই ঘণ্টা আগে দেওয়া হতো, যাতে রোগীরা সকালের আশায় উৎফুল্ল হয়। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।
সুস্থ হওয়ার পর রোগীদের পোশাক ও কিছু টাকা দেওয়া হতো, যাতে তারা তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে না বাধ্য হয়। এই বিমারিস্তান ২০০ জনের বেশি দরিদ্র রোগীকে বাড়িতে চিকিৎসা দিত। (মাকরিজি, খিতাত, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৭)
দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসাগ্রন্থমুসলিম সভ্যতার চিকিৎসকেরা লক্ষ করেন, চিকিৎসা কখনো কখনো ধনীদের কাছে ব্যবসায় পরিণত হন। তাই তাঁরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তারা নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে বা ছোট চিকিৎসকেরা তাদের সহজে চিকিৎসা দিতে পারেন। এই গ্রন্থগুলোয় স্থানীয় ও সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতো; কারণ, ভারত বা চীন থেকে আমদানি করা ওষুধ ছিল দামি।
আরও পড়ুনইসলামে দারিদ্র্য দূরীকরণের ৮টি ব্যবহারিক উপায়০২ নভেম্বর ২০২৫আবু বকর আর-রাজি: তিনি দরিদ্রদের প্রতি অসাধারণ দয়া দেখাতেন এবং তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতেন। তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন: ‘বুরউ সা’আত’ (তাৎক্ষণিক চিকিৎসা) এবং ‘মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব’ (যার কাছে চিকিৎসক নেই), যাকে ‘তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন’ (দরিদ্রদের চিকিৎসা) বলা হয়।
তিনি লিখেছেন, ‘অনেক চিকিৎসক ওষুধ ও খাবারের কথা লেখেন, যা শুধু রাজাদের ভান্ডারে পাওয়া যায়। আমি সাধারণ ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে চিকিৎসার একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লিখতে চাই, যাতে সবাই এর সুবিধা পায়।’ (আল-রাজি, মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব, পৃষ্ঠা ১৫, দারুল কুতুব, বৈরুত, ১৯৮৫)
মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো।ইবনে জাজ্জার কায়রাওয়ানি: তিনি কখনো দরিদ্রদের কাছ থেকে চিকিৎসার ফি নিতেন না। তিনি তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দরিদ্ররা স্বাস্থ্য ও রোগ–সম্পর্কিত বইয়ের সুবিধা পায় না। তাই আমি এমন একটি গ্রন্থ লিখলাম, যাতে সহজলভ্য ওষুধ দিয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করা যায়।’ (ইবনে জাজ্জার, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ১০, দারুল ফিকর, কায়রো, ১৯৯০)
ইবনে আকফানি: তিনি গুনইয়াতুল লাবিব ফি গাইবাতিত তাবিব (চিকিৎসক না থাকলে জ্ঞানীর সম্পদ) গ্রন্থে জরুরি রোগের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য রক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন।
জামালুদ্দিন ইউসুফ মাকদিসি: তিনি ‘তিব্বুল ফুকারা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ধনীরা সুস্বাদু খাবার খায়, তাই তাদের রোগ বেশি। দরিদ্ররা সাধারণ খাবারে সন্তুষ্ট থাকে, তাই তাদের রোগ কম। কিন্তু দরিদ্ররা অসুস্থ হলে তাদের জন্য সহজ ও সস্তা ওষুধ দরকার।’ (মাকদিসি, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ৮, দারুল মারিফা, বৈরুত, ১৯৯২)
মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো। চিকিৎসকেরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে তারা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে। এই ঐতিহ্য দেখায়, ইসলামি সভ্যতা কেবল জ্ঞান বা শক্তিতে নয়, মানবিকতা ও দয়াতেও শ্রেষ্ঠ ছিল।
আরও পড়ুনআপনার মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিচ্ছেন তো২১ জুন ২০২৫