দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ আখ্যায়িত করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, মুক্ত সাংবাদিকতা হোক, মানুষের অধিকার হোক, গণতান্ত্রিক চর্চা হোক, সব কটাকে ধ্বংস করে কর্তৃত্ববাদের বিকাশের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। অথচ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার নিয়ে কেউ কথা বলে না।

উল্লেখ্য, এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম মানে হলো, একটি বড় সমস্যা বা বিতর্কিত বিষয় যা সমাজে বিদ্যমান কিন্তু আলোচনার ক্ষেত্রে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

আজ রোববার রাজধানীর ধানমন্ডিতে ‘ব্রেভ নিউ বাংলাদেশ: রিফর্ম রোডম্যাপ ফর প্রেস ফ্রিডম’ শীর্ষক এক সেমিনারে এ কথা বলেন ইফতেখারুজ্জামান। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে যৌথভাবে সেমিনারটির আয়োজন করে ইউনেসকো ঢাকা অফিস, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সুইডেন দূতাবাস।

আরও পড়ুনন্যায্য পারিশ্রমিক ও নীতিসহায়তা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে জরুরি: কামাল আহমেদ৪ ঘণ্টা আগে

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার নিয়ে কেউ কথা বলে না। সংস্থাগুলোয় এখন কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। বাস্তবে কোথাও চর্চার পরিবর্তন হয়নি। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে তারা যে সিস্টেম ডেভেলপ করেছে, যে মেথড ডেভেলপ করেছে, যে ইনস্ট্রুমেন্ট ডেভেলপ করেছে, যেগুলো করায়ত্ত করেছে, সেগুলো তাদের হাতে বহাল আছে। আমরা সবাই মনে করছি, মোবাইলটা এখন রেকর্ড হয় না। কে নিশ্চয়তা দিতে পারবে এটার?’

আরও পড়ুনসাংবাদিকদের প্রশ্ন করা যাবে না, আমি এটা চাই না: তথ্য উপদেষ্টা২ ঘণ্টা আগে

বাস্তবিক সংস্কার চাইলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দিকেও দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, দেশে গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজন আছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। সেটার দায়িত্ব তাদের। অন্তর্বর্তী সরকার এবং পরবর্তী যে সরকার আসবে, তাদেরও বুঝতে হবে যে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ম্যান্ডটটা (এখতিয়ার) কী এবং সেভাবেই তাদের কার্যক্রমকে সঙ্গায়িত করতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইফত খ র জ জ ম ন

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপির নেতৃত্ব, গণতন্ত্র ও নির্বাচন

প্রায় চার মাস লন্ডনে অবস্থানের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেশের উদ্দেশে রওনা হওয়ার ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। এর আগে সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ ছড়াচ্ছিলেন– তিনি আর ফিরবেন না। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলায় যারা এখনও উৎসাহী, তারাই এসব বলে থাকেন। বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে ভিন্ন। খালেদা জিয়া কাতারের আমিরের দেওয়া বিশেষ বিমানে তাঁর পুত্র, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে টানা ক’দিন ক্লিনিকে থাকতে হয়। তারপর বাসায়ও ছিলেন চিকিৎসাধীন। বিগত শাসনামলে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের এ সুযোগ তিনি পাননি। বিএনপি চেয়ারপারসন এখন কতটা সুস্থ, তা স্পষ্ট জানা না গেলেও তাঁর অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়। 

শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলেও খালেদা জিয়া আর আগের মতো বিএনপির নেতৃত্ব দিতে পারবেন কি? বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে দলকে সহায়তা করতে পারবেন নিশ্চয়ই। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুক্ত হয়ে এ পর্যন্ত সরব না হলেও তারেক রহমানের মাধ্যমে যে কিছুটা হলেও ভূমিকা তিনি রাখছেন, তা ধরেই নেওয়া যায়। এটাও ঠিক, তিনি কারাগারে থাকার সময় পুত্র তারেক রহমানই বিএনপিকে রক্ষা ও পরিচালনা করেছেন। বিদেশে অবস্থান করে কাজটা করা কঠিন। তাঁর নেতৃত্বে সরকার পতনের আন্দোলন বেগবান না হলেও একটি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় দলের ঐক্য ধরে রাখাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বিএনপি নেতাকর্মীও দলকে রক্ষা করেছেন। 

মাঠে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দল এখন বিএনপি। চিকিৎসা শেষে দলটির চেয়ারপারসনের দেশে ফেরার ঘটনা তাই দলীয় নেতাকর্মীর জন্য বড় সুখবর। তিনি আবার ফিরছেন দুই পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে। এ অবস্থায় তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের দেশে ফেরার ঘটনা বিশেষ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রায় ১৭ বছর পর তিনি ফিরছেন। এক-এগারো সরকারের আমলে তাঁর বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হয়েছিল। হাসিনা সরকারের আমলে তা বহাল থাকে। বর্তমানে তিনি সেসব জটিলতা থেকে মুক্ত। তবে দেশে তাঁর নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। জোবাইদার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা চেয়ে আইজিপির কাছে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। 
এ অবস্থায় এমন জল্পনাও হচ্ছে, জোবাইদা রহমান কি বিএনপিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে যাচ্ছেন? এর আগে সম্ভবত ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে রটেছিল, খালেদা জিয়া কারান্তরীণ এবং তারেক রহমান বিদেশে অবস্থানে বাধ্য হওয়ায় জোবাইদা দলের নেতৃত্ব দিতে আসবেন! মামলা থাকায় কিংবা যে কারণেই হোক, সেটি ঘটেনি। তারেক রহমানকেই বরং আরও নিবিড়ভাবে বিএনপির নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। 

২০১৮ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ কার্যত ঢুকে গিয়েছিল সরকারের মধ্যে। আর সরকার প্রবেশ করেছিল প্রশাসনে। এ অবস্থায় চরম মূর্তি ধারণ করা স্বৈরতন্ত্র থেকে বিএনপিকে আগলে রাখাই ছিল বড় কাজ। তারেক রহমান এতে ব্যর্থ হননি। এর ভেতর দিয়ে দলে তাঁর অবস্থান হয়েছে আরও সংহত। এ অবস্থায় তারেক রহমানের জায়গায় জোবাইদা কিংবা অন্য কাউকে গ্রহণের কথা উঠবে কেন? এমনও হতে পারে, তারেক রহমানের স্ত্রী বলেই তাঁর নিরাপত্তায় বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। 

তারেক রহমানের নামে বিচারিক আদালতে আর কোনো মামলা নেই। বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়া দুই পুত্রবধূ নিয়ে দেশে ফেরার কিছুদিন পর তারেক রহমানও ফিরবেন। এক-এগারো সরকারের সময় তাঁকে আর রাজনীতি না করার বিষয়ে মুচলেকা দিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। এর আগে বিভিন্ন অভিযোগ ঘিরে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁর ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। তাঁকে বিদেশে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হয়। কালক্রমে তিনি দলের নেতৃত্ব গ্রহণ এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে দলীয় নেতাকর্মীর নিবিড় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন তিনি। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকাও সবার নজর কেড়েছে। দলকে গতানুগতিক অভিযোগ থেকে মুক্ত রাখতেও সচেষ্ট দেখা যাচ্ছে তাঁকে। 

তারেক রহমান যথাসময়ে দেশে ফিরে দল পরিচালনা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে কিছু ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ সব সময় উড়ে বেড়াচ্ছে। তারেক রহমান ঘিরেও এটা রয়েছে। মামলাগুলোর নিষ্পত্তি তাঁর পক্ষে গেলেও মহলবিশেষ নাকি তাঁকে দেশে ফিরতে দিতে নারাজ। দলের ক’জন সিনিয়র নেতার মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের কথাও শোনা যায়। এ পরিস্থিতিতেই খালেদা জিয়া পুত্রবধূ জোবাইদা রহমানকে নিয়ে দেশে ফিরছেন। তিনিই নাকি দেশে থেকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এক ধরনের নেতৃত্ব দেবেন বিএনপিকে। 
জল্পনা-কল্পনা ঘিরে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। আপাতত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার জন্য। জানুয়ারির শুরুতে লন্ডন যাত্রার সময় দলের নেতাকর্মী, সমর্থকরা বিমানবন্দর পর্যন্ত তাঁকে যে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন, সেটা সবার মনে আছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কখনোই পরাস্ত হননি তিনি। গণতন্ত্রে উত্তরণে রাখা ভূমিকার জন্য তাঁকে ‘আপসহীন নেত্রী’ বলা হয়। সংযত রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্যও তিনি প্রশংসা পেয়েছেন। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাঁকে অনুসরণ করেই তারেক রহমান দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন বলে অনেকের অভিমত। মায়ের মতো আরেক জটিল সময়ে দল পরিচালনায় সফল হয়ে তারেকও নিশ্চয় আছেন দেশে ফেরার অপেক্ষায়।

সম্প্রতি একটি ভারতীয় সাময়িকী তারেক রহমানকে ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’ বলে প্রতিবেদন বের করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মাঠে থাকা দলগুলোর মধ্যে বিএনপিই সবচেয়ে ভালো করবে– এমন ধারণা রয়েছে বৈ কি! তারেক রহমান দেশে ফিরলে সে সম্ভাবনা আরও বাড়বে। উল্লিখিত জল্পনা সত্য হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই তাঁকে ফিরতে হবে। 
আমরা আশা করব, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সবকিছু এগোবে। রাজনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় বইতে দিতে হবে। এক-এগারোর পরও রাজনীতিকে লাইনচ্যুত করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। সেটা কতখানি ব্যর্থ হয়, তা সবারই জানা। ব্যর্থ হয়েছে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলাও। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আশা করা যায়, নিয়মনীতি রক্ষা করেই পথ চলবে। দলের নেতৃত্ব কে দেবেন, তা নির্ধারণ 
করবে দল। আর দেশের নেতৃত্ব কে দেবেন, সেটা নির্ধারণ করবে জনগণ। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। 
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে রাষ্ট্র সংস্কার অবশ্য এক বড় এজেন্ডা। তার বিরোধিতা কেউ করছে না। নির্ধারিত সময়ে এ-সংক্রান্ত কাজ সম্পন্ন করে নির্বাচনে যাওয়াই সরকারের কর্তব্য। এতে কে বা কারা ক্ষমতায় আসবেন– সে প্রশ্নটি গণতন্ত্রে মুখ্য নয়। আর তারেক রহমান দেশে ফিরলে গণতন্ত্রে উত্তরণ প্রক্রিয়াটি আরও জোরদার হবে বলে ধারণা। এ ঘটনা প্রবাহের দিকে তাই দৃষ্টি থাকবে সবার। 

হাসান মামুন : সাংবাদিক, কলাম লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ