তিন বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত, এখন জবাবের অপেক্ষা: পাকিস্তান
Published: 10th, May 2025 GMT
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, দেশটির তিনটি বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করা হয়েছে। এখন শুধু ভারতকে জবাব দেওয়ার অপেক্ষা। জবাবের জন্য অপেক্ষা করুন। খবর- এএফপি
শনিবার ভোর সাড়ে তিনটায় পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেছেন, ভারত তিনটি বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে ‘ক্ষেপণাস্ত্র হামলা’ চালিয়েছে। ‘অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র’ প্রতিহত করা হয়েছে। কোনো উড়োজাহাজের ক্ষতি হয়নি।
যেসব বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে সেগুলোর একটির অবস্থান পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের কাছে। আরেকটি হলো রাওয়ালপিন্ডির নূর খান বিমানঘাঁটি। এটি ইসলামাবাদ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। রাওয়ালপিন্ডির নূর খান বিমানঘাঁটি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি অতিথিদের আসা-যাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। ভারতের হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে সৌদি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আদেল আল-জুবেইর ওই ঘাঁটি থেকে নিজ দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
এদিকে তিন বিমানঘাঁটিতে ভারতের মিসাইল হামলার পরই পাল্টা জবাব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসলামাবাদ। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সামরিক স্থাপনায় আজ শনিবার ভোর থেকে পাল্টা হামলা চালানোর কথা জানিয়েছে দেশটি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ভারতের বিয়াস অঞ্চলে ‘ব্রাহ্মোস মিসাইলের সংরক্ষণাগার উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে’। ভারতের আরও কিছু স্থাপনাতেও হামলা চালানো হচ্ছে। পাকিস্তান জবাব দিচ্ছে। ভারত যেসব ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানের নাগরিক ও মসজিদের ওপর হামলা চালিয়েছে, সেসব জায়গা আমাদের পাল্টা হামলার মূল লক্ষ্য।
পাকিস্তান জানিয়েছে, তিন বিমানঘাঁটিতে হামলার পাল্টা জবাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। দেশটি এই পাল্টা হামলার নাম দিয়েছে ‘অপারেশন বুনইয়ান–উন–মারসুস’। আরবি শব্দ বুনইয়ান–উন–মারসুস –এর অর্থ হলো ‘সুদৃঢ় প্রাচীর’।
ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন বিমানঘাঁটিতে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানের ফেডারেল সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ভারত আমাদের দেশ, জনগণ ও সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাই আমরা এই জবাব দিয়েছি।’ এ হামলায় লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে উত্তর ভারতের একটি ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণাগারসহ একাধিক স্থাপনাকে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ভারতের বিয়াস অঞ্চলে ‘ব্রাহ্মোস মিসাইলের সংরক্ষণাগার উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে’। ব্রাহ্মোস হচ্ছে দীর্ঘ পাল্লার সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল। দেশটির সেনাবাহিনী আরও বলেছে, তারা ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের উধমপুর বিমানঘাঁটি এবং ভারতের পাঞ্জাবের পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতেও হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান সরকার এক্স-এ (সাবেক টুইটার) লিখেছে, ভারতকে এখন পাকিস্তানের জবাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী মাতৃভূমি, আকাশসীমা এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
তবে ভারতের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও এই ঘটনায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, খুব শিগগিরই গণমাধ্যমকে ব্রিফ করবে ভারতের সেনাবাহিনী। দীর্ঘদিনের কাশ্মীর বিরোধ নিয়ে বুধবার থেকে প্রতিদিনই সংঘর্ষে জড়াচ্ছে দুই প্রতিবেশী। ভারত বুধবার পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কথিত জঙ্গি ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালানোর পর থেকেই উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। পাকিস্তান প্রতিশোধ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
প্রতিবেশী এই দুই দেশের মধ্যে বুধবার থেকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৮ জন নিহত হয়েছেন বলে দুই দেশের পক্ষ থেকে প্রাক্কলন করা হয়েছে। যদিও এ তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নিয়ন্ত্রণ রেখার দুই প্রান্তে আতঙ্কে মানুষ, ঘরছাড়া অনেকে
ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হওয়ার পর গত তিন দিনে নিয়ন্ত্রণ রেখার দুই পাশের গ্রাম-শহরগুলোর বাসিন্দাদের দিন-রাত কাটছে আতঙ্কে। সীমান্ত এলাকার বহু মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শিশুরা কান্নাকাটি করছে।
বিবিসির সংবাদদাতারা দুই দেশের গ্রাম-শহরগুলোতে দেখেছেন, বসতবাড়ির মধ্যে গোলা পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক বাড়ি। কোথাও আবার গোটা শহরই প্রায় খালি করে পালিয়েছে মানুষ।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি আর কুপওয়ারায় গিয়েছিলেন বিবিসির আমীর পীরজাদা। তিনি বলেন, ওই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ সীমান্তের অপর দিক থেকে গোলাগুলির ঘটনায় অভ্যস্ত।
তবে কুপওয়ারা ক্রালপোরা গ্রামের মানুষ কখনও দেখেননি যে, তাদের গ্রামে গোলা এসে পড়েছে। ‘জীবনে এই প্রথম আমাদের গ্রামে গোলা এসে পড়ল’, বিবিসিকে বলেছেন গ্রামটির বাসিন্দা তানভির আহমেদ।
গতকাল শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে তার বাড়িতে একটা গোলা এসে পড়ে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার একটা ট্রাক ও মাটি কাটার যন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন, কারণ, পরিবারের সবাই মাত্র ৫০০ মিটার দূরে একটা আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গিয়েছিল। তাদের গ্রামে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য কোনো বাঙ্কার বানানো হয়নি।
উরি যেন এক ভূতুরে শহর
উরি শহরের বাসিন্দারাও বলছেন, এত বেশি সংখ্যায় গোলা পড়তে তারা কখনও দেখেননি। বিবিসিকে পাঠানো এক টেলিফোন ভয়েস মেসেজে উরির বাসিন্দা নিসার হুসেইন বলছেন, ‘আমরা একটা মসজিদের বেজমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এটা বছর দশেক আগে বানানো হয়েছে। সকালে যখন বাড়ির দিকে যাই; দেখতে পাই, আমার বাড়ির আশপাশেই তিনটা গোলা পড়েছে। বাড়ির কিছুটা অংশ ভেঙ্গে গেছে।’
একই দৃশ্য দেখেছেন বিবিসির আরেক সংবাদদাতা ডেভিনা গুপ্তা। তিনি ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার সুরানকোটে গিয়েছিলেন। তিনি বলছেন, নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ব্যাপক গোলাবর্ষণের ফলে পুঞ্চ জেলার বহু মানুষ এখন ঘরছাড়া।
বুধবার মাঝরাতের পরে পাকিস্তানে ভারতীয় হামলার পর থেকে গোলাবর্ষণ বহুগুণ বেড়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সোবিয়া নামের এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেছেন, ‘হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনে একমাসের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দৌঁড়াই আমি। এতে শিশুটি কান্নাকাটি করছে, তাকে থামানো যাচ্ছে না।’
সুরফিন আখতারের বাড়ির সামনেই একটা গোলা এসে পড়েছিল। তারপরেই ঘর থেকে পালিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, ‘একটাও গাড়ি পাওয়া যায়নি। বহুদূর পর্যন্ত হেঁটে যেতে হয়েছে। এত গোলাবর্ষণ হচ্ছিল যে, পুরো রাস্তা আমি ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটেছি। নিজেও কেঁদেছি, সঙ্গে শিশুও।’
অন্য প্রান্তেও একই চিত্র
নিয়ন্ত্রণ রেখার ভারতীয় অংশে যেমন সুরফিন আখতার সারা রাস্তা কেঁদেছেন, পাকিস্তানের দিকে চাকোঠি গ্রামের বেশিরভাগ কমবয়সী নারী আর শিশুরা সারা রাত কেঁদেছেন। বিবিসির তাবান্ডা কোকাবকে বলছিলেন ওই গ্রামের বাসিন্দা কিফায়াত হুসেইন। তিনি বলেন, ‘ওরা তো জীবনে এত বেশি গোলাবর্ষণ দেখেনি। এর আগে এত বেশী গোলাবর্ষণ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে, তখন তো শিশুরা কেউ জন্মায়নি।’
৬ মে রাতটা তিনি পরিবারকে নিয়ে একটা সিমেন্ট ঢালাই করা বাথরুমে বসে কাটিয়েছেন কিফায়াত।
চাকোঠিসহ পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বেশিরভাগ গ্রামের বাড়িতে ২০০৫ সালে ভূমিকম্পর পর থেকেই টিনের ছাদ দেওয়া হয়। ওই সব ছাদ গোলাগুলি একেবারেই আটকাতে সক্ষম নয়। কিফায়াত বলছিলেন, ‘গোলাগুলি শুরু হতেই সব বাসন আর অন্যান্য জিনিসপত্র মাটিতে আছড়ে পড়তে শুরু করল; আর শিশুরা খুব জোরে কাঁদতে শুরু করল।’
বাজারেও যাচ্ছি না
পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজফ্ফরাবাদে রয়েছেন বিবিসির ফারহাত জাভেদ। নিয়ন্ত্রণ রেখার ধারে নীলম উপত্যকা থেকে সম্প্রতি মুজফ্ফরাবাদ শহরে পরিবার নিয়ে চলে এসেছেন মুহাম্মদ শাগির। বাড়ির সামনে একটি ক্ষেপণাস্ত্র পড়ার পরেই তিনি পরিবারকে নিয়ে সরে আসেন। তিনি বলছিলেন, ‘বাচ্চারা, বিশেষ করে শিশুরা ব্যাপক ভয় পেয়ে গিয়েছিল।’
মুহাম্মদ শাগির বলেন, ‘আমরা ওদের শুধু বোঝাচ্ছিলাম যে, একটা নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাব। রাতটা খুব ভয়াবহ ছিল। পরের দিন সকালেই আমি বাচ্চাদের নিয়ে পাশের শহরে বোনের বাড়িতে চলে যাই।’
মুহাম্মদ শাগির অবশ্য এখনও শহর ছেড়ে যাননি, তবে তার পরিবার ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখেছে, যদি কিছু হয় তাহলে যাতে সঙ্গে সঙ্গেই পালাতে পারেন তারা। তার কথায়, ‘আগে থেকে তো বলা যায় না কখন কী হয়। আমরা শহরে থাকি; আর চারদিকে প্রচুর সামরিক স্থাপনা রয়েছে। আমরা তো বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি না, এমনকি বাজারেও যাচ্ছি না।’