জুতার কারখানায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ লোটো বাংলাদেশের
Published: 19th, May 2025 GMT
প্রায় দেড় যুগ আগের কথা। গাজীপুরের টঙ্গীতে ১০ হাজার বর্গফুটের ছোট্ট একটি কারখানায় জুতা তৈরি শুরু করেছিল দেশীয় প্রতিষ্ঠান এক্সপ্রেস লেদার প্রোডাক্টস। যেটি লোটো বাংলাদেশ নামেই বেশি পরিচিত। সে সময় পুঁজি ছিল ১৫ লাখ টাকা ও কর্মী মাত্র ৩৫ জন। সেই প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। এখন ৯০ হাজার বর্গফুট জায়গায় পণ্য তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি; আর সেখানে কাজ করছেন দুই হাজার মানুষ।
সম্প্রতি নিজেদের কার্যক্রম আরও বড় করার উদ্যোগ নিয়েছে লোটো। সে জন্য গাজীপুরের কাপাসিয়ায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে নিজস্ব কারখানা নির্মাণ শুরু করেছে তারা। গতকাল রোববার কাপাসিয়ার আমরাইদ বাজার এলাকায় নতুন এই কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। একই অনুষ্ঠানে লোটোর তৈরি সুপার লাইট নামের নতুন একটি মডেলের জুতার মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, বর্তমানে পণ্য বিক্রি করে বছরে সব মিলিয়ে ৩০০ কোটি টাকার বেশি আয় করছে লোটো। নতুন কারখানা চালু হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের আয় ৮০০ কোটি টাকা ছাড়াবে। নতুন এই কারখানায় এক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এ ছাড়া স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি রপ্তানির পথও সুগম হবে।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এক্সপ্রেস লেদার প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী জামিল ইসলাম, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের প্রধান নির্বাহী নাজিত মিওয়ানাগ, ব্র্যাক ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) তারেক রেফাত উল্লাহ খান, প্রাইম ব্যাংকের এএমডি ফয়সাল রহমান, গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার চৌধুরী মোহাম্মদ জাবের সাদিক, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ রিয়াজুল হান্নান প্রমুখ।
যেভাবে শুরু২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় লোটোর। শুরুতে সাবকন্ট্রাকটিং (ঠিকায় কাজ) ভিত্তিতে অন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য জুতা বানাত তারা। ২০১১ সাল থেকে লাইসেন্স চুক্তির মাধ্যমে দেশেই ইতালির লোটো ব্র্যান্ডের পণ্য তৈরি ও বিপণন করছে তারা। শুধু চামড়াজাত পণ্য নয়, তৈরি পোশাক খাতেও প্রবেশ করেছে এক্সপ্রেস লেদার। ২০১৯ সাল থেকে তারা ব্রিটিশ কোম্পানি লি-কুপারের হয়ে পোশাক তৈরি করছে। পাশাপাশি রয়েছে নিজস্ব পোশাক ব্র্যান্ড ‘দ্য এক্সপ্রেস’। বর্তমানে ইতালি, স্পেনসহ কয়েকটি দেশে সীমিত আকারে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে তাদের।
নিজেদের পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকে আরও বিস্তৃত করতে এবার নতুন বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে এক্সপ্রেস লেদার। সে জন্য কাপাসিয়ায় প্রায় ২৫ বিঘা জায়গায় একটি শিল্প পার্ক গড়ে তুলছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে প্রায় আড়াই লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে কারখানা নির্মাণ করা হচ্ছে। কারখানাটিতে জুতা, তৈরি পোশাক ও বিভিন্ন ধরনের উপকরণ (অ্যাকসেসরিজ) তৈরির তিনটি পৃথক উৎপাদন লাইন থাকবে। এই প্রকল্পে মোট বিনিয়োগ করা হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। আগামী দুই বছরের মধ্যে নতুন কারখানাটি উৎপাদনে আসবে বলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান।
২৪ হাজার কোটি টাকার বাজারঅনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশে ১৮ কোটি মানুষের জন্যই জুতা প্রয়োজন হয়। এটি অনেক বড় বাজার। যদিও দেশে জুতার বাজার নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন জরিপ থেকে অনুমান করা হয়, স্থানীয় জুতার বার্ষিক বাজার ২২ থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে ৩০-৪০ শতাংশ আসে ব্র্যান্ডের জুতা থেকে। শীর্ষ কোম্পানির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এপেক্স, বাটা ও লোটো। এ ছাড়া বছরে প্রায় ১১১ কোটি ডলারের জুতা রপ্তানি হয়।
বিশাল এ বাজারে নিজেদের হিস্যা বাড়াতে চায় এক্সপ্রেস লেদার। বর্তমানে টঙ্গীর কারখানায় প্রতি মাসে আট লাখ জোড়া চামড়ার জুতা, স্যান্ডেল ও স্লিপার তৈরি হয়। এ ছাড়া চামড়ার ব্যাগ, ওয়ালেট ও বেল্ট, স্কুল ব্যাগ ও ব্যাকপ্যাক এবং ইনসোল ও মোজার মতো বিভিন্ন উপকরণ তৈরি হচ্ছে। নতুন কারখানায় এ উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বাড়তে পারে বলে আশা প্রতিষ্ঠানটির।
২০১২ সালে রাজধানীর উত্তরায় প্রথম আউটলেট বা বিক্রয়কেন্দ্র দিয়েছিল এক্সপ্রেস লেদার। বর্তমানে সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির ২২০টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কোম্পানিটি আরও দুই শতাধিক নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র, ২০০ ফ্র্যাঞ্চাইজি এবং ৫ হাজারের বেশি সরবরাহকারী বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছে এক্সপ্রেস লেদার। ওই চীনা প্রতিষ্ঠান জুতা তৈরিতে তাদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সেবা দেবে। এ ছাড়া একই অনুষ্ঠানে ‘সুপার লাইট’ নামের নতুন মডেলের জুতার উদ্বোধন করা হয়, শিগগিরই এটি বাজারে আসবে।
এক্সপ্রেস লেদার প্রোডাক্টসের এমডি কাজী জামিল ইসলাম বলেন, টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলার–সংকটের কারণে গত দু-তিন বছরে উৎপাদন ব্যয় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে এই সময়ে বেশ কিছু নতুন যন্ত্র আমদানি করে দেশে উৎপাদন দক্ষতা বাড়িয়েছে এক্সপ্রেস লেদার। এ কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও পণ্যের দাম অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে।
কাজী জামিল ইসলাম আরও বলেন, ‘দেশে সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীল সরকার প্রয়োজন। আমরা প্রধানত স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য তৈরি করি। ফলে রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো প্রণোদনা পাই না। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে নীতি সহায়তা পেলে আমরা আরও সামনে গিয়ে যেতে পারব।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নেতৃত্বের ঘাটতিতে গণঅভ্যুত্থানের বৈপ্লবিক সম্ভাবনা কাজে লাগেনি
অর্থনীতিবিদ ও লেখক ড. মাহবুব উল্লাহ্ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। পাশাপাশি ১৯৯৩-৯৭ মেয়াদে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য এবং ২০০৩-২০০৬ মেয়াদে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া বিআইডিএস, রেভিনিউ রিফর্মস কমিশন এবং উচ্চশিক্ষা বিষয়ক কৌশলপত্র প্রণয়ন কমিটিতে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর, ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৯০ সালে ভারতের জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মাহবুব উল্লাহ্র জন্ম ১৯৪৫ সালে, নোয়াখালীতে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন।
সমকাল: গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। প্রথমে এই এক বছর নিয়ে কিছু বলুন, বিশেষ করে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে।
মাহবুব উল্লাহ্: একটা গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসাব মেলানো বাস্তবসম্মত নয়। দুনিয়ার কোথাও এমন উদাহরণ পাবেন না। ৩০ বছর যুদ্ধ চালিয়ে ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে মাও সে তুং চীন বিপ্লবের বিজয় ঘোষণা করতে গিয়ে বলেছিলেন, চীনা জনগণ উঠে দাঁড়িয়েছে। কথাটা সঠিক ছিল। কিন্তু ১৯৫০ সালে যদি আপনি ওই বিপ্লবের অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইতেন, তাহলে তেমন কিছুই পেতেন না। ভূমি সংস্কার সবে শুরু হয়েছে, যা এক কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছিল। ওই উঠে দাঁড়াতে চীনাদের বহু বছর লেগেছে।
সমকাল: ১৯৫০ সালে তো চীনে অন্তত বোঝা যাচ্ছিল, ক্ষমতাটা কার কাছে আছে; রাষ্ট্র কোন দিকে যাচ্ছে। এখন কি তা বোঝা যায়?
মাহবুব উল্লাহ্: আমি আমাদের গণঅভ্যুত্থানকে চীন বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করতে রাজি নই। বিষয়টা প্রসঙ্গক্রমে আনলাম। বিশেষ করে অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানকালীন সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ আমরা দেখেছি। এ জনরোষ চীন বিপ্লবের পরও দেখা গিয়েছিল। তবে দুটির প্রকাশের ধরনকে আমি তুলনা করতে পারছি না। চীনে জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। তবে সেখানেও একটা শৃঙ্খলা ছিল, যা আমাদের এখানে নেই। চীনে কৃষকরা গণআদালত বসিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। পার্টির সংগঠন গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছিল। আমাদের এখানে একটা চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। যাকে বলা হচ্ছে মবোক্রেসি। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে চীনা জনগণের পরিচয় ছিল ১৯২১ সাল থেকে; প্রায় ২৯ বছরের। মানুষ জানত– বিপ্লব তাদের কোথায় নিয়ে যাবে, যা আমাদের এখানে কল্পনাতীত। সেখানে ছিলেন মাও সে তুং, চৌ এনলাইয়ের মতো নেতা, যাদের ধীশক্তি, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। এমন নেতা আমাদের এখানে কেবল এ অভ্যুত্থান কেন, কখনোই জন্মগ্রহণ করেনি। আমি যে বলেছি, এক বছর গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসাব মেলানোর জন্য যথেষ্ট নয়, তার কারণ এখানে সেই ধরনের সুঠাম নেতৃত্ব নেই।
সমকাল: এ গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির মতো একটা প্রতিষ্ঠিত দল ছিল। প্রকাশ্যে ঘোষণা না দিলেও সর্বত্র তাদের অবস্থান ছিল। তারপরও এমন কথা কেন বলছেন আপনি?
মাহবুব উল্লাহ্: আপনি বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত দল বলছেন; তবে আমি তেমনটা মনে করি না। এটা সত্য, বিগত কয়েক দশক এ দেশে একটা দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল– একদিকে আওয়ামী লীগ আরেকদিকে বিএনপি। উভয় দলের ভোটের হিসাব কাছাকাছি। যে যখন জিতেছে সে তখন ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। আবার যখন হেরেছে তখন তা ৪০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। সাংগঠনিকভাবেও এরা সারাদেশেই বিস্তৃত। তবে আপনারা যেমনটা মনে করেন, বিএনপি সেভাবে সংগঠিত বলে আমি মনে করি না। তার একটা বড় দুর্বলতা হলো, নাগরিক সমাজের মধ্যে তার অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। ক’জন লেখক, ক’জন নামকরা সাংবাদিক, ক’জন কবি, ক’জন বিজ্ঞানী, ক’জন ইতিহাসবিদ বা সমাজতত্ত্ববিদ তাদের দলের সঙ্গে আছে? তুলনামূলক আওয়ামী লীগের তা অনেক বেশি ছিল। তবে বুদ্ধিবৃত্তির জগতের সেই লোকেরা সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেনি বলেই আওয়ামী লীগের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে। বুদ্ধিজীবীর স্বাধীন ভূমিকা তারা রাখতে পারেনি। আমি বহু বছর বিএনপিকে কাছ থেকে দেখছি। দলটির কর্মীরা এমনকি রাজনৈতিক শিক্ষাও যথাযথভাবে পায়নি। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সেমিনার, কর্মশালা হচ্ছে ঠিক। কিন্তু এগুলো ধারাবাহিকভাবে না হলে স্তরে স্তরে দলীয় আদর্শ ভালোভাবে ছড়ায় না। আর এগুলোর মালমসলা আসে প্রধানত লেখালেখি, বইপত্র ইত্যাদি থেকে, যা করার কথা বুদ্ধিজীবীদের। সেটাও তেমন দেখা যায় না। প্রধানত আবেগের বশে কর্মীরা দলে আছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি তাদের ভালোবাসা অনেক। এ ধরনের নেতাকর্মী দিয়ে রাজনৈতিক গতিবিধি প্রভাবিত করা যায় না। দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রচুর অপকর্মের অভিযোগ আসছে। ফলে আওয়ামী লীগ চলে যাওয়ার পর বিএনপির ওপর সাধারণ মানুষ যেভাবে ভরসা করতে পারত, তা হচ্ছে না। আমি নিজেও উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতিতে।
সমকাল: আপনি কি মনে করেন না, বিএনপি সরকারকে ঠিক ধারায় রাখার জন্য কাজ করছে?
মাহবুব উল্লাহ্: অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি নেতারা এতদিন যা করেছে, তা নিয়েও আমার কথা আছে। তারা এ সরকারের বিরুদ্ধে এতদিন যে ভাষায় কথা বলেছে, তা মাঝে মাঝে অসৌজন্যমূলক পর্যায়েও চলে যেত। এগুলো কিন্তু তাদের কোনো লাভ বা ডিভিডেন্ড দেয়নি। তারা যদি ঠান্ডা মাথায় সরকারের কাছে তাদের কথাগুলো পেশ করত তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। সেগুলো হৃদয়গ্রাহী হতো, জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতো। সম্ভবত এসব দেখেই খালেদা জিয়া একলাইনে একটা মন্তব্য করলেন, এ সরকারের বিরোধিতা করে আমাদের কী লাভ? এর পরই আমরা পরিস্থিতি পাল্টাতে দেখলাম। বিএনপি কিছুটা সংযত আচরণ করছে– কথাবার্তা ও উচ্চারণে।
সমকাল: সংস্কার নিয়ে যে আলোচনা চলছে সেটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাহবুব উল্লাহ্: সংস্কার নিয়ে আমার একটা ভিন্নমত আছে। আপনি একটা ১০তলা বা পাঁচতলা দালান করতে চান, সেটা তো একটা ভিতের ওপর করতে হবে। ভিতটা যদি পোক্ত না হয়; ভার বহনের উপযুক্ত না হয়, তাহলে তা তৈরি হলেও অচিরেই ভেঙে পড়বে। সংস্কারের জন্যও অনুরূপ ভিত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা রাষ্ট্র ও সমাজে যে সংস্কার করতে চাই সেগুলো বিশ্বের যেসব দেশে ইতোপূর্বে হয়েছে সেসব দেশের আর্থসামাজিক ভিত কি আমাদের মতো ছিল? আমাদের আর্থসামাজিক ভিত কিন্তু অত্যন্ত দুর্বল। বড় ধরনের কোনো কিছু গ্রহণ করার অনুপযোগী বাংলাদেশের সমাজ– এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এখানে এক সময় উঠতি মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটেছিল, যাদের কণ্ঠস্বর বেশ উঁচু ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে– শেখা হাসিনার ১৫ বছর শুধু নয়, তারও আগে থেকে এখানে এমন একটা বিশ্রি শ্রেণি গড়ে উঠেছে, রাশিয়ার অনুকরণে যাদের বলা হচ্ছে অলিগার্ক। মাফিয়াতন্ত্রও আছে এখানে। দেশের আসল ক্ষমতা এদের হাতে। সমাজটাকে তারা টাকা দিয়ে কলুষিত করে ফেলেছে। টাকা হলো এখন সামাজিক মর্যাদাসহ সবকিছুর মাপকাঠি। এ পরিস্থিতিতে সমাজটাকে আপনি একটু সভ্য-ভব্য করবেন, তা সম্ভব নয়। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বোঝা যাবে।
সমকাল: কেমন সে উদাহরণ?
মাহবুব উল্লাহ্: উদাহরণ অনেক আছে। যেমন আফগানিস্তানের কথা বলা যায়। সেখানে ১৯১৯ সালে আমান উল্লাহ তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের পর আমির হন এবং ১৯২৬ সালে নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেন। তিনি চরম রক্ষণশীল দেশটাকে ইউরোপের ধাঁচে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। নারীরা কেমন পোশাক পরবে, তার উদাহরণ হিসেবে তিনি তাঁর রানীকে পশ্চিমা স্কার্ট ইত্যাদি পরিয়ে বাইরে চলাফেরা করতে বলেন। অচিরেই তিনি হাবিবউল্লাহ কালাকানি নামে ডাকাত ধরনের এক লোকের হাতে উৎখাত হন। বাংলাদেশ নিশ্চয় আফগানিস্তানের সঙ্গে তুল্য নয়। এখানে শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার, এখানকার আলোকিত শ্রেণি ইত্যাদি কারণে। তারপরও আমাদের সমাজের ভিতটা অলিগার্ক বা মস্তানদের হাতে। এদেরকে স্পষ্টভাবে, একেবারে ধরে ধরে একটা একটা করে উচ্ছেদ না করে কোনো টেকসই সংস্কার আপনি করতে পারবেন না। বলা হচ্ছে, আমরা এমনভাবে সংস্কার করছি যাতে ফ্যাসিবাদ আর ফিরে না আসে। কিন্তু আর্থসমাজািক কাঠামো যদি দুর্বল, পচাগলা থেকে যায়, তাহলে সংস্কার টিকবে কীভাবে এখানে? এ ভিতের ওপর আপনি যতই সংস্কার করুন, দেখা যাবে কয়েক বছর পর আরেকটা রূপে ফ্যাসিবাদ আবার জেঁকে বসবে।
সমকাল: তাহলে তো আবারও গণঅভ্যুত্থান হতে হবে?
মাহবুব উল্লাহ্: সে তো লাগবেই। বদরুদ্দীন উমর বলেছেন না– এখানে অতীতে যেমন বহু গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, ভবিষ্যতেও তা হবে। যতদিন পর্যন্ত প্রজ্ঞাবান ও দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব না আসবে, ততদিন এখানে স্থিতিশীলতা আপনি আশা করতে পারেন না। এক প্রকার গণঅভ্যুত্থানের ১০ বছরের চক্রে পড়ে যাবে দেশ। আপনি ইতিহাসের দিকে তাকান না। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন হলো; রাষ্ট্রভাষা বাংলা স্বীকৃতি পেতে ৫৬ সাল লাগল। ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট যে ২১ দফা দিয়েছিল, তার কয় দফা কার্যকর হয়েছিল? ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের ফল কী? শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন দেখেন? ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ১১ দফার কী হয়েছিল? কয়টা দফা ওই অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় যে মুক্তিযুদ্ধ হলো, দেশ স্বাধীন হলো, সেই স্বাধীন দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে? খোদ মুক্তিযুদ্ধই কি এক পর্যায়ে হতাশ করেনি? ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান তো গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থেকেই হয়েছিল। আমরা কি শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে পেরেছি?
সমকাল: এবারের গণঅভ্যুত্থান তো অতীতের চেয়ে ভিন্ন।
মাহবুব উল্লাহ্: ত্যাগের দিক থেকে, গভীরতার দিক থেকে, মানুষের সাহসের দিক থেকে এবারের গণঅভ্যুত্থান সত্যিই অনন্য। মানুষের আকাঙ্ক্ষা এখানে বিশাল। কিন্তু এ আকঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যে ধরনের নেতৃত্ব, রাজনীতি, চিন্তাভাবনা, দর্শন দরকার ছিল, তার ভীষণ অভাব আমি দেখছি। সময়ের এ আহ্বানে সাড়া দেওয়ার যোগ্যতা আমাদের বর্তমান নেতৃত্বের নেই বলে আমি মনে করি।
সমকাল: নতুন যে নেতৃত্ব; আমি ছাত্রদের কথা বলছি, যাদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানটি হলো, তাদের নিয়ে তো মানুষ স্বপ্ন দেখেছে। আপনি কী মনে করেন?
মাহবুব উল্লাহ্: আমিও ভেবেছিলাম, তারা দিশা দেখাবে। তাদের কিছু কথাবার্তাও আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু সেগুলোকে তারা সেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, আপনি চট করে নেতা হতে পারবেন না। সে জন্য সময় লাগবে। সে সময়টার আগেই তারা নেতা হয়ে যাচ্ছে। কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে আমি তাদের তুলনা করব না। তবে ফিদেল অল্প বয়সেই বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করেন। তাঁকে চার-পাঁচ বছর সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাঁর দর্শন, ইতিহাসবোধ কত উঁচু– সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁকে যখন ১৯৫৩ সালে মনকাদা সেনাছাউনিতে হামলার পর একটা দ্বীপে নিয়ে বিচার করা হয়। তখন আদালতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি, সেটা অনন্য; সব দিক দিয়েই। ‘ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে’ শিরোনামের সেই ভাষণ আমি বহুবার পড়েছি। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের তরুণরা যা করেছে, নিঃসন্দেহে তা বিরাট কিছু। তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো শেখ হাসিনার মতো ভয়ংকর এক শাসককে তারা শুধু পদত্যাগ নয়; দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। পুলিশ বাহিনী থানা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্যে একটা বিপ্লবী সম্ভাবনা ছিল বলে আমি মনে করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেখানে কোনো বিপ্লবী নেতৃত্ব ছিল না।
সমকাল: সামনের দিনগুলোতে তাহলে কী দেখছেন আপনি?
মাহবুব উল্লাহ্: সেই বিপ্লবী সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়নি বলেই আমরা এখন ভিন্ন কিছু দেখছি। যতই দিন যাচ্ছে ততই রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ছে। কে কাকে পরাজিত করবে– এ প্রতিযোগিতা চলছে। দেখলাম, ইসলামী সংগঠনগুলো একত্রিত হচ্ছে বিএনপিকে পরাজিত করার জন্য। এর মধ্যে দেশের ভালো কীভাবে হতে পারে, সেটা বের হবে কীভাবে? দেশের ভালো কী করে করা যায়– তা নিয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক নেই।
সমকাল: নির্বাচন নিয়ে তো একটা বিতর্ক হচ্ছে। বিএনপি বলছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন; এনসিপি ও অন্য কয়েকটা দল বলছে গণপরিষদ নির্বাচন।
মাহবুব উল্লাহ্: ব্যক্তিগতভাবে আমি নতুন করে সংবিধান রচনার পক্ষে। কাটাছেঁড়া করে আর কত? তবে এখন তা সম্ভব নয়। বর্তমান সংবিধান বাতিল করে তা হতে পারে, কিন্তু এর জন্য ঐকমত্য নেই। সোজা কথা, আমরা এক গভীর সংকটে আছি। মানুষের একটা ধারণা ছিল, রাজনীতিবিদরা খুব বেশি লেখাপড়া করেন না; জ্ঞান চর্চা করেন না। আমাদের সংকটের উৎস এখানে। তাই এবার যাদের সরকারের পাঠানো হলো তারা সবাই জ্ঞানী; লেখাপড়া জানা মানুষ। কিন্তু তাদের কেউই রাজনীতির ধারেকাছে ছিলেন না কোনোদিন। আর এমন এক পরিস্থিতিতে তারা দায়িত্ব নিয়েছেন যেখানে সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে। একেবারে বিধ্বস্ত একটা পরিস্থিতি। তাদের অগ্রাধিকার হতে পারত প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড় করিয়ে একটা নির্বাচন দিয়ে চলে যাওয়া। জাতির কাছে একটা সংস্কারের ফর্দ রেখে যাওয়া। এখন হয়ে গেছে– আর্ট ইজ লং, টাইম ইজ শর্ট।
সমকাল: শেষ কথা কী বলবেন?
মাহবুব উল্লাহ্: আমি বলেছি, আমরা গভীর এক সংকটে আছি। এ সংকট শুধু গণতন্ত্রের নয়; স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বেরও সংকট। এ থেকে উদ্ধারের জন্য প্রকৃষ্ট মাঝিমাল্লা দরকার। আমরা সেই মাঝিমাল্লার অপেক্ষায় আছি।