মাত্র তিন সপ্তাহ আগে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে যে সামরিক অভিযানটি চালিয়েছে, তাতে পাকিস্তানের ভেতরে থাকা ৯টি জঙ্গিঘাঁটি ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। এই অভিযান কেমন ছিল, তা বিশ্লেষণ করলে কিছু বিষয় স্পষ্ট হতে পারে। 

প্রথমেই বলা যায়, ভারত জোরালোভাবে আঘাত করলেও সবকিছু খুব হিসাব করে করা হয়েছিল। হামলাগুলো ছিল নির্দিষ্ট জায়গায়, শুধু টার্গেট করা স্থাপনায়। যেন সাধারণ মানুষের ক্ষতি না হয়, সে জন্য রাতের বেলা অভিযান চালানো হয়। অপারেশন সিঁদুর ছিল সামরিক দিক থেকে এক বড় সাফল্য।

পাকিস্তান হামলার সময় পুরোপুরি সজাগ ছিল। তারপরও ভারত তাদের প্রতিরক্ষা ভেঙে নির্দিষ্ট জায়গায় আঘাত হানে এবং কয়েকজন পরিচিত জঙ্গিকে হত্যা করে। পরে এই জঙ্গিদের জানাজায় পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারাও অংশ নেন। 

আরও পড়ুনপাকিস্তানে হামলা করে ভারতের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হলো২৯ মে ২০২৫

এই অভিযানে ভারত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জায়গায় হামলা চালিয়েছে। তবে শুরুতে ভারত ইচ্ছা করেই পাকিস্তানের সেনাঘাঁটি বা সরকারি কোনো স্থানে হামলা করেনি। এর মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে, এটি যুদ্ধ নয়; বরং এটি জঙ্গি হামলার জবাব। কিন্তু পরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিলে ভারতকেও আরও কঠোর হতে হয়।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি পরিষ্কার তা হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ধরন এখন বদলে গেছে। আগে ভারত সামরিক পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করত, কিন্তু এখন সেই দ্বিধা আর নেই।

এত দিন ধরে কাশ্মীর ইস্যু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার ভয়েই ভারত শুধু কূটনৈতিক পথে এগোচ্ছিল—নানা তথ্য-প্রমাণ পেশ করছিল, কিন্তু ফল মিলছিল খুব সামান্য। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সন্ত্রাসবিরোধী কমিটিও পাকিস্তানকে রক্ষা করত। কারণ, তাদের পক্ষে দাঁড়াত পরিষদের এক স্থায়ী সদস্য। ভারত এখন আর কেবল আন্তর্জাতিক কূটনীতির ওপর নির্ভর করবে না। কূটনীতি চালু থাকবে, কিন্তু তার সঙ্গে সশস্ত্র প্রতিক্রিয়াও থাকবে। 

আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি: মোদির ‘অপারেশন সিঁদুর’ কি হিতে বিপরীত হলো১১ মে ২০২৫ভারত প্রমাণ করেছে, পাকিস্তানের ভয় দেখানো আসলে ফাঁকা বুলি। ভারত বুঝতে পারছে, সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রিত সামরিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে জঙ্গিবাদের জবাব দেওয়া সম্ভব। তাতে পারমাণবিক যুদ্ধ বাধবেই, এমন ভাবনার কোনো ভিত্তি নেই। এখন থেকে যদি পাকিস্তান আবার কোনো জঙ্গি হামলা ঘটায়, তাহলে ভারত তার জবাবে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান চালাবে। অপারেশন সিঁদুরের মধ্য দিয়ে ভারতের দিক থেকে এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে।

তৃতীয় বিষয় হলো, ভারত আর পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিতে ভীত থাকবে না। পাকিস্তান অনেক দিন ধরেই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিবেশী ও বিশ্বকে চাপে রাখত। কিন্তু ২০১৬ সালের সীমান্ত পেরিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, ২০১৯ সালে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া অঞ্চলে বিমান হামলা এবং সর্বশেষ অভিযান—সব মিলিয়ে ভারত দেখিয়েছে, তারা এখন নিয়ন্ত্রণরেখা বা আন্তর্জাতিক সীমানা মানছে না। এবার তো পাকিস্তানের ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ অংশেও আঘাত হেনেছে।

আরও পড়ুনশক্তি দেখাতে গিয়ে ভারতের দুর্বলতা বেরিয়ে এল কি?১৩ মে ২০২৫

এভাবে ভারত প্রমাণ করেছে, পাকিস্তানের ভয় দেখানো আসলে ফাঁকা বুলি। ভারত বুঝতে পারছে, সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রিত সামরিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে জঙ্গিবাদের জবাব দেওয়া সম্ভব। তাতে পারমাণবিক যুদ্ধ বাধবেই, এমন ভাবনার কোনো ভিত্তি নেই। এখন থেকে যদি পাকিস্তান আবার কোনো জঙ্গি হামলা ঘটায়, তাহলে ভারত তার জবাবে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান চালাবে। অপারেশন সিঁদুরের মধ্য দিয়ে ভারতের দিক থেকে এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে।

এখন থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখনই তাদের মদদপুষ্ট জঙ্গিদের কাশ্মীর বা ভারতের অন্য কোথাও হামলার জন্য পাঠানোর কথা ভাববে, তখনই তাদের ভাবতে হবে, এই হামলার জন্য ভারতের শক্তিশালী সামরিক পাল্টা আঘাত তারা মোকাবিলা করতে পারবে কি না। 

এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, ভারত এবার পানি নিয়েও বার্তা দিয়েছে। অপারেশন সিঁদুর শুরুর ঠিক আগেই ভারত জানিয়ে দেয়, তারা এখন সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত রাখবে। যদিও ভারত এখনো সেই পানির ধারা সরিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো বাঁধ বা জলাধার বানায়নি, তবু এই ঘোষণা উপমহাদেশের ভূরাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

আরও পড়ুনভারত–পাকিস্তানের হাতে পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়ংকর অস্ত্র ২৮ মে ২০২৫

ভারত এখন আর শান্তির বিনিময়ে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে রাজি নয়। তারা স্পষ্ট বলছে, যদি সন্ত্রাসবাদ বন্ধ না হয়, তাহলে পানি সরবরাহও প্রশ্নের মুখে পড়বে। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার জন্য এই পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—সেই বিষয়কেই এখন ভারত কৌশলগতভাবে সামনে এনেছে।

এই অভিযানের আরেকটা বড় উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকে দেখানো যে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত এবং তারা পারমাণবিক অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চলাফেরা করতে চায়। সামনে হয়তো যুদ্ধবিরতি কীভাবে হলো, তা নিয়ে অনেক তথ্য বের হবে। কিন্তু এখনই একটা জিনিস স্পষ্ট—ভারত যদি সামরিকভাবে চাপ না দিত, তাহলে এই যুদ্ধবিরতি হতো না। আর পাকিস্তান যখন হামলা থামিয়েছে, তখনই ভারতও তাদের অভিযান বন্ধ করেছে। এতে বোঝা যায়, ভারত যুদ্ধ করতে চায় না, কিন্তু কেউ জঙ্গি হামলা করলে তার জবাব দিতে দিল্লি পিছপা হবে না। 

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক শিগগিরই বদলে যাবে, এমন সম্ভাবনা কম। বিশেষ করে কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো আলোচনার সুযোগ এখন অনেক দূরের বিষয়। আসলে কাশ্মীরই যে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের মূল কারণ বা সমাধান—এটি একটি ভুল ধারণা।

আরও পড়ুনভারত হামলা চালিয়ে যেভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দিল২০ মে ২০২৫

এই ধারণা মূলত পাকিস্তান উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়িয়ে থাকে, যাতে ভারতের একটি অংশের ওপর অধিকার দাবি করা তাদের জন্য সহজ হয়। আসলে এই ধারণা একধরনের ধর্মভিত্তিক চিন্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরও বলেছেন, মুসলমানরা নাকি অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে থাকতে পারে না।

পাকিস্তান এই মানসিকতা না বদলালে ভারতকে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যদিও ভারত মূলত যুদ্ধ নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার দিকেই মন দিয়েছে। তবু নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যাবে না, পাকিস্তানে শুভবুদ্ধি কাজ করে যাবে। 

ভারত এরই মধ্যে দেখিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানের উসকানির জবাব দিতে তারা প্রস্তুত। তবে সামনে ভারতকে আরও প্রস্তুতি নিতে হবে। সামরিক শক্তি বাড়াতে হবে। কূটনৈতিক দুর্বলতা দূর করতে হবে। দেশের ভেতরের নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে হবে। নাগরিকদেরও মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে।

স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের তুলনায় ভারত অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। ভারতের মোট অর্থনীতি পাকিস্তানের চেয়ে ১১ গুণ বড়। সামরিক শক্তিও অনেক বেশি। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটির ভেতরে খুব প্রভাবশালী। তারা নিজেদের মতো করে বাজেট ঠিক করে। বড় বড় দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের পুরোনো সম্পর্ক আছে।

চীন ও তুরস্কের সঙ্গে তাদের সামরিক জোটও রয়েছে। এই জোটের কারণে পাকিস্তান দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। এখনো তারা তুরস্কের ড্রোন আর চীনের তৈরি যুদ্ধবিমান (যেমন জে-১০ সি) এবং গাইডেড মিসাইল (যেমন পিএল-১৫) দিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে এবং ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে ভারত শেষ পর্যন্ত জিতবে ঠিকই, কিন্তু পাকিস্তানও বড় ক্ষতি করতে পারে।

শশী থারুর ভারতের লোকসভায় কংগ্রেস পার্টির এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ত ত ত র সব র ভ তর র জন য ক টন ত আরও প

এছাড়াও পড়ুন:

৮ বছরেও শুরু হয়নি কুবির ২ বিভাগের কার্যক্রম

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) দীর্ঘ ৮ বছর আগে অনুমোদন পাওয়া দুটি বিভাগ এখনো চালু হয়নি। অনুমোদন সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমের ধীরগতির কারণে বিভাগ দুটি কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ‘বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ’ এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অধীনে ‘মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ চালুর অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকেই বিভাগ দুটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত ও শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে নতুন অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণের পরে বিভাগ দুটি চালুর পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে নতুন ভবন নির্মাণ হয়নি।

আরো পড়ুন:

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় কুবি প্রক্টরের জরুরি নির্দেশনা 

সিএনজি চালকের বিরুদ্ধে কুবি শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ

এছাড়া, তৎকালীন অর্গানোগ্রামে ৩১টি বিভাগের মধ্যে এই দুইটি বিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল না, যা পরবর্তীতে চালু করা নিয়ে জটিলতা তৈরি করে।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গে বৈঠক করে এই বিষয়ে পুনরায় আলোচনা করে। ইউজিসি নির্দেশনা অনুযায়ী, নতুন অর্গানোগ্রামে বিভাগের অন্তর্ভুক্তি ও নতুন বিভাগের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

সে অনুযায়ি ১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কুবির ৮৯তম অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল মিটিংয়ে পূর্বের ‘মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ এর পরিবর্তে ‘লজিস্টিক্স ও মার্চেন্ডাইজিং বিভাগ’ এবং ‘বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ’-এর পরিবর্তে ‘পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ’ নামে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও অর্গানোগ্রামে নতুন আরও ১৮টি বিভাগের নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

তৎকালীন বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রস্তাবক রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমান বলেন, “২০১৭ সালে অনুমোদন থাকলেও জায়গা সংকটের কারণে বিভাগ চালু করা সম্ভব হয়নি। পরে প্রশাসন পাল্টালেও কেউ উদ্যোগ নেয়নি।”

এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, “অর্গানোগ্রামে অন্তর্ভুক্তি মানে এখনই চালু হবে না। অনুমোদন থাকলেও তৎকালীন সময়ে চালু করা সম্ভব হয়নি। এখন ইউজিসি নির্দেশনায় নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, “তৎকালীন প্রশাসন বলতে পারবে কেন বিভাগ চালু হয়নি। আমরা সবার সঙ্গে আলোচনা মাধ্যমে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছি। আগামী ২ বছরের মধ্যে আশা করি বিভাগ চালু করা সম্ভব হবে, তখন নতুন ক্যাম্পাসও প্রস্তুত থাকবে।”

ঢাকা/এমদাদুল/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ