ফেব্রুয়ারিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সংস্কারের তাগিদ
Published: 17th, June 2025 GMT
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল সোমবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সরকারপ্রধান এ নির্দেশ দেন।
লন্ডনে গত শুক্রবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়েও কমিশনকে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সংস্কারে বিএনপির সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের চিন্তা, কথার কথা না। সংস্কার ও বিচারের অগ্রগতি সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে।’ সংস্কারের সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য কীভাবে হবে– এ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠক সূত্র সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে জড়িতদের ভূমিকা তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন সরকারপ্রধান। বহুল আলোচিত জুলাই সনদ, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সমকালকে বলেছেন, মঙ্গলবার (আজ) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ ফের শুরু হচ্ছে। কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
লন্ডন বৈঠক নিয়ে আলোচনা
গত বছরের ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এ ঘোষণায় অসন্তুষ্ট বিএনপি, নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিতে সোচ্চার ছিল। রোডম্যাপ না পেলে সরকারকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হবে কিনা– এ বিষয়ে চিন্তা করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সরকারের ওপর চাপ বাড়ায় বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো।
গত ৬ জুন প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে জানান, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। এ সময়সীমাকেও অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দেয় বিএনপি। সরকারের সঙ্গে দলটির বিরোধ আরও প্রকাশ্য হয়। তবে গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে সরকার ও বিএনপির সমঝোতা হয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে। বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সংস্কার এবং বিচারের অগ্রগতি হলে আগামী বছরের রমজানের সপ্তাহখানেক আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে।
গতকাল যমুনায় লন্ডন বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত জানান ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা ড.
মৌলিক সংস্কারে ঐকমত্য কীভাবে
বিএনপি সংস্কারে রাজি হলেও ভোটের অনুপাতে সংসদের উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনেরও বিরোধী। এই দুই বিষয়কেই মৌলিক সংস্কার বলছে ঐকমত্য কমিশন। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অধিকাংশ দল মৌলিক সংস্কার চায়। সংসদ ও সরকারের ক্ষমতা কমে যাবে– এই যুক্তিতে বিএনপি এতে রাজি হচ্ছে না।
রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকলেও ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, দলগুলোর মতভিন্নতা দূর করে আগামী মাসেই জুলাই সনদ সই করা হবে। এতে রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকার করবে, যেই ক্ষমতায় যাক সংস্কার বাস্তবায়ন করবে।
গতকাল যমুনার বৈঠকে কমিশন সদস্যরা জুলাই সনদ তৈরির অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে জানান। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘বেশকিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। শিগগিরই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সনদ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সবাই জুলাই সনদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আশা করি, আগামী জুলাই মাসের মধ্যে এটি জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারব।’
তবে কীভাবে ঐকমত্য তৈরি করা হবে, সংস্কারের সুপারিশগুলোর বিষয়ে কতগুলো রাজনৈতিক দল একমত হলে ঐকমত্য হয়েছে বলে বিবেচনা করা হবে– তা এখনও স্পষ্ট নয়। এখনও ঠিক হয়নি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের প্রক্রিয়া কী হবে। আলী রীয়াজ সমকালকে বলেছেন, ‘কতগুলো দল একমত হলে বা কী হলে ঐকমত্য হয়েছে বলে গণ্য করা হবে, এ বিষয়ে শিগগির ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।’
৩০টি রাজনৈতিক দল এবং জোটকে সংলাপে ডাকা হয়েছে। কমিশন সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, বড় দলগুলো যেসব বিষয়ে একমত হবে, সেগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দলকে বড় দল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যেসব বিষয়ে বড় দলগুলো একমত হবে না, সেসব বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মতামতকে ঐকমত্য হিসেবে বিবেচনা করার কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও বিএনপি আগেই জানিয়েছে, যেসব বিষয়ে সব দল একমত হবে, শুধু সেইসব বিষয়েই ঐকমত্য হয়েছে বলে বিবেচনা করতে হবে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো দলগুলো নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারে রাখতে পারে। ক্ষমতায় যেতে পারলে বাস্তবায়ন করতে পারবে।
৩ জুন দ্বিতীয় দফার সংলাপের প্রথম দিনে ৭০ অনুচ্ছেদ, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটি নিয়ে ঐকমত্য গঠনে ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোটের প্রতিনিধিদের আলোচনা হয়। প্রথম দিনের আলোচ্যসূচিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও সময় স্বল্পতায় তা হয়নি।
প্রথম তিন ইস্যুতেও আলোচনা অসমাপ্ত থাকে। সব দল ৭০ অনুচ্ছেদ শিথিলে রাজি হয়েছে। তবে বিএনপি চায় জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিলেও দলীয় এমপিরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন না। এনসিপি চায় সংবিধান সংশোধনে এমপিরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন।
নারী আসনের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিএনপি এবং এনসিপি রাজি। এনসিপি সরাসরি নির্বাচন চাইলেও বিএনপি চায় বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে দলগুলোর মধ্যে নারী আসন বণ্টিত হবে। শর্ত সাপেক্ষে নারী আসন বৃদ্ধিতে একমত জামায়াত চায়, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে নারী আসন বণ্টিত হবে। ইসলামী আন্দোলনসহ ডানপন্থি দলগুলো নারী আসন বৃদ্ধির পক্ষে নয়। তবে তারাও চায় ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন।
বিএনপিসহ অধিকাংশ দল চারটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিরোধী দলকে দিতে একমত হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি বিরোধী দলকে দেওয়া হবে কিনা– এ সিদ্ধান্ত পরবর্তী সংসদে নিতে চায় বিএনপি।
আজ শুরু হতে যাওয়া তিন দিনের সংলাপে এই তিন সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে আলোচনা হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, জেএসডি, গণসংহতি আন্দোলনসহ অধিকাংশ দল চায় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে। বিএনপি চায় সংসদের নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে।
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বলছে, ভোটের আনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠনের সুপারিশে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, তারা আগের অবস্থানেই রয়েছেন। তবে যদি কোনো গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব আসে, বিএনপি বিবেচনা করবে।
জামায়াত, এনসিপিসহ অন্যান্য দল চায় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি হবেন প্রধান বিচারপতি। বিএনপি চায় জ্যেষ্ঠতম তিনজনের মধ্য থেকে একজন থেকে প্রধান বিচারপতি। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, সংখ্যাটি দুইয়ে নামিয়ে এনে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অতীতে দায়ীদের শাস্তি প্রসঙ্গ
গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, প্রশাসন একটি দলের কুক্ষিগত হওয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন করা দুরূহ। সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না হলে তিনি দায়িত্বে থাকতে চান না জানিয়ে বলেন, নির্বাচনে কারচুপি হলে তাঁর সারাজীবনের অর্জন শেষ হয়ে যাবে দুনিয়ার সামনে।
সূত্র জানিয়েছে, লন্ডনের বৈঠকেও ড. ইউনূস সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা জানান। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বিএনপিরও ক্ষতি হবে বলে সতর্ক করেন। তারেক রহমান সরকারপ্রধানকে আশ্বস্ত করেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপি সহযোগিতা করবে। ‘লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
গতকাল যুমনার বৈঠকেও সুষ্ঠু নির্বাচনের আলোচনা আসে। বৈঠকে বলা হয়, আগামী দিনে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে অতীতে যারা বিতর্কিত নির্বাচন করেছেন, তাদের শাস্তি দিতে হবে; যাতে ভবিষ্যতে কেউ ভোট জালিয়াতিতে জড়িত হওয়ার সাহস না পায়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বিতর্কিত তিন নির্বাচন আয়োজনে জড়িত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, কমিশনার এবং কমিশন সচিবদের ভূমিকা তদন্তে কমিটি করা হবে।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘লন্ডনে যেখানেই গেছি প্রবাসী বাংলাদেশিরা জিজ্ঞেস করেছেন, আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারব তো? প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।’
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশন সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া, বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভ ট র অন প ত ত র ক রহম ন জ ল ই সনদ ঐকমত য ক ঐকমত য হ ষ র আসন সরক র র ব এনপ র ব চ রপত সহয গ ত র জন য বল ছ ন এনস প ইসল ম ক ষমত প রথম বছর র গতক ল আসন ব
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট কথা বলে দুই দেশের উদ্বেগজনক বাণিজ্য বিরোধের মীমাংসা করতে পারলেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিজ্ঞ নেতারা দীর্ঘ আলোচনা করে ঠিক করতে পারছেন না কীভাবে নির্বাচন ও সংস্কার কাজটি করা যাবে।
অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর ১৭ অক্টোবর বৃষ্টিস্নাত বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বেশ ঘটা করে ২৫টি দল জুলাই সনদে সই করেছিল; চারটি বামপন্থী দল রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করার প্রতিবাদে সনদে সই দেয়নি, তাতে অবাক হইনি। কিন্তু ছাত্রনেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা জুলাই সনদের দাবিটি প্রথম তুলেছিল, তাদের সই না দেওয়াটা অস্বাভাবিক ঠেকেছে। এটা নিয়ে তারা যে দর–কষাকষি করছে, তার পেছনে কি নীতিগত অবস্থান, না ভোটের হিসাব–নিকাশ মুখ্য ছিল, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে যে সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করেছে, তা নিয়ে রাজনীতির মাঠ বেশ গরম। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল একে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও তামাশা বলেও অভিহিত করেছে। আবার কেউ কেউ স্বাগতও জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, জুলাই সনদ ও আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হতে পারলে নির্বাচন হবে কীভাবে?
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিনটি বলয় তৈরি হয়েছে। একটি বলয় হলো বিএনপি ও তাদের সমর্থক-অনুসারী দল। আরেকটি হলো জামায়াতে ইসলামী ও এর অনুসারী দল। তৃতীয়টি হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি। আবার কোনো কোনো দল দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছে। যেখানে গিয়ে ভোটের মাঠে সুবিধা করা যাবে, শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যাবে।
মাঠে সক্রিয় থাকা ৩০টি রাজনৈতিক দলকে নিয়েই সরকার তথা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘ আট মাস ধরে আলোচনা করে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৪৮টি বিষয় যেহেতু সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেহেতু এগুলোর আইনি ভিত্তি তৈরির জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, যা নিয়ে আবার মতভেদ দেখা দিয়েছে। যদিও সনদ তৈরির সময় বলা হয়েছিল, তারা আইনি ভিত্তির সুপারিশ করবে না। কিন্তু অসমাপ্ত সনদ করতে গিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আরও জট পাকিয়ে ফেলেছে।
জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটবে না। সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সামনে রেখে বড় আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলেছেন। সেই আশঙ্কা মোকাবিলার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে।যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তীব্র, তার একটি হলো গণভোটের তারিখ। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অনুসারীরা বলছে, নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের দাবি, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে পারবে না। তাঁরা মনে করেন, আগে গণভোটের দাবি তোলা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার দুরভিসন্ধি ছাড়া কিছু নয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অবশ্য দুই বিকল্প প্রস্তাবই সরকারের কাছে পেশ করেছে। সমস্যা হলো যিনি সরকারপ্রধান, তিনি ঐকমত্য কমিশনেরও প্রধান। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে কে কার কাছে প্রস্তাব পেশ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, জুলাই সনদে ঐকমত্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের আপত্তিগুলো লিপিবদ্ধ হলেও আইনি ভিত্তির সুপারিশে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের প্রধান আপত্তি এখানেই। জুলাই সনদে বলা হয়েছে, যেসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে, নির্বাচনে তারা জনগণের রায় পেলে সেটি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য নয়। কিন্তু আইনি ভিত্তিতে যখন সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে সেটি অনুমোদন করে নিলে সংসদের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে।
তাদের তৃতীয় আপত্তির জায়গা হলো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আইনি ভিত্তি অনুমোদিত হয়ে যাওয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলেছে, যদি ৯ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ উল্লিখিত বিষয়ে আইন পাস না করে, তাহলে সেটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অনুমোদিত হয়ে যাবে। ঐকমত্য কমিশনের এই আইনি ভিত্তির সঙ্গে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান প্রণীত এলএফওর মিল খুঁজেও পেয়েছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র অনৈক্যের কারণে জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে ‘দুরূহ চ্যালেঞ্জ’ দেখছে সরকার। তবে গণভোটসহ সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করার বিষয়টিও গভীরভাবে চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’ (প্রথম আলো, ৩১ অক্টোবর ২০২৫)
সিদ্ধান্তটি কবে হবে, কেমন হবে? যদি একই দিনে দুই ভোট করার পক্ষে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে জামায়াত ও এনসিপি কি মেনে নেবে? আর যদি সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হয়, বিএনপি কি তা গ্রহণ করবে? যদি না করে, কী পরিস্থিতি তৈরি হবে?
রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদের পক্ষে এনে সরকার যতটুকু বাহবা পেয়েছিল, তার বেশি সমালোচিত হয়েছে আইনি ভিত্তি দিতে গিয়ে। এখানে কোনটি ন্যায্য, কোনটি অন্যায্য; তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন একে অপরকে বিশ্বাস করবে না, তেমনি তাদের বড় অংশ সরকারের প্রতিও আস্থাশীল নয়। নির্বাচনের বিষয়ে শুরু থেকে সরকারের দ্বিধাদ্বন্দ্ব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন সন্দেহ বাড়িয়েছে, তেমনি সরকারের প্রতিও একধরনের অনাস্থা সৃষ্টি করেছে।
সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল, রাজনৈতিক দলের সংস্কার, সেখানেই তারা কম গুরুত্ব দিয়েছে। তারা এই একটি বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিলে রাষ্ট্রীয় ও রাজনীতির সংস্কারকাজ অনেকটা সহজ হতো। এখন রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের চাপে সনদে যতই সই করুক না কেন, কাজ করবে তাদের মতো করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধানের দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন নিয়ে যতটা ব্যস্ত ছিল, রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে ততটাই উদাসীন থেকেছে।
জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটবে না। সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সামনে রেখে বড় আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলেছেন। সেই আশঙ্কা মোকাবিলার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন যত বাড়বে, আক্রমণের আশঙ্কারও তত জোরদার হবে। এই সহজ সত্যটি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে চাইলে অবিলম্বে সৃষ্ট জট খোলার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসুন। সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে।
● সোহরাব হাসান, সাংবাদিক ও কবি
* মতামত লেখকের নিজস্ব