সাংবিধানিক সংস্কার এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
Published: 3rd, July 2025 GMT
সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার ফলাফল নিয়ে আশাব্যঞ্জক খবর পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য মৌলিক সংস্কারগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে এবং ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে খুব বেশি মতপার্থক্য প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো একটি মেনে নিলেও আরেকটি বাদ দেওয়ার শর্ত দিচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত যেসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার নিয়ে মতপার্থক্য থেকেই যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে– একজন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী থাকার মেয়াদকাল, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধানদের নিয়োগ প্রক্রিয়া, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিমালার সংশোধন। আশার কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিরোধী দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ সংরক্ষণ এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটাই একমত।
ঐকমত্য কমিশন প্রথমে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল- এনসিসি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। বিএনপির ঘোর আপত্তি থাকায় নতুন প্রস্তাব দেয়। এর বদলে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ গঠিত হবে। এতেও সায় দেয়নি বিএনপি (সমকাল, ২৬ জুন ২০২৫)।
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় কিছুটা ভারসাম্য রাখার প্রয়োজন থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা খুব বেশি খর্ব না করার মতকে উপেক্ষা করা যায় না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এক ব্যক্তি বা দলের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা যাতে সম্ভব না হয়, তার জন্য অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং সদস্যদের কোনো কমিটি বা পরিষদের মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব যৌক্তিক। তবে এটাকে বেশি ক্ষমতাশালী করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতাকে যেভাবে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করা সম্ভব, সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্বাহী ক্ষমতা বেশি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। তাতে নির্বাহী বিভাগের কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়তে পারে।
তবে নির্বাহী বিভাগকে সংসদে জবাবদিহি করার প্রধান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলকে সাংবিধানিক পরিষদের এখতিয়ার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করার কারণ বোধগম্য নয়। তাহলে এই গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদটি কি আগের মতোই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন? উল্লেখ্য, অডিটর জেনারেলের দপ্তর নির্বাহী বিভাগের প্রতিষ্ঠান নয়; এটি সংসদীয় প্রতিষ্ঠান। এই ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের কাছে রাখার যৌক্তিকতা নেই। বরং তা প্রস্তাবিত সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটিতে অর্পণই যুক্তিসংগত।
আমাদের দেশেই কি প্রথম সাংবিধানিক পরিষদ বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি গঠনের ধারণা এসেছে? আমাদের দুই প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও নেপালে সাংবিধানিক পরিষদ অনেক আগে থেকেই আছে। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক পরিষদ নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, পুলিশ কমিশন, ঘুষ কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক এবং সংবিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধানদের নিয়োগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। সংবিধানে বর্ণিত পদগুলোতে নিয়োগে এই পরিষদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। নেপালে এই পরিষদের এখতিয়ারের মধ্যে অডিটর জেনারেলের দপ্তরও রয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ছিল– দুই মেয়াদের বেশি কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। সেটা অন্যান্য রাজনৈতিক দল মেনে নিলেও বিএনপি সম্পূর্ণ একমত হতে পারছে না। ঐকমত্য কমিশন দুই মেয়াদের জায়গায় ১০ বছর নির্ধারণের প্রস্তাব দিলে বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে, তাহলে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক কমিশন কমিটি গঠনের প্রস্তাব বাদ দিতে হবে।
গণতান্ত্রিক কাঠামো সৃষ্টি এবং পরিবার ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ফিরে আসা বন্ধ করতে একজন ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রীর পদে না থাকা এবং সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধানদের নিয়োগের ক্ষেত্রে পরিষদ বা কমিটি গঠন অপরিহার্য শর্ত। একটি অপরটির পরিপূরক নয়। অথচ একটি বাস্তবায়ন করা হলে আরেকটি বাদ দিতে হবে– বিএনপির এমন অবস্থান হতাশাব্যঞ্জক।
সংসদের উচ্চকক্ষের প্রস্তাবিত সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির আপত্তি রয়েছে। অথচ শুধু উচ্চকক্ষ নয়; নিম্নকক্ষ বা প্রধান সংসদের নির্বাচনও সংখ্যানুপাতিক বা মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থায় হতে পারে। বর্তমানে যে সংসদীয় আসনভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার বড় অসুবিধা হলো দলীয় প্রার্থী বা নির্বাচিত এমপিকে সারাবছর বিশাল কর্মী বা ক্যাডার বাহিনী ভরণপোষণ করতে হয়। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এদের পেছনে একজন প্রার্থীকে ব্যয় করতে হয় ১০ থেকে ৫০ কোটি টাকা। ফলে একদিকে যোগ্য কিন্তু বিত্তশালী নন এমন প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া কঠিন; অন্যদিকে প্রার্থীদের ক্যাডার বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনও অসম্ভব হয়ে পড়ে। শুধু নির্বাচন ব্যবস্থাই কলুষিত করে না; চাঁদাবাজির মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরও অপরিসীম ক্ষতি হয়। যেহেতু সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা আমাদের দেশে নতুন; এবার সম্ভব না হলেও অর্থ ও পেশিশক্তিবিহীন গণতন্ত্রের জন্য ভবিষ্যতে সংখ্যানুপাতিক অথবা মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থার দিকেই যেতে হবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বিশ্বের ১৩০টি দেশে পুরোপুরি সংখ্যানুপাতিক বা মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থা রয়েছে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশ ছাড়াও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের নেপাল, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় এমন ব্যবস্থা রয়েছে। নেপালে ২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে ১৬৫ জন (৬০ ভাগ) সরাসরি আসনভিত্তিক এবং ১১০ জন (৪০ ভাগ) সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত হন। শ্রীলঙ্কায় পুরোটাই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন; তবে তারা এটা জেলাভিত্তিক ও দেশভিত্তিক ভাগ করেছে।
এটা আশা জাগানিয়া; সংসদের অন্তত চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটি– পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটি, এস্টিমেট কমিটি, পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সবাই একমত। বিশেষত ‘পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি’ বিরোধী দলের নেতৃত্বে থাকার সিদ্ধান্ত সরকারি অর্থ ব্যয়ে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক অগ্রগতি।
সংসদে বর্তমানের ৫০টি নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাবেও সব দল একমত। এটা ভালো খবর, কিন্তু সংসদে যে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নেই– সে বিষয়টির উপেক্ষা কেন? এ ব্যাপারে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব দেখছি না। অনেক দেশে, এমনকি পাকিস্তানেও ফেডারেল ও প্রাদেশিক পার্লামেন্টের ৫ ভাগ আসন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত। আমাদের সংসদেও ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
মনে রাখা জরুরি, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রও গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র না থাকায় নমিনেশন বাণিজ্য ও পরিবারতন্ত্র জেঁকে বসেছে। দলের সব পর্যায়ে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে কার্যনির্বাহী নির্বাচনের ব্যবস্থা না করা গেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনতার সংগ্রাম পূর্ণতা লাভ করবে না। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক সংস্কার, নাকি নির্বাচনী আচরণবিধি সংশোধন প্রয়োজন– ঐকমত্য কমিশন ভেবে দেখতে পারে।
বাংলাদেশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ক্রান্তিকাল পার করছে। নাগরিকরা উন্মুখ হয়ে ভাবছে, অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পর জাতি কি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে পারবে? রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তী সরকার, ঐকমত্য কমিশন যেন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মেরামত ও সংস্কারের শেষ সুযোগটি মিস না করে।
ফিরোজ আহমেদ: সদস্য, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন; সাবেক কর্মকর্তা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক
firozlxp@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র প রস ত ব প রস ত ব দ গণতন ত র যবস থ য় আম দ র ব এনপ ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিবিপ্লবী রাজনীতি ও গণমাধ্যম
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কামাল আহমেদের লেখা ও পর্যবেক্ষণ আমাদের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করে তোলায় মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন যথেষ্ট নয়। ব্যক্তি খাতে গণমাধ্যমে কালোটাকার দৌরাত্ম্য, প্রভাবক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং নৈতিক মানের অনুপস্থিতির মতো বিষয়গুলোতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রয়োজন।’
তাঁর (কামাল আহমেদ) সঙ্গে আমরা একমত। তবে তিনি লিবারেল ইকোনমিক পলিসি নামে পরিচিত ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ’কে যে ইতিবাচক চোখে দেখেন এবং নির্বিচার গ্রহণ করেন, আমি সেভাবে দেখি না, গ্রহণও করি না।
মুক্তবাজার অর্থনীতি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে না। ইউরোপে বাজারব্যবস্থা বিকাশের সঙ্গে গণতন্ত্রের আবির্ভাব ও বিকাশের সম্বন্ধ আছে বটে, কিন্তু একালের কাছাখোলা মুক্তবাজার অর্থনীতি গণতন্ত্রের সহায়ক নয়; বরং গণতন্ত্রের, বিশেষত গণমাধ্যমের ঘাতক। পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়।
২.কামাল আহমেদ ‘জুলাই সনদে কী থাকছে, কী থাকা উচিত’ (২৬ জুন ২০২৫) নিবন্ধটিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘জুলাই ঘোষণা’ দিতে বাধা দেওয়া নিয়ে কিছু বলেননি। জনগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার দলিল হিসেবে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার সিদ্ধান্তে কোনো রাজনৈতিক বা আইনি সমস্যা দেখেননি।
আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণা, জুলাই সনদ এবং গণমাধ্যম২১ ঘণ্টা আগে৫ আগস্টে গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে, কিন্তু ৮ আগস্টে বিদ্যমান সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল রাখার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবিপ্লবী রাজনীতির বৃত্তে প্রবেশ করে। কামাল আহমেদ ৮ আগস্টের সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব এবং পরবর্তী সময়ে জনগণকে সজ্ঞানে বাদ দেওয়ার প্রতিবিপ্লবী রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেও ৫ আগস্ট থেকে আলাদা করতে পারেননি।
অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা সরকার লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করছে লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্য। এটাও তাঁর কাছে সমস্যা মনে হচ্ছে না।
৩.রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের জনগণের প্রতিনিধি গণ্য করা এবং তাঁদের সঙ্গেই আপসরফা করা আদতে পুরোনো ব্যবস্থাকেই পুনর্বাসিত করা। অধ্যাপক ইউনূস এই ভুল করছেন।
লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের সঙ্গেই আপসরফার প্রক্রিয়া গণ-অভ্যুত্থানের মর্মের বিরোধী এবং তিনি সেটা করছেন জনগণকে বাদ দিয়ে। এটাই প্রহসনের জায়গা। কারণ, এই লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণি যদি জনগণের প্রতিনিধি হতো, তাহলে তাদের নেতৃত্বেই গণ–অভ্যুত্থান হতো।
৮ আগস্টের সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের পর তথাকথিত সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন আদতে প্রতিবিপ্লবকেই বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার প্রক্রিয়া।
‘জুলাই সনদ’ বানানোর প্রক্রিয়া জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের স্পিরিট বা মর্মের বিরোধী এবং সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে বৈধতা দেওয়ার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
তথাকথিত জুলাই সনদ লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বন্দোবস্তের দলিলের অধিক কিছু নয়, অধিক কিছু হয়ে ওঠা অসম্ভব।
৪.ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে প্রধান উপদেষ্টা ‘জুলাই ঘোষণা’ দিতে দেননি। ৬ জুন ২০২৫ তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই মাসেই একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করার কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন, তথাকথিত ‘জুলাই সনদে’ একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কটিতে একমত, তার তালিকা থাকবে। সেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে রাজনৈতিক দলগুলো নাকি জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।
ব্যস। এতগুলো মানুষ শহীদ হলো আর এতগুলো মানুষ পঙ্গুত্বের জীবন বরণ করে নিল কেন? লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণি নিজেদের
মধ্যে কোথায় কোন বিষয়ে একমত হলো, সেই সনদের জন্য?
যে রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে কার্যত কিছুই করতে পারেনি, তারা এখন আমাদের ‘জাতীয় সনদ’ উপহার দেবে!
জুলাই সনদ সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার দলিল; গণ–অভ্যুত্থানের ঘোষণাকে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা।
‘জুলাই সনদ’ প্রকৃতপক্ষে ৫ আগস্টের মৌলিক গঠনতান্ত্রিক মুহূর্তকে (কনস্টিটুয়েন্ট মোমেন্ট) অস্বীকার করার কৌশল, যেখানে জনগণ বিদ্যমান রাষ্ট্রশক্তির বাইরে নতুন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
জুলাই ঘোষণার অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে জনগণের অভিপ্রায় ও আকাঙ্ক্ষাকে ‘অদৃশ্য’ করে ফেলা।
৫.জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, তথাকথিত ‘সংস্কার কমিশন’, ‘জুলাই সনদ’ প্রভৃতি মূলত লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং বিদেশি স্বার্থান্বেষী শক্তির মধ্যকার নতুন বোঝাপড়ার প্রক্রিয়া ও দলিল।
এতে স্পষ্টতই জনগণের অভিপ্রায়ের কথা নেই, আছে ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ করে রাস্তায় নামা জনগণকে বাদ দিয়ে ‘ঐকমত্যের নামে’ সংলাপভিত্তিক রাজনৈতিক ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের সমঝোতা।
কামাল আহমেদের লেখায় সংস্কারপন্থী বিবেচনা, যেমন বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, জনপ্রশাসন ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ‘গণতন্ত্রের কার্যকারিতা’ স্থাপনের দাবি করা হয়েছে।
কিন্তু এগুলো এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কারচেষ্টা, যার মৌলিক ভিত্তি হলো জনগণ থেকে কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়ে শাসকশ্রেণির মধ্যে
ভাগ করে দেওয়া। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত; বরং এই সংস্কার বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার একটা কারিগরি বা কৌশল।
কামাল আহমেদের লেখার সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা হলো ‘সবার ঐকমত্যে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ’—এই ভাষ্য। বাস্তবে এই ‘ঐকমত্য’ কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? কে ঠিক করছে, কোন সুপারিশ গ্রহণযোগ্য, কোনটি নয়?
জনগণের পক্ষ থেকে কোনো গণপরিষদ, গণশুনানি বা প্রতিনিয়ত সংলাপ তো দেখা যাচ্ছে না। জনগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে যে ‘সনদ’ তৈরি হয়, তা কোনোভাবেই জনগণের সার্বভৌমত্ব কায়েম করতে পারে না।
৬.কামাল আহমেদের লেখাটিতে গণমাধ্যম সংস্কারের ঘাটতি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যে উদ্বেগ জানানো হয়েছে, সেটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে বসে এবং সেই ব্যবস্থাকে অক্ষত রেখে কিছু ‘নৈতিক সংশোধন’ কামনা করা।
কামাল আহেমদের চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে একপ্রকারের ‘সরকারি বা করপোরেট স্বাধীনতা’ দেওয়ার চিন্তা ফুটে উঠেছে, যেখানে জনগণের তথ্য নিরীক্ষণের অধিকার ও জনগণের ভাষ্য নির্মাণের অধিকার মোটেও স্বীকৃত নয়।
কামাল আহমেদ শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, নিরাপত্তা, অধিকার ইত্যাদি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেটা শূন্য বুলি ছাড়া কিছু হয়ে ওঠে না। কারণ, সাংবাদিক হিসেবে তিনি জানেন, এই তথাকথিত সনদ বা কমিশনের মধ্যে শ্রমিকদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এই অবস্থান শ্রমিকশ্রেণিকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে রেখে তাদের আবার ‘সক্ষম শাসকদের দয়া’র অধীন করার চেষ্টা মাত্র।
৭.‘সংস্কার’ কথাটির বিপজ্জনক ব্যবহার সংস্কারপন্থীরা বুঝলেও অনেকে বুঝতে পারেন না। ‘সংস্কার’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে এমনভাবে, যেন শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার দু–এক জায়গায় স্বল্প সংশোধন মানেই গণতন্ত্র। এতেই বুঝি জনগণের অধিকার আদায় হয়ে যাবে।
আসলে ‘সংস্কার’ কথাটি জনগণের অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ কিংবা নতুন গঠনতান্ত্রিক শক্তির দাবিয়ে রাখা বা নির্মূল করার ভাষিক অস্ত্র। জনগণের সার্বভৌম অধিকার হলো নিজেদের নিজেরা রাজনৈতিকভাবে গঠন করার ক্ষমতা, নিজেদের গঠনতন্ত্র, রাষ্ট্রকাঠামো এবং বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের যোগ্য স্থান নির্ধারণের অধিকার—সেটা লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক দলের ‘ঐকমত্যে’ বন্দী হতে পারে না।
৮.কামাল আহমেদের লেখা গুরুত্বপূর্ণ হলেও শেষমেশ লেখাটি সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে কৌশলে রক্ষা করার একটি দুর্বল ভাষ্য হয়ে রইল, তার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারল না।
গণমাধ্যম শুধু জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের কাছে জবাবদিহি করে, কিন্তু কোনো করপোরেট স্বার্থ, রাষ্ট্র, আমলাতন্ত্র বা পুলিশি ব্যবস্থার কাছে নয়। গণসার্বভৌমত্বের আলোকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিয়ে কীভাবে আমরা ভাবব এবং গণমাধ্যমে চর্চা করব, তার কোনো নীতি বা দিশা কামাল আহমেদ দিতে পারলেন না। জনগণের অভ্যুত্থান গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের মধ্য দিয়ে নিজেদের নতুনভাবে গঠন এবং একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এটা আমাদের প্রয়োজন।
৯.জুলাই ঘোষণা হলো জনগণের নতুন গাঠনিক ক্ষমতার ঘোষণা; লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য জনগণ অকাতরে শহীদ হয়নি।
গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের অভিপ্রায় এবং জনগণের সামষ্টিক গাঠনিক ক্ষমতা ও গঠনের কর্তব্য ইত্যাদি সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে পুরোনো শাসকেরাই নতুন মুখোশ পরে পুরোনো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাই বহাল রাখছে।
একে বলা যায় প্রতিবিপ্লবকে (লিগ্যালাইজড কাউন্টার রেভল্যুশন) বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার কৌশল। ফলে সংস্কারের নামে পুরোনো শাসকশ্রেণি ও শাসনকেই চিরস্থায়ী করার আয়োজন চলছে।
কিন্তু জনগণ কি তা মেনে নেবে?
ফরহাদ মজহার কবি, লেখক ও চিন্তক
*মতামত লেখকের নিজস্ব