এই মুহূর্তে ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, ‘জনগণের বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া এই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার পতন হবে না।’ তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ থাকলে বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, কর্মচারী, নারী, জাতিগত বা ধর্মীয় নিপীড়িত মানুষের কোনো দাবি আদায় হবে না।

গণসংহতি আন্দোলনের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন জোনায়েদ সাকি। শুক্রবার বেলা তিনটার পর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দলটির তিন দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করা হয়।

কোনো একক দলের পক্ষে শেখ হাসিনার কায়েম করা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার বদল সম্ভব না বলে মনে করেন জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা নির্বাচনী গণতন্ত্রের কথা বলছি। কিন্তু এই নির্বাচনী গণতন্ত্র যদি খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার রক্ষার গণতন্ত্রে পরিণত হতে না পারে, তাহলে এই গণতন্ত্র টেকে না। সে কারণে আমরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি, দেশের সামাজিক ব্যবস্থা, দেশের সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা—সবকিছু পরিবর্তনের জন্য লড়াই করেছি।’

মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার কথা উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী বলেন, সে জন্য দেশের বিদ্যমান রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলাই এখন প্রধান কর্তব্য বলে মন্তব্য করেন জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আজকে এমন একটা লক্ষ্য নিয়ে সামনে যাচ্ছে, কোনো কিছুই আর তাকে পিছুটান দিতে পারবে না। সেই পিছুটান যারা দেবে, যারা কোনো না কোনোভাবে, অন্য কোনো নামে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করতে চাইবে, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করতে চাইবে, তাদের এ দেশের জনগণ আর গ্রহণ করবে না। কাজেই এ দেশে জাতীয়তাবাদের নামে যেমন ফ্যাসিবাদ চলবে না, কোনো মতবাদ দিয়ে কোনো ফ্যাসিবাদ এ দেশে গ্রহণযোগ্য হবে না।’

‘গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য বিচার, সংস্কার, নির্বাচন—সবকিছুই অপরিহার্য’ উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী বলেন, ‘ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক উত্তরণ হবে না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ তৈরি না করে জুলাই জাতীয় সনদ কার্যকর করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

‘আজকে যে সংকট তৈরি করেছে এই অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশন, আমি বিশ্বাস করি যে এই সংকট কেটে যাবে। এ দেশের মানুষ কখনো পরাজিত হয় না। পরাজয় বরণ করেনি, পরাজয় বরণ করবে না।’বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

এই অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজকে যে সংকট তৈরি করেছে এই অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশন, আমি বিশ্বাস করি যে এই সংকট কেটে যাবে। এ দেশের মানুষ কখনো পরাজিত হয় না। পরাজয় বরণ করেনি, পরাজয় বরণ করবে না।’

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে এবং মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে এককেন্দ্রিক ক্ষমতা, স্বৈরতন্ত্র তৈরির সাংবিধানিক কাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, অনেক সময় চরম বুদ্ধিমান মানুষেরা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়; জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবার সেই পরিচয়টা দিয়েছে। তারা এখন বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। এর চেয়ে কষ্টকর, দুঃখের, লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।

শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে গণসংহতি আন্দোলনের জাতীয় সম্মেলনের সূচনা করেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ নাজমুল কাজীর স্ত্রী মারিয়া সুলতানা এবং শহীদ ওমর নুরুল আবছারের স্ত্রী ফারজানা জাহান। অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পাশাপাশি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন দলের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই জুলাই শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরামের সংগঠক মাহরুখ মহিউদ্দিন, গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য তাসলিমা আখতার, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা প্রমুখ।

কৃষক-শ্রমিক, খেটে খাওয়া, নিপীড়িত ও প্রান্তিক মানুষের ন্যায্য হিস্যার দাবি এবং ‘বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ, অধিকার ও মর্যাদার বাংলাদেশ, জনগণের বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকারে গণসংহতি আন্দোলন তাদের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন করছে। তিন দিনের এই আয়োজনে সারা দেশ থেকে আসা প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকেরা দলের আগামী নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণতন ত র জনগণ র ব র জন ত ক অন ষ ঠ ন ব যবস থ ল ইসল ম ঐকমত য

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বিএনপি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সুপারিশে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চাওয়া প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে করে বিএনপি। দলটির অভিমত, বিএনপি সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) হওয়া সত্ত্বেও কমিশনের সুপারিশে তাদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে, বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট (দ্বিমত)’ সনদে লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা রাখা হয়নি। এতে বিএনপি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।

গতকাল মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে আলোচনায় নেতারা এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বলে জানা গেছে। সভায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন। তিনি সভায় সভাপতিত্ব করেন।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করবে। গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো এই সময়ের মধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। এ বিষয়গুলো সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সভায় একজন সদস্য গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জারিকৃত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) এবং আইয়ুব খান প্রবর্তিত বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি মনে করেন, কমিশনের সুপারিশে দুটি দলের প্রস্তাব ও ঐকমত্য কমিশনের চিন্তাভাবনা জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও), ১৯৭০ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জারি করা একটি ফরমান। এতে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের নীতিসমূহ উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ এই এলএফও ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, আইনসভায় ৩০০টি আসন থাকবে। ফ্রেমওয়ার্কে রাষ্ট্রের দুই অংশের জন্য সংখ্যানুপাতের কথা বলা হয়। তাতে উল্লেখ ছিল, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের ১২০ দিনের মধ্যে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে। তবে এই সময়ের মধ্যে নতুন আইনসভা সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হলে নতুন নির্বাচন দেওয়া হবে।

অন্যদিকে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ হচ্ছে ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান প্রবর্তিত একটি পরোক্ষ নির্বাচনভিত্তিক শাসনব্যবস্থা, যা মূলত তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার একটি উপায় ছিল। এই ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ সরাসরি রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচন করত না। বরং ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ নামে পরিচিত প্রায় ৮০ হাজার স্থানীয় জনপ্রতিনিধির একটি নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হতো, যাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হতেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থার অবসান হয়।

আরও পড়ুনসংসদ ২৭০ দিনে ব্যর্থ হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে: আলী রীয়াজ ২৮ অক্টোবর ২০২৫

সভায় বিএনপির নেতারা অভিমত প্রকাশ করেন, কমিশনের সুপারিশ জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এর মধ্য দিয়ে কমিশন চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে কার্যত অনৈক্য সৃষ্টি করছে। বিএনপি এখন মনে করছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরও দু-একটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ। এসব পদক্ষেপকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন সঠিক সময়ে না করার ‘অপচেষ্টা’ হিসেবে দেখছে দলটি।

সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও আরও উপস্থিত ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও এ জেড এম জাহিদ হোসেন।

আরও পড়ুনকেউ কেউ শুধু ক্ষমতা চায়, সংস্কার তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়: নাহিদ১৩ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন জাতির দাবি
  • দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান
  • আন্তর্জাতিক সংকট যেভাবে স্বৈরশাসকদের শক্তিশালী করে
  • সরকার এখন প্রতারকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে: মান্না
  • ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বিএনপি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ
  • জেন–জি: দেশভেদে ভিন্ন ক্ষোভ, প্রজন্মভেদে এক সুর
  • বক্তব্য শেষে অভিযোগ তুলে অনুষ্ঠান বর্জন করলেন ছাত্র সংসদ প্রতিনিধিরা
  • গণভোটে জুলাই সনদ পাস না হলে সব আত্মত্যাগ ব্যর্থ হবে: বদিউল আলম মজুমদার
  • জনগণের সম্মতি ছাড়া কোনো উদ্যোগই বেশি দূর এগোতে পারে না: হোসেন জিল্লুর রহমান