সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন জাতির দাবি
Published: 31st, October 2025 GMT
ফ্যাসিবাদী শাসন ও বৈষম্য থেকে এখনো মুক্তি মিলেনি; বরং দেশ এখন গভীর সংকটে রয়েছে। ‘বিদেশি প্রভাবিত’ অন্তর্বর্তী সরকার নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন জাতির প্রধান দাবি। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়েজনের নামে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও সময়ক্ষেপণ করা উচিত হবে না।
শুক্রবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ জাসদ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
দেশ এখন জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আছে মন্তব্য করে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ থেকে মানুষ মুক্তি চেয়েছিল। একটা অরাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়েছে। আমরা তাদের নৈতিকভাবে সাপোর্ট করেছি। কিন্তু তারপরে যে চেহারা-সুরত আবির্ভূত হয়েছে, এক কথায় বলতে গেলে বিদেশি মনোনীত একটা সরকার। এই সরকারের কাছ থেকে আমরা খুব কিছু আশা করি না এখন।’
শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘আমরা বটম লাইনে (শেষ প্রান্তে) চলে গেছি। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) যাতে একটা ইলেকশন দিয়ে চলে যান। তিনি শুরুতে বলেছিলেন, সবকিছু ঠিকঠাক করতে পাঁচ বছর লাগবে। জনগণের দাবির প্রেক্ষাপটে ২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দেবেন বলেছেন। তিনি এনসিপি, জামায়াত আর বিএনপির সঙ্গে আলাপ করেন, সলাপরামর্শ করেন। মাঝেমধ্যে এটাকে হালাল করতে আমাদের সবাইকে ডাকেন।’
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি বলেন, ‘আমরা গভর্নমেন্টকে সাপোর্ট করতে জাতীয় ঐকমত্যের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি। প্রত্যেকটা বৈঠক থেকে প্রত্যেকটা ইস্যুতে গভর্নমেন্টকে সহযোগিতা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যের আলোচনা করে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে দেশের মানুষ যদি মনে করে দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, আমি মনে করি সেটা ভুল করবে না।’
জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না মন্তব্য করে শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘যদি এটা করতে চান, জনতার মুখোমুখি হতে হবে। কাজেই সব বাদ দিয়ে ইলেকশনটা দিয়ে দেন। গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে ন্যূনতম ঐকমত্য গঠিত হয়েছে, সেটার ওপর ভিত্তি করে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তী পরিক্রমায় সেগুলো পালন করবে।’
‘হাসিনা–খালেদা–ইউনূসকে বর্গা দিয়ে ঠকেছি’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশ ভয়ংকর একটা পরিস্থিতি। বলতে হয়, সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিব কোথা? দেশের এক জায়গায় মলম লাগাবেন আরেক জায়গায় ফোড়া বের হবে। টোটকা-ফোটকায় কাজ হবে না। একটা সামাজিক বিপ্লব আজকে ফরজ হয়ে গেছে।
কেউ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে না মন্তব্য করে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘বারবার আমরা ঠকি। কেন ঠকি? জমি বর্গা দেওয়া যায়, স্বার্থ বর্গা দেওয়া যায় না। হাসিনাকে (শেখ হাসিনা) বর্গা দিয়ে ঠকে গেছি। খালেদাকে (খালেদা জিয়া) বর্গা দিয়ে ঠকে গেছি। ইউনূসকে (মুহাম্মদ ইউনূস) বর্গা দিয়ে ঠকে যাচ্ছি। এরাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দেশ চালিয়েছে, লুটপাটতন্ত্র কায়েম হয়েছে। লুটপাটের রাজত্ব বহাল রাখার জন্য মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে। এমনকি ভোটাধিকার পর্যন্ত হরণ করেছে।’
এ সময় জামায়াতে ইসলাম সম্পর্কে সিপিবির সাবেক সভাপতি বলেন, ‘আমাদের কাজে কোনো অবহেলা, ঐক্যে কোনো দুর্বলতা যদি দেখা দেয়, আমরা প্রকারান্তরে জামায়াতে ইসলামকে সুযোগ করে দেব এই খালি মাঠ পূরণ করার জন্য। সুতরাং এই হলো আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ।’ তিনি বলেন, ‘অন্যান্য ধর্মভিত্তিক সংগঠন সম্পর্কে অন্য সমালোচনা আছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামের সম্পর্কে বলতেছি, তাদের তো বাংলাদেশের মাটিতে অফিস করার, তৎপরতা চালানোর কোনো অধিকার নাই। কিন্তু সে জোর এখানে থাকতেছে কেন? একটা গভীর ষড়যন্ত্রের জাল।’
জামায়াতের সংস্কার এবং নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি প্রসঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাহলে সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু ন্যায়বিচারও সম্ভব নয়। সংস্কার ছাড়াই ট্রাইব্যুনাল করলেন কেন? যদি সংস্কার ছাড়া নির্বাচন শুদ্ধ না হয়, তাহলে সংস্কার না করে বিচারব্যবস্থার ভেতরেও তো রোগ রয়ে গেছে। তাহলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে এক দুর্যোগের ঘনঘটা। একটা গভীর সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ নিপতিত হচ্ছে। একটা গভীর খাদের কিনারে এসে বাংলাদেশ এখানে উপনীত হয়েছে।
আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, স্থায়ী কমিটির সদস্য রোকনুজ্জামান রোকন, আনোয়ারুল ইসলাম, বাদল খান, করিম শিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুশতাক হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ–উপাচার্য সোহেল আহমেদ, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা প্রমুখ বক্তব্য দেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল ইসল ম ইসল ম স র জন ত ক দল র
এছাড়াও পড়ুন:
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বিএনপি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সুপারিশে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চাওয়া প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে করে বিএনপি। দলটির অভিমত, বিএনপি সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) হওয়া সত্ত্বেও কমিশনের সুপারিশে তাদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে, বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট (দ্বিমত)’ সনদে লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা রাখা হয়নি। এতে বিএনপি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে আলোচনায় নেতারা এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বলে জানা গেছে। সভায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন। তিনি সভায় সভাপতিত্ব করেন।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করবে। গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো এই সময়ের মধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। এ বিষয়গুলো সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সভায় একজন সদস্য গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জারিকৃত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) এবং আইয়ুব খান প্রবর্তিত বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি মনে করেন, কমিশনের সুপারিশে দুটি দলের প্রস্তাব ও ঐকমত্য কমিশনের চিন্তাভাবনা জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও), ১৯৭০ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জারি করা একটি ফরমান। এতে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের নীতিসমূহ উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ এই এলএফও ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, আইনসভায় ৩০০টি আসন থাকবে। ফ্রেমওয়ার্কে রাষ্ট্রের দুই অংশের জন্য সংখ্যানুপাতের কথা বলা হয়। তাতে উল্লেখ ছিল, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের ১২০ দিনের মধ্যে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে। তবে এই সময়ের মধ্যে নতুন আইনসভা সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হলে নতুন নির্বাচন দেওয়া হবে।
অন্যদিকে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ হচ্ছে ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান প্রবর্তিত একটি পরোক্ষ নির্বাচনভিত্তিক শাসনব্যবস্থা, যা মূলত তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার একটি উপায় ছিল। এই ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ সরাসরি রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচন করত না। বরং ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ নামে পরিচিত প্রায় ৮০ হাজার স্থানীয় জনপ্রতিনিধির একটি নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হতো, যাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হতেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থার অবসান হয়।
আরও পড়ুনসংসদ ২৭০ দিনে ব্যর্থ হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে: আলী রীয়াজ ২৮ অক্টোবর ২০২৫সভায় বিএনপির নেতারা অভিমত প্রকাশ করেন, কমিশনের সুপারিশ জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এর মধ্য দিয়ে কমিশন চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে কার্যত অনৈক্য সৃষ্টি করছে। বিএনপি এখন মনে করছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরও দু-একটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ। এসব পদক্ষেপকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন সঠিক সময়ে না করার ‘অপচেষ্টা’ হিসেবে দেখছে দলটি।
সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও আরও উপস্থিত ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
আরও পড়ুনকেউ কেউ শুধু ক্ষমতা চায়, সংস্কার তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়: নাহিদ১৩ জুলাই ২০২৫