কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে অচলাবস্থা ছিল, তার অবসান হতে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তফসিল ঘোষণা করা হবে ২৯ জুলাই, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সেপ্টেম্বরে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের পর দেশের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক উত্তরণযাত্রার যে আকাঙ্ক্ষা, সে নিরিখে এবারের ডাকসু নির্বাচন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর জনমত যাচাইয়ের জন্য নির্বাচনটি একটি নিরীক্ষাক্ষেত্র হয়ে উঠবে। কেননা, দেশের তরুণদের রাজনৈতিক মত কোন দিকে বাঁক নিচ্ছে, তার সুস্পষ্ট একটা ধারণা এ নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে।

এ প্রেক্ষাপটে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ২০ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ডাকসু নির্বাচনের অংশীজনদের সঙ্গে তফসিল–সংক্রান্ত চূড়ান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কেন্দ্রীয়ভাবে ছয়টি আলাদা কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। একেক হলের শিক্ষার্থীরা একেক কেন্দ্রে ভোট দিতে পারবেন। ২০১৯ সালে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে যে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা, তার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রসংগঠনগুলোর ও শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে করার। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আশা করা হয়েছিল, অভ্যুত্থানের পরপরই ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, শিক্ষার্থীদেরও সেই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে অনৈক্য থাকায় সময়ক্ষেপণ হয়েছে। দেরিতে হলেও ডাকসু নির্বাচনের সিদ্ধান্তের জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের সক্রিয় ও জোরালো ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি হবে। সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। আমরা আশা করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ ধরে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতেও ধাপে ধাপে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

আমরা দেখেছি জাতীয় পরিসরে মেধাশূন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে শূন্যতা, তা পূরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ছাত্র সংসদগুলো। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসুর একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা থাকলেও নব্বইয়ের পর গণতান্ত্রিক আমলে সরকারগুলো সেই গণতান্ত্রিক পরিসরকে রুদ্ধ করে ফেলা হয়। যে সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ছাত্রসংগঠনকে দলীয় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু বিরোধী মত দমনে নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের কাজে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। এ সময়কালে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক দাবিতে অসংখ্য আন্দোলন গড়ে তুললেও নিষ্ঠুরভাবে তাদের দমন করা হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সেটা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। এসব অন্যায়, নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত ক্ষোভের বিস্ফোরণ থেকেই গণ–অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল।

চব্বিশের অভ্যুত্থান বাংলাদেশের সামনে গণতান্ত্রিক পথে যাত্রার অনন্য এক সুযোগ এনে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা কেউই লেজুড়বৃত্তিক ও নিপীড়নমূলক ছাত্ররাজনীতি এবং কর্তৃত্ববাদী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে চান না। এটা দুঃখজনক যে ছাত্রসংগঠনগুলোর বেশির ভাগই শিক্ষার্থীদের এ পরিবর্তনটাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা পুরোনো রাজনীতিরই চর্চা করে চলেছে। সব মত, সব পথের অবাধ প্রকাশের সুযোগের জায়গা হিসেবেই বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক মতের কারণে কেউ যেন নিপীড়নের শিকার না হয়, সেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে পরিসরটা তৈরি করে দিতে পারে ছাত্রদের নির্বাচিত ছাত্র সংসদ।

শুধু ডাকসু নয়, দেশের সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বাধা কাটুক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র জন ত ক ছ ত রস

এছাড়াও পড়ুন:

রাকসু নির্বাচনে বামদের প্যানেলে নারী একজন, শক্তি ‘ধারাবাহিক লড়াই’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে বাম সংগঠনগুলোর একটা বড় অংশ এক ছাতার নিচে এসেছে। তারা যে প্যানেল দিয়েছে, তাতে জায়গা পেয়েছেন মূলত জোটে থাকা সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারাই। নারী আছেন মাত্র একজন। তবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দুজনকে প্রার্থী করা হয়েছে। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিতি তৈরি হওয়াকে এই প্যানেলের ‘বড় শক্তি’ বলে মনে করা হচ্ছে।

রাকসুর ২৩ পদের বিপরীতে ১৬টিতে প্রার্থী দিয়েছে বাম সংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। তাদের প্যানেলের নাম ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’। এই প্যানেলে আছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র গণমঞ্চ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র যুব আন্দোলন, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা-কর্মীরা। রাজনৈতিক–সংশ্লিষ্টতা নেই, এমন শিক্ষার্থী আছেন দুজন। তবে প্যানেলে থাকা দুজন সদস্য সরে দাঁড়িয়েছেন।

এই প্যানেল থেকে সহসভাপতি (ভিপি) পদে লড়বেন ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) কোষাধ্যক্ষ কাউছার আহম্মেদ এবং সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রার্থী করা হয়েছে ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক নাসিম সরকারকে।

বাম জোটের নেতারা বলছেন, ক্যাম্পাসে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে আসছেন তাঁরা। এর মাধ্যমেই তাঁরা শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত। শিক্ষার্থীদের ‘প্রধান কণ্ঠস্বর’ হিসেবে কাজ করেছেন, করছেন। তাঁদের দাবি, এটাই তাঁদের বড় শক্তি।

প্রার্থীদের প্রায় সবাই জোটের নেতা

বামদের এই প্যানেলে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে লড়বেন বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের আহ্বায়ক তারেক আশরাফ। মহিলাবিষয়ক সহসম্পাদক পদে ছাত্র ফ্রন্টের শ্রেয়সী রায়, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পদে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর হাসান শাহরিয়ার খন্দকার আলিফ এবং তথ্য ও গবেষণা সহসম্পাদক পদে লড়বেন ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মো. সজীব আলী।

এ ছাড়া সহবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক পদে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক রিসার্চ চাকমা এবং সহপরিবেশ ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শামীন ত্রিপুরাকে প্রার্থী করা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক পদে ছাত্র ফ্রন্টের সদস্য মুনতাসির তাসিন, পরিবেশ ও সমাজসেবা–বিষয়ক সম্পাদক পদে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আজমাইন আতিক ও নির্বাহী সদস্য পদে লড়বেন ছাত্র ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক আহমেদ ইমতিয়াজ।

এই প্যানেল থেকে জোটের বাইরে দুজনকে প্রার্থী করা হয়েছে। তাঁরা হলেন সহমিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক প্রার্থী ফাহিম মুনতাসির এবং নির্বাহী সদস্য পদে লড়বেন আসাদ সাদিক।

দাবি আদায়ের মাঠে থাকা ‘বড় শক্তি’

শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়ার আন্দোলনে বাম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সব সময় মাঠে দেখা গেছে। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতেও তাঁরা তৎপর থেকেছেন। সংখ্যায় কম থাকলেও আন্দোলনের জায়গায় পিছিয়ে ছিলেন না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন অপকর্ম ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও বাম নেতারা ছিলেন সোচ্চার।

শিক্ষার্থীদের আবাসন, খাদ্য, পরিবহনসংকট, ফি কমানো, নারীদের নিরাপত্তাসহ নানা ইস্যুতে আন্দোলন করে আসছে বাম সংগঠনগুলো। জুলাই আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল তারা। এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ফুয়াদ রাতুল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের একজন।

বাম নেতারা বলছেন, নব্বই–পরবর্তী বাম রাজনীতির ক্রান্তিকাল চলছে। এর পর থেকে আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়ে গেছে। সেই ছায়া পড়েছে প্রগতিশীল রাজনীতিতে। অন্য সংগঠনগুলোতে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাম রাজনীতি করলে সেই সুবিধা পাওয়া যায় না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে বাম সংগঠনগুলো যে সব সময় সক্রিয় থেকেছে, এটাকেই রাকসু নির্বাচনে একটা বড় শক্তি মনে করছেন তাঁরা।

বামদের প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ও ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পক্ষে আন্দোলন করায় আমরা ক্যাম্পাসে পরিচিত। সে হিসেবে আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে পরীক্ষিত। বিগত দিনে আমরা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের প্রধান কণ্ঠ ছিলাম। আমাদের তারা মূল্যায়ন করবে। আমাদের এই লড়াই–ই বড় শক্তি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শাকসু নির্বাচন সামনে রেখে একাধিক শর্তে ছাত্ররাজনীতি চালুর সুপারিশ
  • ভিন্ন পরিবেশে নির্বাচন, সবারই প্রথম অভিজ্ঞতা
  • রাকসু নির্বাচনে বামদের প্যানেলে নারী একজন, শক্তি ‘ধারাবাহিক লড়াই’
  • শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে কেমন ছাত্ররাজনীতি দেখতে চান