প্রথম মেয়াদ বিভিন্ন কারণে সমালোচিত হলেও আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের আগেই ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন করলেন। ১১ জানুয়ারি তাঁর বিশেষ দূত স্টিভেন উইটকে তিনি ইসরায়েলে পাঠান। উইট প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহুকে তাঁর (ট্রাম্প) স্পষ্ট বার্তা ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি চান’ পৌঁছে দেন, যা প্রত্যাখ্যান করার কোনো উপায় ইসরায়েলের ছিল না। অবশেষে ১৫ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের উপস্থিতিতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রাথমিকভাবে এ চুক্তির মেয়াদ ৬ সপ্তাহের জন্য। চুক্তির প্রথম ধাপে হামাস ৩৩ জন ইসরায়েলি বন্দি মুক্তি দেবে। একজন বন্দি মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েল ৩০ জন বন্দি মুক্তি দেবে। ১৯ জানুয়ারি স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় চুক্তি কার্যকরের পর হামাস ৩ জন ইসরায়েলি নারী বন্দি মুক্তি দেয়। 

গাজা যুদ্ধের প্রথম থেকেই সব আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি উপেক্ষা করা হয়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ বেসামরিক লোকজন, অ্যাম্বুলেন্স, শিশু ও বৃদ্ধদের লক্ষ্যে পরিণত করেছে। নির্বিচারে বেসামরিক জনগণ ও স্থাপনার ওপর হামলা করেছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া পর্যন্ত হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়াসহ (৩১ জুলাই নিহত) ৪৬ হাজার ৯১৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ১০ হাজার ৭৫০ জন আহত হয়। তবে যুদ্ধে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের চেয়ে ৪১ শতাংশ বেশি বলে ৯ জানুয়ারি চিকিৎসা-বিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে গাজায় ৪ লাখ ৩৬ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ও আংশিক ধ্বংস হয়েছে, যা গাজার মোট ভবনের ৭০ শতাংশ। গাজার ২৩ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ১৯ লাখ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত (আইডিপি) অথবা প্রতিবেশী দেশে উদ্বাস্তু (শরণার্থী) হয়েছে, যা গাজার মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ। গাজার ৬৭ শতাংশ আবাদি জমি ৮৫ হাজার টন বোমার বিস্ফোরণে এখন চাষাবাদের অযোগ্য। গাজার অবশিষ্ট হাসপাতালগুলোর ৫০ শতাংশই বন্ধ অথবা বন্ধপ্রায়, যা জ্বালানি অনিশ্চয়তা না কাটালে বন্ধ হয়ে যাবে যে কোনো সময়। 

জেনেভা কনভেনশন (১৯৪৯) অনুসারে যুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক সংঘাতে যুদ্ধাহত, যুদ্ধবন্দি এবং বেসামরিক মানুষ ও স্থাপনার নিরাপত্তা দিতে কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী ১৯৬টি দেশগুলো অঙ্গীকারবদ্ধ। কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধকালে সাংস্কৃতিক সম্পত্তি ও ঐতিহ্য, ধর্মীয় কেন্দ্র/উপাসনালয়, হাসপাতাল, সশস্ত্র বাহিনীর মেডিকেল ইউনিটের যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স, রেড ক্রস স্থাপনা ইত্যাদির সুরক্ষা প্রদানে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো অঙ্গীকারবদ্ধ। উপরন্তু কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্রগুলো আরও কিছু বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যেমন আহত সৈন্যের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং নির্বিঘ্ন ওষুধ, পানি, খাদ্য পরিবহন ইত্যাদি। বাস্তবে আইডিএফ অ্যাম্বুলেন্স, মসজিদ, চার্চ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঐতিহাসিক স্থাপনা, স্কুল, বাড়িঘরসহ বেসামরিক স্থাপনা সবকিছুতেই আক্রমণ করছে। অনেকবার আইডিএফ ত্রাণ পরিবহনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কেবল বেসামরিক জনগণই শুধু নয়, হত্যা করেছে ১৩ হাজার ৩১৯ শিশুকে। বেঁচে থাকা ৯০ শতাংশ শিশু এখন পুষ্টিহীনতার শিকার। 

আইডিএফের আগ্রাসনে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৬০ জন চিকিৎসক এবং ৩৪১ জন ত্রাণকর্মী। এমনকি মৃত সৈন্য ও বেসামরিক মানুষকেও অসম্মান দেখিয়ে গাড়ির সামনে ঝুলিয়ে ছুটে চলে জেনেভা কনভেনশনকে উপেক্ষা করেছে। উল্লেখ্য, ইসরায়েল ১৯৫১ সালে জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। আইডিএফ শরণার্থীদেরও নিরাপদ থাকতে দেয়নি। অধিকাংশই একাধিকবার স্থানান্তরিত হয়েছেন, যা ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ রিফিউজি কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কনভেনশনের প্রথম অঙ্গীকারই– শরণার্থীদের নিজ আশ্রয়স্থল থেকে বিতাড়িত করা যাবে না; তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। 
যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও যুদ্ধ শেষ হয়নি। ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই একে অন্যকে হুমকি দিয়েছে– যুদ্ধবিরতির শর্ত পূরণ না হলে যে কোনো সময় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘিত হবে। এমনই পরিস্থিতিতে গাজার ৯১ শতাংশ মানুষ এখন খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে আছে। যুদ্ধে গাজার ৫ হাজার ৩২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (৯৫ শতাংশ) ধ্বংস হয়েছে। ফলে ৬ লাখ ৬০ হাজার শিশু এখন শিক্ষাবঞ্চিত। গাজার ১৯ লাখ আইডিপি বা উদ্বাস্তু বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকলেও তাদের ঘর এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ; জাতিসংঘের হিসাব অনুসারেই তা পরিষ্কার করতে কমপক্ষে ১৫ বছর সময় লাগবে।

আশা করা যায়, জাতিসংঘ, রেড ক্রস ও সব আন্তর্জাতিক সংস্থা এখন গাজা পুনরুদ্ধারে (রিকভারি) এগিয়ে আসবে। দীর্ঘ ১৫ মাস অমানবিকতার শিকার গাজাবাসীর জন্য এখন প্রয়োজন নিরাপদ বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিরাপত্তা। পাশাপাশি প্রত্যেক মানুষের জন্য দরকার মনোসামাজিক সহায়তা (সাইকো-সোশ্যাল সাপোর্ট-পিএসএস), যে কোনো দুর্যোগ-পরবর্তীকালীন পুনরুদ্ধার উদ্যোগে যা অগ্রাধিকারযোগ্য। জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী, গাজার ১০ লাখ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দরকার। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পিএসএস আইডিএফ সদস্যদের জন্যও প্রযোজ্য। গণমাধ্যমের সংবাদে বলা হয়েছে, গাজায় আগ্রাসনের জন্য অনুশোচনায় ভুগছে ইসরায়েলি সৈন্যরা; এমনকি ৩৮ জন আইডিএফ সদস্য আত্মহত্যা করেছে। অনেকে মানবতাবিধ্বংসী যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকার করেছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও অঙ্গীকার অনুসারে তাদেরও (যারা যুদ্ধে আর অংশগ্রহণ করবে না) সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সাময়িক নয়, স্থায়ী যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংলাপ অব্যাহত রাখা চাই, যাতে নতুন করে আর মানবতা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি না হয়।

এম.

এ. হালিম: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং দুর্যোগ, জলবায়ু
ও মানবিক-বিষয়ক বিশ্লেষক 
[email protected]

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র জন য প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদ না হলে অবরোধের হুঁশিয়ারি আপ বাংলাদেশের

জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারির দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস (আপ) বাংলাদেশ। আজ শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে গণজমায়েত থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। দাবি পূরণ না হলে ৬ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে অবরোধ কর্মসূচি পালনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি।

‘৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের দাবি’ শীর্ষক গণজমায়েতে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আপ বাংলাদেশের নেতা–কর্মীরা। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পার হলেও জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারি না হওয়াকে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন তাঁরা।

আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, ‘আমরা একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু আহতদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। আমরা দেখেছি, যারা জুলাইয়ের নেতৃত্বে ছিল, জুলাইয়ের পরে তাদের পকেট ভারী হয়েছে। আমি বলতে চাই, আপনাদের এই পকেটের হিসাব দিতে হবে।’

অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে আলী আহসান বলেন, ‘আপনারা জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে পারবেন কি পারবেন না, তা জানান; না পারলে আমরা আছি। যারা জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম, বাংলাদেশের (সেই) ২০ কোটি জনগণ জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করবে।’

আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক বলেন, ‘৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে যদি জুলাই ঘোষণাপত্র না হয়, তাহলে ৬ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে অবরোধ শুরু হবে। এ সরকারের কোনো হুমকি আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।’

গণজমায়েতে অংশ নিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বলেন, আপ বাংলাদেশের নেতারা এখনো কোনো প্রটোকল ছাড়া রাস্তাঘাটে হাঁটেন। কিন্তু তাঁরা যেদিন প্রটোকল নিতে শুরু করবেন, সেদিন থেকে তাঁদের বিরুদ্ধেও তিনি কথা বলা শুরু করবেন।

জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারির আহ্বান জানিয়ে শরীফ ওসমান বলেন, এখন পর্যন্ত বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় জুলাই শহীদেরা রাষ্ট্রদ্রোহী। তাঁদেরকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আজকের মধ্যে সরকার দিনক্ষণ না জানালে আগামী ৩ তারিখ (আগস্ট) ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে কফিন মিছিল নিয়ে সচিবালয় অবরোধ করা হবে।

বিগত এক বছর থেকে একটি দুর্বল সরকার দেশ চালাচ্ছে উল্লেখ করে আপ বাংলাদেশের সদস্যসচিব আরেফিন মোহাম্মদ বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে ঘোষণাপত্রের জন্য আমাদের আবারও গণজমায়েত করতে হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এ বি জুবায়ের বলেন, ‘আমরা যে মৌলিক সংস্কার চেয়েছিলাম, এখনো তার কিছুই হয়নি। এখনো শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত হয়নি। আমি উপদেষ্টাদের উদ্দেশে বলতে চাই, অবিলম্বে জুলাই সনদ ঘোষণা করুন। আপনাদের কাছে আমাদের চাওয়া–পাওয়া খুব বেশি নেই।’

গণজমায়েতে র‌্যাপ গান পরিবেশন করেন আপ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য আহনাফ তাহমিদ। স্বাগত বক্তব্য দেন জুলাই শহীদ ওসমান পাটোয়ারীর বাবা আবদুর রহমান। গণজমায়েতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন আপ বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী রাফে সালমান রিফাত, প্রধান সংগঠক নাঈম আহমেদ, মুখপাত্র শাহরিন সুলতানা প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ