কৌশল বদলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সোনালী ব্যাংক
Published: 16th, February 2025 GMT
হল–মার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ থেকে ’১২ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছিল গ্রুপটি। এই ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। শেষ পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাকে জেলে যেতে হয়। ওই সময়কার বড় এই ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর ব্যাংকটির পুনর্গঠন শুরু হয়। তাতে ধীরে ধীরে দেশের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকের প্রতি আবারও আস্থা ফিরতে শুরু করে আমানতকারীদের।
সোনালী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকায়। ২০১২ সালে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ঋণের ৩৩ শতাংশই সরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া।
হল–মার্কের ঘটনার পর সোনালী ব্যাংক তাদের ঋণের গতি কমিয়ে দেয়। কৌশলও পাল্টে ফেলে। আগ্রাসী ঋণ না দিয়ে ব্যাংকটি সরকারি বিভিন্ন পণ্যে বিনিয়োগ করতে থাকে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার বদলে অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিয়ে সুদ আয়ের পথ বেছে নেয়। আর তাতে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি মজবুত হতে শুরু করে। বেড়েছে গ্রাহকও। এক যুগ আগে ব্যাংকটির গ্রাহক ছিল ১ কোটির ঘরে। এখন সেই সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে সরকারি-বেসরকারি খাতের এক ডজন ব্যাংকে বড় ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। তবে এই দুই মেয়াদে সোনালী ব্যাংক রক্ষা পায় প্রভাবশালীদের হাত থেকে। আওয়ামী লীগ সরকার–ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি প্রভাব খাটিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চাইলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নানা কৌশলে তাদের ফিরিয়ে দেয়। আর তাতেই রক্ষা পায় ব্যাংকটি। সোনালী ব্যাংকে এখন সবচেয়ে বেশি আমানত। ২০২৪ সালে পরিচালন মুনাফায় শীর্ষে ছিল ব্যাংকটি। দেশজুড়ে ব্যাংক শাখার দিক থেকেও সোনালী ব্যাংক শীর্ষে। তবে পুরোনো কিছু খেলাপি গ্রাহক, হল–মার্ক কেলেঙ্কারির দায় এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে।
ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.
হল–মার্কের খেলাপি ঋণ আদায় সম্পর্কে শওকত আলী খান বলেন, গ্রুপটির কাছে যত পাওনা, তার চেয়ে বন্ধকি সম্পদের মূল্য বেশি। আদালতের চূড়ান্ত আদেশ পেলে সামনে এসব সম্পদ খণ্ড খণ্ড করে বিক্রির পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া গত বছর গ্রুপটি থেকে ৬ কোটি টাকা আদায় হয়েছে।
ধারাবাহিক অগ্রগতি
২০১০ সালে ব্যাংকটির আমানত ও ঋণ ছিল যথাক্রমে ৪৭ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা ও ২৮ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। ওই বছর গ্রাহক হিসাব ছিল ৯১ লাখ ৮২ হাজার ১৫৫ জন। খেলাপি ঋণ ছিল ৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২৪ শতাংশ। ২০১০ সালে ব্যাংকটির নিট লোকসান হয় ৯৮ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয় ৩৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, খেলাপি ঋণও বেশ কমে আসে। ফলে নিট মুনাফা করে ৯৯৬ কোটি টাকা; যা এখন পর্যন্ত ব্যাংকটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফা।
এরপর ২০১২ সালে এসে হল–মার্ক গ্রুপের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা চিহ্নিত হয়। ফলে ওই বছর শেষে ব্যাংকটি ২ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা লোকসান করে। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর ব্যাংকটির প্রকৃত সুদ আয় ছিল ঋণাত্মক। অর্থাৎ ঋণ থেকে যে সুদ আয় হতো, আমানতকারীদের তার চেয়ে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার কৌশল হিসেবে ব্যাংকটি ট্রেজারি বিনিয়োগ, সরকারকে ঋণ দেওয়াসহ অন্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। পাশাপাশি অন্য ব্যাংকের কিছু ঋণও নিয়ে নেয়। তাতে ২০২২ সালে ঋণ থেকে সুদ আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০৯ কোটি টাকায়। ২০২৩ সালে তা আরও বেড়ে হয় ৪৭৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ব্যাংকটি ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা সুদ আয় করে।
২০২২ সালে ব্যাংকটির নিট মুনাফা দাঁড়ায় ৬৫২ কোটি টাকায়। ২০২৩ সালেও ৬৫২ কোটি টাকা মুনাফা করে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে সোনালী ব্যাংক ৫ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে, এটি ব্যাংক খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ মুনাফা। তবে এখনো নিট মুনাফার হিসাব চূড়ান্ত হয়নি।
শীর্ষ খেলাপি ও অবলোপন ঋণ যাদের
ব্যাংকটির নথিপত্র অনুযায়ী, শীর্ষ-২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে ৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে এসব গ্রাহক থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ১২১ কোটি টাকা। এ ছাড়া অবলোপন করা হয়েছে এমন শীর্ষ ২০ গ্রাহকের ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। বিদায়ী বছরে এসব গ্রাহক থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ২ কোটি টাকা।
শীর্ষ-২০ খেলাপি গ্রাহকের মধ্যে রয়েছে হল–মার্ক গ্রুপের টিএন্ড ব্রাদার্স ও হল–মার্ক গ্রুপ, রূপসী গ্রুপ, মডার্ন স্টিল, তাইপেই বাংলা ফেব্রিকস, ফেয়ার ট্রেড ফেব্রিকস, রহমান গ্রুপ। অন্য শীর্ষ খেলাপিরা হলো অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, মুন্নু ফেব্রিকস, লীনা গ্রুপ, রতনপুর স্টিল, মাগুরা পেপার মিলস, এপেক্স উইভিং, বিশ্বাস গার্মেন্টস, রেজা জুট, মেঘনা কনডেন্স মিল্ক, সোনালী জুট, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, সুপ্রিম জুট অ্যান্ড নিটেক্স ও শরীফ জুট ট্রেডিং।
অবলোপন করা ঋণের মধ্যে হল–মার্ক গ্রুপের ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। অন্যরা হলো নিউ রাখী টেক্সটাইল, জাসমীর ভেজিটেবল, ফেরার এক্সপো, আলফা টোব্যাকো, ওয়ান স্পিনিং মিলস, ইম্পিরিয়াল ডাইয়িং, রোকেয়া টেক্সটাইল, সাহিল ফ্যাশন, ইমাম ট্রেডার্স, সুমির সোয়েটার, ইউনিটি নিটওয়্যার, সিদ্দিক ট্রেডার্স, কেপিএফ টেক্সটাইল, মুন নিটওয়্যার, এআরখান সাইজিং, সাহিল নিটওয়্যার, মাস্ক সোয়েটার, জালালাবাদ ফার্মাসিউটিক্যালস ইত্যাদি।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে সরকার পতনের পর ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে। তাতে গত বছর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হল ম র ক গ র প র র ঘটন র পর হল ম র ক র ২০২৪ স ল ক র ঋণ ঋণ র প স দ আয় র ঋণ র গ র হক সরক র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
মুক্তিপণ দিয়েও পাঁচ মাস ধরে ১৪ তরুণের খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনেরা
অবৈধ পথে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ১৪ তরুণ। কিন্তু দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর পাঁচ মাস ধরে তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্বজনদের দাবি, দালালের প্রলোভনে পড়ে জনপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণও দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু সন্ধান না পাওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
ইউরোপের কোনো দেশে গেলে সচ্ছলতা আসবে, এমন ধারণা নিয়ে প্রতিবছর মাদারীপুর থেকে শত শত তরুণ সেখানে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন। তবে অবৈধ পথে ইউরোপ যেতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। কেউবা দালালের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে কাটাচ্ছেন বন্দিজীবন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত জেলার ৪৫ জন লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মারা গেছেন। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছেন অন্তত ৩৫০ তরুণ। নিখোঁজ আছেন তিন শতাধিক।
সবশেষ নিখোঁজ তরুণদের সবার বাড়ি রাজৈরের বাজিতপুর ইউনিয়নে। তাঁরা হলেন পাখুল্লা গ্রামের জাহাঙ্গীর ব্যাপারীর ছেলে সালমান ব্যাপারী, চৌরাশী গ্রামের মোসলেম শিকদারের ছেলে বাবুল শিকদার, একই গ্রামের মজিবর বয়াতীর ছেলে সাজ্জাদ বয়াতী, জাকির মাতুব্বরের ছেলে বাদল মাতুব্বর, কানাই রায়ের ছেলে লিটন রায়, নিরঞ্জন বাড়ৈর ছেলে বাঁধন বাড়ৈ, কিসমদ্দি বাজিতপুর গ্রামের আলম চৌকিদারের ছেলে ইমন চৌকিদার, অহিদুল মাতুব্বরের ছেলে নয়ন মাতুব্বর, আজিজ খালাসির ছেলে খলিল খালাসি, সোনা মিয়া চৌকিদারের ছেলে সোহেল চৌকিদার, নয়াকান্দি বাজিতপুর গ্রামের গৌরাঙ্গ বাড়ৈর ছেলে গৌতম বাড়ৈ, একই গ্রামের সামচু সরদারের ছেলে ইমরান সরদার, শ্রীনাথদী বাজিতপুরের জলিল বয়াতীর ছেলে আল আমিন বয়াতি ও শ্রীনদী গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান ঘরামির ছেলে আলী ঘরামি। তাঁদের সবার বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে।
স্বজনদের অভিযোগ, মানব পাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য বাজিতপুর এলাকার বাবুল হাওলাদার ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে প্রথমে ১৬ লাখ টাকা করে নেন। পরে লিবিয়ায় বন্দী করে আদায় করেন আরও ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এর পর থেকে ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছেন অভিযুক্ত বাবুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
মাদারীপুরের ১৪ তরুণ ইতালি যেতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে দালালের হাত ধরে ঘর ছাড়েন। নিখোঁজ তরুণদের সন্ধানে তাদের ছবি হাতে স্বজনেরা