বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নির্দিষ্ট সরকারের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়
Published: 18th, February 2025 GMT
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক নির্দিষ্ট কোনো সরকারের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। দুই দেশের স্বার্থের ভিত্তিতেই সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া উচিত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই মন্তব্য করেন। সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, সীমান্ত হত্যা, আদানি বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং প্রধান উপদেষ্টা ড.
নিচে সাক্ষাৎকারটির কিছু অংশ তুলে ধরা হলো—
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা
দ্য হিন্দু: পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে আপনার বৈঠক সম্পর্কে আমাদের বলুন...
তৌহিদ হোসেন: বৈঠকের শুরুটা কিছুটা উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। ভারত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে এক ধরনের সম্পর্কে অভ্যস্ত ছিল, যা হঠাৎ পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে প্রথম দিকে কিছুটা অস্বস্তি ছিল। তবে ছয় মাস পর এখন আমরা আরও ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পারছি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য আলোচনা চলছে। বিশেষ করে বাণিজ্য ও অন্যান্য কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
দ্য হিন্দু: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে দেখা করেছেন এবং পররাষ্ট্র সচিবের মতে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের কিছু উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। আপনি কি জয়শঙ্করকে এই উদ্বেগের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন?
তৌহিদ হোসেন: আসলেই না। আমি জিজ্ঞাসা করিনি, কারণ এটি ভারতের ব্যাপার (তারা অন্য দেশের সাথে কী আলোচনা করবে)। আমি মনে করি না খুব বেশি উদ্বেগ থাকা উচিত। আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত, যা ইতোমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে ঘটছে। উদাহরণস্বরূপ, বাণিজ্যে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও ভারতের উদ্বেগ
দ্য হিন্দু: ভারত বারবার অভিযোগ করছে যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা হচ্ছে। ভারত কি মনে করে বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে?
তৌহিদ হোসেন: বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করেন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব, এবং সরকার সেই দায়িত্ব পালন করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ৫ আগস্টের পর ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অতিরঞ্জিত প্রচার হয়েছে, যার বেশিরভাগই ভিত্তিহীন।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল না। সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর তদন্ত চলছে।
শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন ও ভারতের ভূমিকা
দ্য হিন্দু: শেখ হাসিনার বিষয়ে ভারত ঠিক কী করবে বলে আপনি আশা করছেন?
তৌহিদ হোসেন: তার (হাসিনা) বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। আমরা ভারতকে তাকে বিচারের জন্য ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেছি। যদি তা না হয়, তাহলে অন্তত তার ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত, যেন তিনি উস্কানিমূলক বক্তব্য না দেন যা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছড়াতে পারে।
দ্য হিন্দু: আপনার সরকার কি শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ জানাবে?
তৌহিদ হোসেন: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। আমরা ভারতের কাছ থেকে আগেও অপরাধীদের ফেরত এনেছি। শেখ হাসিনার বিষয়ে মামলা আদালতে রয়েছে, এবং সেই প্রক্রিয়া চলমান। তবে আমরা চাই, ভারতে থাকাকালীন তিনি যেন কোনো উস্কানিমূলক বক্তব্য না দেন।
দ্য হিন্দু: তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাংচুর করার জন্য জনতাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
তৌহিদ হোসেন: বিক্ষুব্ধ জনতা কিছু করতে পারে, কিন্তু তাতে সরকারের সমর্থন নেই।
দ্য হিন্দু: আপনার সরকার এখন পর্যন্ত শুধু মৌখিক নোট পাঠিয়েছে, যা হাসিনার প্রত্যাবর্তনের জন্য একটি কূটনৈতিক নোট। আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানো হবে?
তৌহিদ হোসেন: আমাদের (বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে) একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে এবং আমরা অনেক অভিযুক্তকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ভারতে ফিরিয়ে দিয়েছি এবং আমি মনে করি ভারতও তাকে (হাসিনা) বাংলাদেশে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ফিরিয়ে দিতে পারে।
দ্য হিন্দু: কিন্তু সেই প্রত্যর্পণ চুক্তির জন্য আপনাকে বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এমএলএটি (পারস্পরিক আইনি সহায়তা) এর জন্য আপনার পর্যাপ্ত ওয়ারেন্ট থাকতে হবে। বাংলাদেশ কখন সেই প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে আশা করছে?
তৌহিদ হোসেন: ঠিক আছে, সেই প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই চলমান রয়েছে, কারণ মামলাগুলো এখন আদালতে রয়েছে। আমরা তাদের (তাড়াহুড়ো করে) কাজ করতে বাধ্য করতে পারি না। এবং আমরা এই বিষয়েও অবগত যে— তিনি (হাসিনা) ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে পারে। এতে সময় লাগতে পারে, কিন্তু আমরা যা চাই তা হলো— তিনি (হাসিনা) ভারতে থাকাকালীন কোনও ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেবেন না।
সীমান্ত হত্যা ও জেলেদের ওপর নির্যাতন
দ্য হিন্দু: সীমান্তে বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যার বিষয়টি নিয়ে ভারত কী বলছে?
তৌহিদ হোসেন: ২০২৪ সালে, যার অর্ধেক সময় আগের সরকারের অধীনে ছিল, ২৪ জন বাংলাদেশি সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এটি বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না। যদি কেউ অপরাধ করে, তাকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে, আদালতে পাঠানো যেতে পারে, কিন্তু সরাসরি গুলি করে হত্যা করা অগ্রহণযোগ্য। ভারত চাইলে এটি বন্ধ করতে পারে এবং এটি বন্ধ হওয়া উচিত।
দ্য হিন্দু: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, বাংলাদেশে বন্দী কিছু ভারতীয় জেলেকে নির্যাতন করা হয়েছে। আপনি কী বলবেন?
তৌহিদ হোসেন: সীমান্ত সমস্যার মতোই, সমুদ্রসীমার ক্ষেত্রেও কিছু জটিলতা আছে। জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে দুই দেশের সীমানা অতিক্রম করতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারত একে অপরের বন্দী জেলেদের পর্যায়ক্রমে মুক্তি দিয়ে থাকে। তবে নির্যাতনের বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। যদি কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আইন ভঙ্গ করে থাকে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আদানি বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা
দ্য হিন্দু: আদানি বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ এই গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পেতে আবার আলোচনা করছে। এটি কতটা সত্য?
তৌহিদ হোসেন: বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি অনুযায়ী, আমরা আদানি গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে কয়লার দাম সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। বিদ্যুতের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা যৌক্তিক নয়। আমরা আশা করি, আদানি গ্রুপের সঙ্গে আরও ভালোভাবে আলোচনা করে একটি ন্যায্য সমাধানে পৌঁছানো যাবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য বৈঠক
দ্য হিন্দু: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি বিমসটেক সম্মেলনে বৈঠক করতে পারেন?
তৌহিদ হোসেন: এখন পর্যন্ত দুই নেতা একই সময়ে একই স্থানে ছিলেন না, তাই সরাসরি বৈঠকের সুযোগ হয়নি। তবে বিমসটেক সম্মেলনে তারা একসঙ্গে থাকবেন। এ ধরনের বৈঠক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। শীর্ষ নেতারা একসঙ্গে বসলে অনেক সময় এক কথায় বড় সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
দ্য হিন্দু: ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের ভালো সম্পর্ক ছিল। আপনি কি মনে করেন সেটি আবার আগের মতো হতে পারে?
তৌহিদ হোসেন: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোনো সরকারের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। সম্পর্ক গড়ে ওঠে পারস্পরিক স্বার্থ ও শ্রদ্ধার ওপর। বিএনপি সরকারের সময়ও (২০০১-২০০৬) দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল। গঙ্গা পানি চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় (১৯৯৬-২০০১) হয়েছিল।
আমাদের সম্পর্ককে কোনো নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না করে দুই দেশের স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণের ভিত্তিতে এগিয়ে নেওয়া উচিত। ভারত ও বাংলাদেশের একসঙ্গে কাজ করার অনেক ক্ষেত্র আছে, যা সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পরর ষ ট র উপদ ষ ট র ওপর ন র র র জন য উপদ ষ ট সরক র র আম দ র আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর লম্বা মিছিল
তিন দিন পর অবশেষে শুক্রবার ১৩ জুন দুই বোনের লাশ মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীতে ভেসে ওঠে। রাইসা ও জান্নাত মামাতো-ফুফাতো বোন। তারা আর হাসবে না। বই–খাতা, স্কুলড্রেস সব আছে, শুধু তারা তারা হয়ে গেছে দূর আকাশে। ১৩ বছরের জান্নাত ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ গিয়েছিল ঈদের ছুটিতে। তার এক বছরের ছোট মামাতো বোন রাইসার সঙ্গে খুব খাতির। ঈদ উপলক্ষে একসঙ্গে হাতে মেহেদিও দিয়েছিল দুজন। নানার বাড়ির কাছেই গজারিয়া নদী। সেখানে তারা বুধবার ১১ জুন যায় গোসল করতে। বলা হচ্ছে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে তারা নিখোঁজ হয়। ঈদের ছুটির আগে-পরে (৫ জুন-১৪ জুন) এ রকম প্রায় ৬৬টি ঘটনায় ৭৮ জন ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মর্মান্তিক সব মৃত্যুর খবর এখনো আসছে।
যেকোনো বড় ছুটিতে ‘বাড়ির’ জন্য রওনা দিলেই সবাই পৌঁছাতে পারে না, আবার পৌঁছালেও সবার আর ফেরা হয় না কর্মস্থলে, স্কুলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, খেলার মাঠে বন্ধুদের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটে। শিশুরা এ সময় বেশি মারা যায় পানিতে ডুবে। এবার সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল। গণমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উল্লিখিত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় হাসপাতাল আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ।
৭৮টি মৃতদেহের মধ্যে মাত্র ১২টি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের। বাকি ৬৬ জনই শিশু–কিশোর। এদের বয়স ১০ মাস থেকে ১৭ বছর। ৬৬ জনের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ৫ বছরের নিচে। বাংলাদেশে এখন ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু।
ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে প্রতিবছর ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ ডুবে মারা যায়। এটি সে দেশের মোট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ দিনে মারা যায় প্রায় ৪০ জন।
এটা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ভারতের চেয়ে বেশি।
বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান মনে করেন, সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।
টিকা দিয়ে বা সময়মতো চিকিৎসায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অকালমৃত্যু ঠেকানো গেলেও ‘লাভের গুড় পিঁপড়ে’ মানে পানিতে খেয়ে যাচ্ছে। শিশুরা ডুবে মারা যাচ্ছে পানির বালতিতে, ডোবায়, পুকুরে, খালে, নদীতে।
একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুরাইসা আর জান্নাতের মতো কমপক্ষে ১৬ জন মারা গেছে, যারা একে অপরের বোন বা ভাই। মেহেন্দিগঞ্জে রাইসা ও জান্নাতের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানা না গেলেও ফরিদপুরের সালথায় তানহা নিজের ভাই তালহাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। তখন তানহা নিজেও পানিতে ডুবে যায়। যে কজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডুবে মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই প্রিয়জনদের বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছেন। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে পারবেন। আসলে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারের কৌশল জানা না থাকলে শুধু সাঁতারের জ্ঞান দিয়ে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রাণঘাতী প্রচেষ্টার নামান্তরমাত্র। একইভাবে আমি সাঁতার জানি বলেই আরেকজনকে সাঁতার শেখাতে পারব, এমন ভাবনার কোনো মানে নেই। সব খেলোয়াড় যেমন কোচ হতে পারেন না, তেমনি সব সাঁতারুই সাঁতারের প্রশিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত নন। এবার যে চারজন অভিভাবক ডুবে মারা গেছেন, তাঁরা সবাই সাঁতার শেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। সাঁতার শেখানো কোনো তামাশা বা ফান নয়। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।
এত মৃত্যুর কারণ কীএই প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ধারাবাহিক গবেষণা দরকার।
যেসব কারণ কথিত বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করে থাকেন, তা নিতান্তই অনুমাননির্ভর। গত শুক্রবার (১৩ জুন) দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় তিন শিশু (রাফা (২), তাসিব (২) ও তুহিন (৫) ডুবে মারা গেলে সংবাদকর্মীরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমাননির্ভর ধারণা থেকে জানান, শিশুর মৃত্যুর জন্য মূলত অভিভাবকেরাই অনেকটা দায়ী। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি তেমন নজর দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরের পাশেই পুকুর বা ডোবা রয়েছে। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে প্রায় পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
এবারের মৃত্যুতালিকা দেখলে জানা যাবে অনেকেই তাঁদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। কাজেই ছেলেমেয়ে বেশি, তাই নজরদারি নেই, এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত। ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। ওয়ারিশজনিত জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে খুনখারাবি, শিশুহত্যা এ দেশে নতুন কিছু নয়। বড় ছুটির সুযোগ কেউ নিচ্ছে না তো?
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর নানা কারণ আমাদের প্রকল্পনির্ভর গবেষকেরা খুঁজে বের করেছেন। মা ও অভিভাবকদের গাফিলতি আর সাঁতার না জানাকেই মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্র জারি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা, ছয় বছর বা তার চেয়ে বড় শিশুদের জন্য সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো কি বড় ছুটিতে খোলা থাকবে? ছুটিতে যখন গ্রামে শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাবে তখন কি তাদের দিবাযত্ন কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নের কেউ জবাব দেওয়ার নেই।
গত কয়েক বছরের পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে অন্য একটা কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে সেই কারণটি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম জানাচ্ছে, হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝোঁক আছে, এমন শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা একেবারেই কম নয়। খিঁচুনির নানা ধরন থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণভাবে এটা মৃগীরোগ নামে পরিচিত। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম ২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত ২২ জনের বিস্তারিত খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখে এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজনের খিঁচুনি বা মৃগীরোগের প্রভাব ছিল।
গত মে মাসে বড় জোয়ারের সময় মহেশখালীতে যে তিনজন (জামাল মিয়া, দানু মিয়া, ঝুমু) পানিতে ডুবে মারা যান, তাঁদের প্রত্যেকের মৃগীরোগের প্রভাব ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ড. লে সানডার এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত যে মৃগীরোগের উপসর্গ থাকলে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তিনি ও তাঁর দল ৮৮টি পানিতে ডোবার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই মৃগী বা মৃগীরোগ-সংক্রান্ত কোনো না কোনো জটিলতায় ভুগছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা মেডপেজ টুডে লে সানডার–এর গবেষণার সূত্র ধরে জানিয়েছে, অন্যদের চেয়ে মৃগীরোগীদের পানিতে ডোবার আশঙ্কা ২০ গুণ বেশি। আবার বিশেষ ধরনের মৃগীরোগীর ক্ষেত্রে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭ গুণ।
মৃগীরোগীর সংখ্যা কম নয়বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মৃগীরোগের উপসর্গ নিয়ে অনেক শিশু আমাদের পরিবারে, পাড়ায়, সমাজে অবহেলায় বেঁচে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বয়সের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ—সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগ্রহে এবং আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত একটি জরিপ চালানো হয়। এটাই ছিল মৃগীরোগীর সংখ্যা নিরূপণের প্রথম জরিপ। কাকতালীয়ভাবে এই জরিপের ফলাফলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মৃগীরোগীর তথ্য হুবহু মিলে যায়। শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের দেশেও প্রতি হাজারে ৯ জন মৃগীরোগী আছে বলে এই জরিপে জানা যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মোট মৃগীরোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লাখের মতো। বলে রাখা ভালো, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মৃগীরোগীর গড় সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য আছে।
শিশুর মধ্যে কী কী আলামত দেখলে প্রাথমিকভাবে মৃগীরোগের সন্দেহ করা করা যায়:
এক. হঠাৎ করে কোনো শিশু চোখ-মুখ উল্টিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে আর তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হলে।
দুই. কোনো শিশু যদি চোখের পলক না ফেলে হঠাৎ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বা অন্যমনস্ক হয়ে গেলে। অনেক ক্ষেত্রে হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়। (অভিভাবকেরা অনেক সময় ভাবেন, এটা শিশুর কাব্যিক ভাব। সন্তান তার কবি হয়ে উঠছে।)
তিন. আপাতদৃষ্টে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এক শিশু যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করে। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা করে। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করে। আবার কয়েক মিনিট পর আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়।
চার. পানি বা আগুনের কাছে গেলেই হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে।
পাঁচ. শিশু চোখেমুখে অন্ধকার দেখার কথা বলে। চোখে আলোর ঝিলিক দেখে, তারপর আর কিছু বলতে পারে না।
এসবের কোনোটাই আমাদের উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, মৃগী কোনো অভিশাপ নয় বা দৈব কোনো রোগ নয়। মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি অসুখ, যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের শিশু এমনকি বয়স্ক মানুষেরও এটা হতে পারে।
পানিতে নামতে না দেওয়া ছাড়াও এ ধরনের শিশুদের গাছে চড়তে দেওয়া ঠিক নয়। যেসব শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছে, তাদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর স্রোত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কিনিয়ত ঠিক থাকলে অবশ্যই সম্ভব। ২০১৯ সালে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। ৮৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশুযত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তাঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।
গ্রামে আগে শিশুদের কোমরে পিতলের একটা ছোট্ট ঘণ্টি বেঁধে দেওয়া হতো। এটা কোনো অলংকার ছিল না। কর্মব্যস্ত মায়ের কান থাকত সেই ঘণ্টির দিকে। সচেতন অভিভাবকেরা বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারেন। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২২ সালে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ শিশুকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা এবং সুইমসেফ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলাকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন প্রয়োজন এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে স্থানীয় অভিভাবক ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে তাদের নেতৃত্বে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
লেখক গবেষক: [email protected]