মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ইউক্রেন নিয়ে ‘শান্তি আলোচনা’ করতে চান। বৈঠকটি সৌদি আরবের রিয়াদে হতে পারে। এই দুই নেতার বৈঠক থেকে কিছু ফল আসতে পারে। আবার এটি ২০১৮ সালের হেলসিঙ্কি সম্মেলনের মতো সম্পূর্ণ ব্যর্থও হতে পারে। 

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ট্রাম্পের এই বিস্ফোরক ঘোষণা ইউরোপে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উসকে দিয়েছে। সেটি হলো ক্রমে অনির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠা একজন মিত্রকে (অর্থাৎ ট্রাম্পকে) নিয়ে ইউরোপ কী করবে? একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইউরোপীয়দের অগ্রাহ্য করে এত বড় ভূরাজনৈতিক সমঝোতার কথা ভাবতে পারেন—এটাই অনেকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে।

আরেকটি আতঙ্কের বিষয় হলো, যদি আমেরিকা ইউরোপকে পরিত্যাগ করে, তাহলে তাদের একা একাই আক্রমণাত্মক রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে হবে। এই সংকটের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ইউরোপে দুটি ভিন্নমত গড়ে উঠেছে। 

এক দল বলছে, এ অবস্থা সামাল দেওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো আমেরিকার আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া, যাতে তারা ইউরোপকে ছেড়ে না যায়। এর মানে হলো ট্রাম্পের উল্টাপাল্টা কথাবার্তা গায়ে না মাখানো এবং প্রয়োজনে তাঁর অহংবোধকে সমঝে চলা ও কিছু দাবি মেনে নেওয়া। ট্রাম্পকে খুশি করতে ইউরোপের কিছু দেশ আমেরিকায় তৈরি গাড়ির শুল্ক কমানোর বা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি তরল গ্যাস কেনার কথা ভাবছে।

তারা মনে করছে, ইউরোপকে প্রতিরক্ষা খাতে, বিশেষ করে আমেরিকার তৈরি অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে আরও বেশি খরচ করতে হবে। ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের দেশগুলো এতে বেশি আগ্রহী। এরই মধ্যে পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র ও রোমানিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার জন্য তালিকায় নাম লিখিয়েছে।

ইউক্রেনও এই গ্রুপের সদস্য। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ট্রাম্পকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আগেই নিজের দিকে টানতে শুরু করেছিলেন। মনে হচ্ছে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করার তাঁর প্রস্তাব ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (মাগা) সমর্থকদের এবং খোদ ট্রাম্পের কাছে আকর্ষণীয় হয়েছে।

তবে জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং মার্কো রুবিও ও মাইক ওয়াল্টজের মতো পুরোনো ধাঁচের রিপাবলিকান কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাবেন, যাতে ইউক্রেনের জন্য মার্কিন অবস্থানকে প্রভাবিত করা যায়। ক্রেমলিন এবং মাগা দলের লোকেরা মনে করেন, ইউক্রেনীয়দের নিজেদের ব্যাপারে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুরোদ নেই। 

এ কারণে ইউরোপে আরেকটি মত রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমানোর পক্ষে। এই মতামতের অন্যতম সমর্থক ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। সম্প্রতি তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইউরোপকে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে (যেমন প্রতিরক্ষা এবং প্রযুক্তি) স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। প্যারিসে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এআই সম্মেলন এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধের প্রস্তুতির মধ্যে ইউরোপের এই দিকটি এগিয়ে চলেছে। 

মাখোঁ প্রথম ইউরোপীয় নেতা হিসেবে ইউক্রেনে ইউরোপীয় সেনা পাঠানোর ধারণাটি সামনে এনেছেন। যদিও তিনি বিশ্বাস করেন না, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য মিলে দুই লাখ সেনা পাঠানোর সক্ষমতা রাখে। তবে তাঁর দৃষ্টিতে বিকল্পটি এখনো আলোচনার টেবিলে রয়েছে। মাখোঁ ট্রাম্পের উদ্যোগকে ইউরোপীয়দের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন, যাতে তারা নিজেদের শক্তিশালী করে তুলতে পারে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এর মাধ্যমে ইউক্রেন ইউরোপের জন্য বৈশ্বিক গুরুত্ব অর্জনের অনুঘটক
হয়ে উঠতে পারে।

মাখোঁ ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কিছু ঝুঁকিও নিয়ে আসে। তিনি ফ্রান্সের নেতৃত্বে ইউরোপকে আরও শক্তিশালী এবং নিরাপত্তা দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ফ্রান্সের ভেতরেই তাঁর জনপ্রিয়তা কমছে এবং ভবিষ্যতে তাঁর জায়গায় পরবর্তী নেতা কে হবেন, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জার্মানির আগামী নির্বাচনের (২৩ ফেব্রুয়ারি) পর সম্ভবত মধ্য-ডানপন্থী খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) দেশ শাসন করবে। তারা ইউরোপের নিরাপত্তা ও আক্রমণাত্মক নীতি নিয়ে মাখোঁর সঙ্গে সহমত না–ও হতে পারে। 

ইউরোপীয় দেশগুলোর সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অনেক নির্ভরশীল এবং তাদের সামরিক খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করার ক্ষমতাও কম। তাদের বাজেটও সীমিত। এটি তাদের সামরিক সক্ষমতার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে জার্মানির জন্য তাদের ‘ডেট ব্রেক’ নীতি অর্থনৈতিক খরচ সীমিত করার চেষ্টা করছে। এটি সামরিক খাতে অতিরিক্ত ব্যয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। ইউরোপের আরেক সমস্যা হচ্ছে উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে পিছিয়ে থাকা। এটি তাদের চীনা এবং আমেরিকার তুলনায় দুর্বল করে তুলছে। 

ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ইউরোপকে জানান দিচ্ছে, ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। ফলে ইউরোপকে নিজের স্বার্থেই বদলাতে হবে, যাতে তারা নিজেদের মতো করে নীতি গ্রহণ করতে পারে এবং সব প্রতিকূল অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়াই সামাল দিতে পারে। 

দিমিতার বেচেভ কার্নেগি ইউরোপের সিনিয়র ফেলো 

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউর প য় ইউর প র ইউক র ন র জন য আম র ক

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা বিভিন্ন দলের

ইরানে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন দল। অবিলম্বে এই হামলা ও গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে এ বিষয়ে দুনিয়ার শান্তিকামী দেশ ও বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে তারা। গতকাল রোববার পৃথক বিবৃতিতে এসব দলের নেতারা এই দাবি জানান। তারা ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঘোষণা এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-ইহুদিবাদী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ ও ইরানের জনগণের পাশে দাঁড়াতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহমুদুল হাসান মানিক ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুর আহমদ বকুল এক বিবৃতিতে বলেন, বর্তমান সময়ের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলকে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংকট সৃষ্টি করে রেখেছে। একতরফা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ইরানের রাজনৈতিক সামরিক অগ্রযাত্রাকে রুখতে চেষ্টা করছে। যুদ্ধবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলকে এখনই থামতে হবে। অন্যায়ভাবে ইরানের শিশু-নারী ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর বোমা ও মিসাইল হামলা বন্ধ করতে হবে। 

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক পৃথক বিবৃতিতে বলেন, ইরানের পরমাণু স্থাপনাসহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অঞ্চল লক্ষ্য করে ইসরায়েলের বেপরোয়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা রাষ্ট্রীয় ভয়ানক সন্ত্রাসী তৎপরতা। পরিকল্পিত এই হামলা আন্তর্জাতিক সব ধরনের বিধিবিধানকে  বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল। জাতিসংঘকেও এরা পুরোপুরি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করেছে।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ