ছোটবেলার প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা যখন সমাজ বই পড়তাম, সেখানে লেখা ছিল: মানুষের মৌলিক অধিকার ৫টি; যথাক্রমে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা।

কিন্তু বড় হয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়তে গেলাম, তখন দেখলাম, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এগুলোর কোনোটাই আসলে মৌলিক অধিকার নয়।

আরেকটু গুছিয়ে বলতে গেলে বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ ১৫ বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলো নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব দিয়েছে, তবে এটি আইনের মাধ্যমে আদালতে দাবি করা যাবে না।

অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ১৭ শিক্ষাকে বিনা মূল্যে ও বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনা দেয়, তবে এটিও আদালতে সরাসরি বলবৎযোগ্য নয়।

আরও পড়ুনপথশিশুর মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার বলে কিছু আছে কি?০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে রচিত প্রথম সংবিধান থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত হওয়া বিভিন্ন সাংবিধানিক সংশোধনীতে এগুলোকে কেন মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি থাকতে পারে।

তবে আমি এখানে মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া না–দেওয়ার কারণে আসলে কী হয়, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চাই।

সংবিধান অনুযায়ী খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করা মাত্রই সব নাগরিকের জন্য এসব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা দুটোই রাষ্ট্রের কাঁধে কঠোরভাবে বর্তায়।

যেহেতু মৌলিক অধিকার আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য ও আইনের মাধ্যমে দাবি করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র শুধু এগুলো নিশ্চিত করতে সচেষ্টই থাকে না; বরং আইনি, নির্বাহী ও বিচারিক কাঠামোর মাধ্যমে সব নাগরিকের জন্য সুনিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী এগুলো আর মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয়, কাজেই রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার তার মতো করে এসব মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করে।

তবে এ ক্ষেত্রে নাগরিকরা কতটা সুবিধা পান, তা আপনি নিজেই অনুধাবন করতে পারেন।

আরও পড়ুনখাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নীতির বিসর্জন যে কারণে ‘আত্মহত্যা’২০ মে ২০২২

তবে কেউ পাল্টা যুক্তি দিতে পারেন, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই এগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা উচিত, অনেক দেশের এগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া না হলেও খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো বিষয়গুলোকে আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে।

এখন বলতে পারেন, বাংলাদেশেও তো অনেক বিষয়ে আইন আছে। কিন্তু মুশকিলটা হলো, সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত না হলেও যখন আইনের মাধ্যমে এগুলোর সুরক্ষা প্রদান করা হয় এবং দেশে আইনের শাসন বিদ্যমান থাকে, তখন এসব অধিকার কিছুটা হলেও কার্যকর থাকে।

কিন্তু ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের আইনের শাসনের ২০২৪ সালের সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১৪২ দেশের মধ্যে ১২৭তম অবস্থানে রয়েছে। আপনি যদি গত ১০ বছরের আইনের সূচকের বাংলাদেশের অবস্থানকে পর্যালোচনা করেন, তাহলে দেখবেন বাংলাদেশ দুর্ভাগ্যজনকভাবেই শেষের দিকে (খারাপ অবস্থায়) রয়েছে।

কাজেই যেহেতু বাংলাদেশের আইনের শাসনের অবস্থাটা নড়বড়ে, কাজেই এখন এসব অধিকারকে সাংবিধানিকভাবেই মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া শ্রেয়।

কেননা, এতে যে সরকারই আসুক না কেন, তাদের সব নাগরিকের জন্য এসব অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে।

এতে কমবে বৈষম্য, বাড়বে সামাজিক সমতা ও ন্যায্যতা, নিশ্চিত হবে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা এবং সুশাসন।

আরও পড়ুনবৃত্তাকার কৃষি উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম হতে পারে একটি সমাধান১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আধুনিক যুগে অন্যতম জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য কনসেপ্ট হলো ওয়েলফেরার স্টেট বা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। ওয়েলফেয়ার স্টেট এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে সরকার জনগণের মৌলিক জীবনমান নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সেবা ও সুবিধা প্রদান করে।

এই রাষ্ট্রে সরকারের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাতে প্রত্যেক নাগরিকের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকে।

ওয়েলফেয়ার স্টেট হিসেবে পরিচিত দেশগুলো যেমন ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেনের মতো দেশ এসব অধিকার কয়েকটিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তেমনিভাবে বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশও এসব অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা ও তানজানিয়ার মতো দেশ এই অধিকারগুলোর বেশির ভাগকেই মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

কেউ কেউ এটা বলে দ্বিমত করতে পারেন যে বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে এগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে সেটির ভার বহন করা সম্ভব হবে কি না?

কেননা, অনেক পণ্ডিতজনই এ কথা বলে যুক্তি দেন, রাষ্ট্র খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো বিষয়গুলোকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করলে তা পূরণের মতো ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই এবং এসব অধিকার ক্ষুণ্ন হলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে।

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করা মাত্রই এটি বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিকে পজিটিভভাবে বদলে দেবে। মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় এসব অধিকার নিশ্চিত করতে সব রাজনৈতিক দল কিংবা সরকার সর্বদা তৎপর থাকবে। এগুলো মৌলিক অধিকার হলে জনগণও তার অধিকারের বিষয়ে সচেষ্ট ও সচেতন থাকবে। যেহেতু রাষ্ট্রকে এসব অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, তাই এগুলো যাতে সবার কাছে পৌঁছায়, সে জন্য কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।

এতে করে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার সমস্যায় পড়তে পারে। কিন্তু এসব যুক্তির অন্যতম সহজ খণ্ডন হলো, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া সরকার দেশের সব মানুষের অধিকার সুরক্ষা করবে, সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েই দায়িত্ব নেয়।

মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা হলে, তা সরকারকে এসব বিষয়ে সজাগ থাকতে ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করবে। এতে করে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের নাগরিকরাই উপকৃত হবে।

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করা মাত্রই এটি বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিকে পজিটিভভাবে বদলে দেবে। মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় এসব অধিকার নিশ্চিত করতে সব রাজনৈতিক দল কিংবা সরকার সর্বদা তৎপর থাকবে।

এগুলো মৌলিক অধিকার হলে জনগণও তার অধিকারের বিষয়ে সচেষ্ট ও সচেতন থাকবে। যেহেতু রাষ্ট্রকে এসব অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, তাই এগুলো যাতে সবার কাছে পৌঁছায়, সে জন্য কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।

মোটকথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করা হলে এটি ন্যায্যতা, বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ বিনির্মাণে পথ দেখাবে।

মো.

ইমরান আহম্মেদ পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ ও পিএইচডি গবেষক, পলিটিকস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক, যুক্তরাজ্য। ই–মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক র যকর র জন ত র জন য ক র জন অন য য় সরক র অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

ফতুল্লায় প্রয়াসের ২২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

ফতুল্লার লামাপাড়ায় মাদকাসক্ত পূনর্বাসন ও সহায়তা কেন্দ্র প্রয়াসের ২২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রয়াসের ২২তম প্রতিষ্ঠাবাষির্কী উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা, কোর্স সমাপনী সনদ প্রদান, বিভিন্ন মেয়াদে সুস্থতার বর্ষপূর্তি ও খেলাধূলার আয়োজন করা হয়।

বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে প্রয়াসের জেনারেল ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে এ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হয়।

মাদকাসক্ত পূনর্বাসন ও সহায়তা কেন্দ্র প্রয়াসের জেনারেল ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলায় মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে প্রয়াস বিগত ২২ বছর যাবত নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেবা করে যাচ্ছে।

সব ধরনের আইন ও বিধি-বিধান মেনে সেবার মানোন্নয়ন প্রয়াসের বর্তমান লক্ষ্য। শুধু চিকিৎসা সেবা প্রদান নয়, বরং মানসম্পন্ন টেকসই সেবা নিশ্চিত করার জন্য চিকিৎসা পরবর্তী বিভিন্ন কার্যক্রম কেন্দ্রটি পরিচালনা করে থাকে।

জেনারেল ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রয়াসে চিকিৎসা কোর্স সম্পন্নকারীদের সার্টিফিকেট প্রদান, প্রাক্তন সদস্যদের মনিটরিং, বিভিন্ন মেয়াদে সুস্থ থাকার স্বীকৃতি ও জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারনায় অংশগ্রহণ প্রয়াসের টেকসই চিকিৎসা পরিকল্পনার অংশ।

তিনি আরো বলেন, আমরাই প্রথম নারায়ণগঞ্জে ৪০ বেডে লাইসেন্স প্রাপ্ত মাদকাসক্ত চিকিৎসা কেন্দ্র। প্রয়াসের প্রতিষ্ঠা ২০০৩ সালে হলেও আমরা লাইসেন্স পেয়েছি ২০০৬ সালে। গত ২০২১ সাল থেকে আমরা প্রতিবছর সরকারি অনুদানের জন্য নির্বাচিত হয়ে আসছি।

এসময় তিনি অভিভাবক প্রতিনিধি ও প্রাক্তন সদস্যদের প্রয়াসের সামগ্রিক কার্যক্রমে সংযুক্ত থাকার জন্য ধন্যবাদ জানান।

এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন, মাদকাসক্ত পূনর্বাসন ও সহায়তা কেন্দ্র প্রয়াসের কাউন্সিলর মোঃ সাইফুল ইসলাম, অফিসার এডমিন সাজ্জাদ হোসেন, প্রোগ্রাম অফিসার শেখ ফরিদ উদ্দিন ও মেডিকেল অফিসার ডা. রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। অন্যান্যদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন, শওকত হোসেন, লিটন, আমজাদ, বাবুসহ  রিকোভারীবৃন্দ।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ