তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো না কেন রায়হান?
প্রশ্নটা ধক্ করে লাগে রায়হানের। প্রশ্নের অন্তরালে কোনো হতাশা, অভিযোগ কিংবা ক্ষোভের স্পর্শ নেই। কিন্তু পেছনে যেন লুকিয়ে আছে অনেক কিছুই। সে ঠিক ধরতে পারে না– প্রমি কি মুক্তি চাইছে? নাকি অনিশ্চিত একটা সম্পর্ককে আশ্বস্ততার চাদরে মুড়ে দেওয়ার পথে রায়হানের একঘেয়ে অজুহাত সে মেনে নিতে পারছে না? ভেতরটা ফাঁপা লাগে তার, হাহাকার হয়ে বাজে। কেবল একটাই স্পষ্ট শব্দ বেরোয় তার কণ্ঠনালি ভেদ করে– ভালোবাসি!
এরপর নিকষ নিস্তব্ধতার ঝাঁপি নামে বসে থাকা পার্কের বেঞ্চিজুড়ে। কারও মুখেই কোনো শব্দ বেরোয় না। বেশ কিছুক্ষণ। চারপাশে স্বাভাবিক ছন্দে বাতাস বয়ে চলে। কংক্রিটের শহর থেকে খানিক দূরের গোছানো রিসোর্টের এক চিলতে এই পার্কে হুটহাট দু’একটা পাখির ডাক শোনা যায়। মাঝে মাঝেই ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় ঘুরতে আসা যুগল। ওদের স্বতঃস্ফূর্ত হেঁটে চলা, যুবকের বাহুর নিচে আগলে ধরা যুবতীর শাড়ি সামলে সাবলীল ঘুরে বেড়ানো বেশ আগ্রহ নিয়েই বেহায়ার মতো তাকিয়ে দেখে রায়হান। ভালো লাগে তার। কী নির্ভরতা! কী স্বাভাবিক ছন্দ! ওদের নিশ্চয়ই অনিশ্চয়তার রেশ নেই কোনো। কিংবা কে জানে, হয়তো আছে!
বেশ কিছুদিন ধরেই কেমন জানি একটা অদৃশ্য অস্বস্তির ছায়া ওদের সম্পর্কের মাঝে উঁকি দিচ্ছিল। ঠিক অস্বস্তিও না, আবার সাবলীলও না। যেটাকে ডিফাইন করাও দুরূহ। এমন না যে ওরা একে অপরকে ভুল বুঝছে, আবার এমনও না যে সব ঠিকঠাক চলছে। ঠিক কী কারণে এই দূরত্ব, সেটা বোঝাও মুশকিল। সেটা কাটাতে কিনা কে জানে, শহরতলিতে কোথাও নিরিবিলি সময় কাটানোর চিন্তা থেকে এই রিসোর্টে আসে ওরা।
সুন্দর গোছানো চারপাশ। কৃত্রিম লেক ঘিরে রেখেছে রিসোর্টকে। চারদিকে সারি সারি নারকেল আর সুপারি গাছ, মাঝে প্রশস্ত লনে ছড়ানো রঙিন ক্যানভাস চেয়ার, যেখানে বসে বিকেলের নরম রোদ গায়ে মাখা যায়।
রিসোর্টের মূল ভবনটি কাঠ ও লাল ইটের সংমিশ্রণে তৈরি, যেন গ্রাম্য ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেল। একতলায় খোলা বারান্দা, যেখানে দুলতে থাকা কুণ্ডলী বাঁধানো দোলনাগুলো অতিথিদের আমন্ত্রণ জানায় যেন। ভেতরে ঢুকলেই কাঠের আসবাব, দেয়ালে পুরোনো দিনের জল রঙের ছবি– একটা নস্টালজিক আবহ তৈরি করে। রিসোর্টের অভ্যর্থনা কর্মী জানাচ্ছিল– চারপাশে ঘিরে আছে যে লেকটা, সেটায় সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে ভেসে বেড়ায় কাঠের নৌকাগুলো। লেকের ধারে কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে গেলে রিসোর্টের কটেজগুলোর দেখা মেলে– প্রতিটিই আলাদা আলাদা নকশার, কিন্তু সবগুলোতেই খোলামেলা বারান্দা, যেখানে বসে রাতের ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাবে নিশ্চিত।
কেন ভালোবাসো?
হু?
কেন বাসো?
নিকষ নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রমিই জানতে চায় ফের। প্রশ্নটা যেন দূর পাহাড়ের গম্ভীর ডাক হয়ে রায়হানের ভেতর প্রতিধ্বনি তোলে। চোখে চোখ রেখে তাকায় সে। সেখানে প্রশ্নের চেয়েও বেশি কিছু লুকিয়ে আছে। হয়তো আকুতি কিংবা বিরক্তি। রায়হান ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু এটা বুঝতে পারে, উত্তরটা এড়িয়ে গেলে সে পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। তাও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সে। গলার কাছে আটকে থাকা কথাগুলো বেরোতে চায়, কিন্তু পারে না।
ক’দিন আগেই প্রমি বলছিল– রায়হান, তোমাকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে ভেবেছিলাম এভাবে একসময় আমি নিঃস্ব হয়ে যাব। হাজারো বিষয়ে আমারও দায়বদ্ধতা আছে; ফলে আমার প্রায়োরিটি দেওয়াটা খুব সস্তা না, রায়হান। আই হ্যাভ টু পে ফর ইট ইন এভরি সিঙ্গেল মোমেন্ট। আমারও চারপাশের হাজারটা সামাজিক প্রশ্ন ঠেলে টিকে থাকতে হয়। তোমাকে প্রায়োরিটি দিই, কারণ– ভালোবাসি। তোমার জন্য সীমাহীন মায়া আমার। আমার প্রতিটি অস্তিত্বে জড়িয়ে আছো তুমি। অথচ তোমার প্রায়োরিটি লিস্টে আমি তলানিতে, কিছু একটা চাইলেই যেন মহাকাশ ভেঙে আসে তোমার, মায়ার ছোঁয়া আমি পাই না। নিজেকে খুব তুচ্ছ লাগে জানো? কিন্তু আমার সেই ভাবনাটা ভুল, আমি প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে শূন্য হয়ে যাইনি, বরং আরও বেটার কিছু করার ইচ্ছে জাগে আমার।
তোমার কি মনে আছে রায়হান? সেদিনের কথা? ব্রিজের ওপর শত মানুষের ভিড়ে তুমি আমাকে প্রথম চুমু খেয়েছিলে? মনে আছে সেদিন সারাটা রাস্তা হাতটা ধরে বসেছিলে? কী তীব্রতা ছিল তোমার চাওয়ায়! অথচ দেখো, ইদানীং আমি হাত ধরে থাকলেও তুমি ফোনে নোটিফিকেশন চেক করো। ধরে থাকা হাতের কোনো রেসপন্স থাকে না। কোনো উষ্ণতা থাকে না। ক্রমে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে না আমাদের পথচলাটা?
রায়হান ভাবনার ঝাঁপি সাজিয়ে বসলেও প্রমি উঠে দাঁড়ায়। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে হাতের নখ খোঁটে। যেন বোঝাতে চায়– ‘কেন এসব প্রশ্ন করা? এর চেয়ে ঢের ভালো চুপ করে থাকা’।
আমি কী করব, প্রমি? তোমার মতো করে তোমাকে হয়তো আমি কখনোই ভাবি নাই। স্বার্থপরের মতো তোমাকে আঁকড়ে ধরে শ্বাস নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছি, তোমার শ্বাস বন্ধ করে। আমার প্রকাশ হয়তো অতটা না, যতটা ভেতরে খুবলে খায়। তোমার মনের অগোচরে প্রশ্ন জাগতেই পারে আমি আদৌ ভালোবাসি কিনা, সেটাই স্বাভাবিক। আমার অনিশ্চিত অস্তিত্বে তুমি হয়তো ক্লান্ত। কিন্তু কীভাবে তোমাকে বোঝাই– ‘কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়’। কীভাবে বোঝাই ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে আসার অনুভূতি। রায়হানের গলাটা খানিক ধরে আসে।
কার লেখা লাইনটা? পরিচিত মনে হচ্ছে? প্রমি পরিবেশ স্বাভাবিক করতেই হয়তো প্রশ্ন করে। রবি বুড়ো? .
প্রমি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে পরিবেশ। রায়হানের হাত ধরে টেনে তোলে। এলোমেলো হাঁটতে থাকে ওরা লেকের পাশ ঘেঁষে। কিন্তু রায়হান বুঝতে পারে প্রমির ক্লান্তি। বুঝতে পারে নিজের অসহায়ত্ব। বুঝতে পারে সে তলিয়ে যাচ্ছে।
দেখো রায়হান, যা পেয়েছি, সেটাই-বা কম কীসে বলো? তুমি ঝুম গানটা শুনেছ না? কোক স্টুডিওর? ওখানে একটা লাইন আছে দেখবে– সাব নু সামাঝ কে কি কারনা আয়ে। যেখানে আমার নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে কেন অবগাহন? বাদ দাও, লেটস ফোকাস অন দ্য ডে। আবহাওয়াটা বেশ চমৎকার, না? প্রমির চোখেমুখে এখন আর প্রশ্ন নেই, আছে শুধু শূন্যতা। যেই শূন্যতা কাটিয়ে সে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে চাইছে। আর সেই শূন্যতাই রায়হানের ভেতরে একটা গহ্বর তৈরি করছে, যা ক্রমশ তাকে গ্রাস করে ফেলছে।
সন্ধ্যের আগেই ওরা ফিরে আসে রিসোর্টের অনাবিল সৌন্দর্য উপেক্ষা করে। ফিরতে ওদের হতোই। শহরতলি থেকে দূরে গিয়ে ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে’ চেয়েছিল ওরা, আরও বেশি বাইরে চলে যেতে নয়। কিন্তু বুঝতে পারে ক্রমে ওরা বাইরের পানেই চলেছে একাকী। অমন অস্বস্তি নিয়ে রিসোর্টে থাকতে চায়নি বলেই ফিরে এসেছে।
তারপর থেকে শীতল দূরত্বের মধ্যেও কথা হয়, হঠাৎ করেই– কখনও অপ্রয়োজনীয় কিছু নিয়ে, কখনও অভ্যাসবশত। সম্পর্কটা যেন একটা দোদুল্যমান দড়ির ওপর দাঁড়িয়ে, ভারসাম্য হারালেই তলিয়ে যাবে, অথচ দুজনেই এক অদৃশ্য টানে তা ধরে রাখার চেষ্টা করে।
অবশেষে, একদিন সত্যিই দড়িটা ছিঁড়ে যায়। তুমুল কোনো ঝগড়া নয়, কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্তও নয়– একটা ধীরলয়ের দূরত্ব, একটা বুঝতে পারা যে, ওরা একসঙ্গে থাকলে শুধুই ক্লান্তি বাড়বে। তবু শেষ মুহূর্তে রায়হান এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে যায়। একবার শুধু প্রমির চোখের দিকে তাকায়, কিছু বলার চেষ্টা করে। গলা শুকিয়ে আসে, কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে। তাও বলে– কেমনে প্রকাশি কব কত ভালোবাসি?
প্রমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর হালকা হাসে। সেই হাসিতে অভিমান নেই, অভিযোগও নেই– শুধু একরাশ বিষাদ লেগে থাকে। খুব আস্তে বলে– আমাদের গল্পটা কখনও সহজ ছিল না রায়হান, কখনও হবেও না। ইফ অল সাই উইশেস অয়্যার টু কাম ট্রু, হোয়াট উড বি লেফ্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড টু ডু? তুমি ভালো থেকো, রায়হান। অনেক রাত একা কেঁদেছে প্রমি, পুরোনো টেক্সট পড়েছে, অ্যালবামের ভেতর রাখা পুরোনো ছবি মুছে ফেলতে গিয়ে থেমে গেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে, সময়ের সঙ্গে সম্পর্কের সেই বিষাদমাখা ভারটাকে মেনে নিয়েছে সে।
রায়হান পারেনি। ওর জন্য সম্পর্কটা ফুরোয়নি কখনও। সে ফিরে যেতে চেয়েছে বার কয়েক। কিন্তু টেক্সট লিখে পাঠায়নি, দূর থেকে কেবল দেখেছে প্রমিকে। অনুভব করতে চেয়েছে। সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েও পারেনি রায়হান, আবার পেছনেও ফিরতে পারেনি।
তবু জীবন এগোয়। এগোতেই হতো। কখনও কি আবার কথা হবে ওদের? হয়তো হবে, হয়তো না। কেউ কাউকে পুরোপুরি হারায় না, আবার ফিরে পাওয়ার আশাটাও ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। সময়ের স্রোতে সম্পর্কের সংজ্ঞা বদলে যায়। অনুভূতিও। ছেড়ে আছি ভাবলেই বুকের ভিতরের হাহাকারটা জাগে না আর। হয়তো একদিন নতুন কারও পাশে বসবে আলাদাভাবে, হাসবে, হাতে হাত রাখবে, কিন্তু কোথাও একটা কণামাত্র অনুভূতি হয়তো থেকে যাবে পরস্পরের জন্য। আনডিফাইন্ড একটা কণা, একটা আক্ষেপ, অশ্রুবারিচয়। যেটা ঠিক ভালোবাসাও নয়। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’
এবারের বাবা দিবস আমার কাছে একটু অন্যরকম। চারপাশ যেন কিছুটা বেশি নিস্তব্ধ, হৃদয়ের ভেতর যেন একটু বেশি শূন্যতা। কারণ এবার প্রথমবারের মতো আমার আব্বাকে ছাড়াই কাটছে দিনটি। আব্বা চলে গেছেন গত জানুয়ারিতে। ফলে বাবা দিবস এখন আর কেবল উদযাপনের দিন নয়– এটি হয়ে উঠেছে স্মরণ, অনুধাবন ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উপলক্ষ। আব্বা না থেকেও আছেন, তবে এক ভিন্ন অনুভবে– আমার নীরব নিঃশব্দ অভিভাবক হয়ে।
আমাদের সমাজে কিংবা বলা যায় পারিবারিক সংস্কৃতির বাবারা সবসময় প্রকাশের ভাষায় ভালোবাসা বোঝান না। তাদের স্নেহ, দায়িত্ববোধ ও নিবেদন অনেক সময়েই নীরব থাকে, তবে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। আমার আব্বাও ছিলেন তেমনই একজন। আব্বা ছিলেন আমার দিকনির্দেশক, আমার রক্ষাকবচ, আমার জীবনপথের চুপচাপ ভরসা।
আব্বার অ্যাজমা ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতেন, আমাদের প্রতিও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আমি কিংবা আমার মেয়ে সামান্য অসুস্থ হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর যখন ৭৯ বছর বয়স, তখনও আমি ডাক্তারের কাছে একা যেতে গেলে বলতেন, ‘তুমি একা যাবে কেন? আমি যাচ্ছি।’ এই কথা বলার মানুষটাকে প্রতি পদে পদে আমার মনে পড়ে, যেন দূর থেকে দেখছেন সবই। আর আমিও তাঁর কনুই-আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছি জীবনের পথে।
আব্বা ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ধার্মিক মানুষ। শৈশব থেকে নামাজের গুরুত্ব তিনি আমার মধ্যে গভীরভাবে বপন করার চেষ্টা করে গেছেন। কখনও নরম সুরে, আবার কখনও খুব জোর গলায়। তখন মনে হতো তিনি চাপ দিচ্ছেন; কিন্তু এখন তাঁর অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতায় আমি সেই কণ্ঠস্বরের জন্য আকুল হই।
অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে কিংবা আত্মীয়ের বা বন্ধুর বাসায় গেলে বাবার ফোন আসত, ‘কোথায়? কখন ফিরবি?’ সেসব ফোন একসময় মনে হতো আব্বার বাড়াবাড়ি। এখন মনে হয়, একটাবার হলেও যদি ফোনে তাঁর নামটা দেখতাম! ছোট ছোট এসব প্রশ্ন– এই উদ্বেগই তো ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। এগুলোই ছিল বাবার নিজের মতো করে যত্ন নেওয়ার ভাষা। সেই ভাষাটাই আজ আর শোনা যায় না। আব্বা নেই, এখন জীবনযাপনে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।
আব্বা ছিলেন একজন ব্যাংকার। হয়তো চেয়েছিলেন আমি তাঁর পেশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। কিন্তু কোনোদিন চাপ দেননি। বরং নিজের ইচ্ছেমতো পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। আব্বাই আমাকে নিজের ওপর আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন। বিয়ে করেছি, বাবা হয়েছি, নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়েছি– তবুও বাবার সেই গাইডেন্স কখনও ফুরায়নি। আব্বা কখনও অর্থ বা অন্য কোনো সহায়তার কথা বলেননি; বরং সবসময় নিজে থেকেই পাশে থেকেছেন। মনে পড়ে, একবার মেয়ের অসুস্থতার সময় আমি অর্থকষ্টে ছিলাম, কিছু বলিনি তাঁকে। কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন, পাশে থেকেছেন।
এখন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে হয়, ‘বাবা হলে কী করতেন?’ তাঁর শিক্ষা, অভ্যাস, স্নেহ– সবকিছু এখন আমার আচরণে, আমার সিদ্ধান্তে, আমার ভালোবাসায় প্রতিফলিত হয়। তাঁকে ছুঁতে না পারলেও আমি প্রতিদিন তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি– স্মৃতিতে, নৈঃশব্দ্যে, নানা রকম ছোট ছোট মুহূর্তে।
এই বাবা দিবসে আব্বার কোনো ফোন আসবে না, থাকবে না কোনো উপহার বা আলিঙ্গনের মুহূর্ত; যা আছে সেটি হলো আব্বার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসা। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সন্তানদের শুধু দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চাননি কখনোই। তাঁর জীবনদর্শন আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি– এগুলোই নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হয়তো পুরোপুরি পারছি না; কিন্তু আমার মনে হয় এ চেষ্টাটাই আমার জীবনে শৃঙ্খলা এনেছে।
বাবাকে হারানোর শোক যেমন গভীর, তেমনি গভীর তাঁর রেখে যাওয়া ভালোবাসা। নিজের অনুভবকে চাপা না দিয়ে, বরং বাবাকে নিজের ভেতরে জায়গা দিন। বাবার কথা বলুন, তাঁর শেখানো পথে হাঁটুন। কারণ প্রিয় মানুষরা চলে যান বটে, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা থেকে যায় সবসময়।
লেখক: কমিউনিকেশনস প্রফেশনাল