কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব
Published: 6th, March 2025 GMT
শিক্ষা অমূল্য এক সম্পদ। এর সঠিক অর্জন ও প্রয়োগ মানবজাতিকে অন্যান্য সব প্রাণিকুল থেকে স্বতন্ত্র এক বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। শিক্ষা ব্যতিরেকে কোনো জাতিই প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগোতে পারে না। তাই প্রতিটি রাষ্ট্রের সব জনগণের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়া উচিত সার্বজনীন। শিক্ষার এতটা গুরুত্বের কারণেই কোনো রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। সুশিক্ষিত একটি জাতিই পারে সরকারকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে। কারণ, তাদের মধ্যে বিরাজ করে সত্যিকারের দেশপ্রেম। ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে রাষ্ট্রীয় বৃহত্তর স্বার্থই তাদের কাছে প্রাধান্য পায়। তারা মাথানত করে না সৃষ্টিকর্তা ব্যতিরেকে অন্য কোনো শক্তির কাছে। নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেক প্রয়োগে তারা তাদের সব কাজকর্ম সমাধা করে থাকে। কোনো অশুভ শক্তি কিংবা পঞ্চ রিপু প্রসূত। নিজস্ব কোনো হীন স্বার্থ তাদের বিচলিত করতে পারে না। তারা তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় অটল থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে।
মূলত সে কারণেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত এ মানুষগুলোকে কিছুটা হলেও সমীহ করে চলে। রাজনৈতিক আগ্রাসনের ক্ষেত্রে এ মানুষগুলোকে নিয়েই তাদের যত দুশ্চিন্তা। তারা সর্বদা স্বশিক্ষিত এই সম্প্রদায়কে বিবেচনা করে নিজেদের মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন মানেই কোনো জাতির মাঝে শক্ত একটি ভিত স্থাপন মাত্র যার ওপর গঠিত উন্নয়ন সমৃদ্ধ সব ধরনের বিনির্মাণ সংশ্লিষ্ট জাতিকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌত্বের নিশ্ছিদ্র একটি বেষ্টনীর ভিতরে থেকে এগিয়ে নিতে পারে। জাতির ভাগ্যাকাশে হতে পারে বর্ষণমুখর মেঘের আগমন যার অঝোর ধারায় স্নাত একটি জাতি অবগাহন করতে পারে অপার শান্তি ও সমৃদ্ধির এক সুধা সাগরে।
এ কারণেই মূল শিক্ষার বাইরে রেখে একটি জাতিকে যদি কোনোভাবে মেধাশূন্য করে দেওয়া যায় তবে ওই জাতি অচিরেই হারিয়ে ফেলে তার সৃজনশীলতা ও সঞ্জীবনী শক্তি। ক্ষয় হতে হতে সার্বিক বিবেচনায় দেশটি এক সময় হয়ে পড়ে সম্পূর্ণরূপে দেউলিয়া ও বিদেশনির্ভর। কখনও কখনও রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারকে উচ্চ বেতনে বিদেশি বিশেষজ্ঞগণকে আমদানি করতে হয়। উপযুক্ত মেধা, বুদ্ধি ও দূরদর্শিতার অভাবে দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যন্ত পরিচালিত হয় বিদেশি বন্ধুদের হীন স্বার্থসংশ্লিষ্ট পরামর্শে। ক্ষমতার অন্ধ মোহে বিবেকবর্জিত ও নতজানু সরকারও অবতীর্ণ হয় ঔপনিবেশিক শাসকের ভূমিকায়। এতে একদিকে রাষ্ট্র হারায় তার অর্জিত রাজস্ব, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সূচক। অন্যদিকে ফাঁস হয়ে যায় তার অভ্যন্তরীণ সব গোপনীয়তা। তখন রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার এই সুযোগটিকে ব্যাটে-বলে কাজে লাগায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। অনেকটাই সহজ হয়ে যায় তাদের পথ চলা। তারা সুনির্দিষ্ট করে নেয় তাদের মিশন ও ভিশন। দিনে দিনে শকুনের কালো থাবা আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলোতে এভাবেই বাড়তে থাকে তাদের প্রকাশ্য ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ। আর গায়ে লাগা এই মৌসুমি বাতাসকে যদি বেগবান করতে পারে সাময়িক সুবিধাভোগী দেশীয় কুশীলব তবে তো কথাই নাই। মেধাশূন্য ও দেশপ্রেম বর্জিত জনগণের সরকার এক সময় হয়ে পড়ে চরম অসহায় এবং অবতীর্ণ হয় তাদের মুখ্য ক্রীড়নকের ভূমিকায়। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের পথটি অনেকটাই প্রশস্ত হয়ে যায়। শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে স্বাধীন, সার্বভৌম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি রাষ্ট্রকে এভাবেই অন্তঃসারশূন্য বানিয়ে অতি সহজেই করে দেওয়া যায় চিরতরে পঙ্গু ও অকার্যকর।
তাই কোনো একটি দেশের শিক্ষা প্রণয়ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ নিয়োগের বেলায় জাতীয় নেতৃবৃন্দকে দেখাতে হয় অনেক বেশি বিচক্ষণতার পরিচয়। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয় এখানে সাম্রাজ্যবাদী কোনো বহিঃরাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে কোনো গোষ্ঠী আছে কিনা যারা উপযাচক হয়ে নিজেদের হীন স্বার্থ সিদ্ধির মাধ্যমে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে বিদেশি বন্ধুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিভৃতে অথবা কখনও কখনও প্রকাশ্যে বেহায়ার মতো কাজ করে যাচ্ছে। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের নামে প্রকৃত শিক্ষা ধ্বংস করে আরোপিত অশিক্ষা-কুশিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে কোনোভাবে একটি প্রজন্মকে যদি অথর্ব করে দেওয়া যায় তবে সংশ্লিষ্ট জাতি খুব সহজেই হারিয়ে ফেলে তার উজ্জীবনী শক্তি; যেভাবে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে স্রোত হারিয়ে কীর্তিনাশা পদ্মার মতো একটি নদীও ধাবিত হয় মরুপথে। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অচল করে দিয়ে আগ্রাসী আঞ্চলিক উদীয়মান পরাশক্তিগুলোর অভাবেই ফারাক্কা কিংবা ডুম্বুর বাঁধের মতো দেশীর মানবসম্পদ উন্নয়নের স্রোতকে করে দিচ্ছে শ্লথ। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে যুব সমাজের সুস্থ চিন্তা-চেতনার সলিল সমাধি ঘটাচ্ছে প্রলয়যজ্ঞের এক মহাসমুদ্রে যেভাবে শুকনা মৌসুমে মরা নদীগুলো বাঁধের পানির মাত্রাতিরিক্ত প্রবাহে হয় মহাপ্লাবিত। এর মূল কারণ উপযুক্ত শিক্ষায় মানবসম্পদের সঠিক উন্নয়ন না থাকায় তারা আদতে বুঝতে পারে না কোনটি সংস্কৃতি আর কোনটি অপসংস্কৃতি।
এভাবেই জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রলয়যজ্ঞ ঘটিয়ে স্বাধীনতার ছদ্মাবরণে পশ্চাৎপদ একটি জাতির জনগণকে খুব সহজেই পরাধীনতার শিকলে বন্দি রেখে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটিকে করা যায় অকার্যকর ও সার্বভৌমত্বহীন। তখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও পররাষ্ট্রনির্ভর সরকার হয়ে পড়ে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের দোসরদের নাচের পুতুল। আর এই পথ ধরেই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হয় হুমকির সম্মুখীন। তথাকথিত অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলমান উন্নয়নের ধারা এগোতে থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। উদীয়মান সার্বভৌমত্ব কিংবা উদিত স্বাধীনতার সূর্য ধাবিত হতে থাকে অস্তাচলের দিকে।
ড.
মো. এরশাদ হালিম: অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত
বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ।
সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।
আরো পড়ুন:
একা বাস করতে পারে যে পাখি
কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?
সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।
তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না।
এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস।
তিনি জানেন, প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।
সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন।
একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।
সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।
চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।
গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা/লিপি