জুলহাস মোল্লা। গত ৪ মার্চ মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার যমুনার চরে হাজারো মানুষের সামনে নিজের হাতে তৈরি উড়োজাহাজ আকাশে উড়িয়ে তাক লাগিয়ে দেন এই তরুণ। পেশায় ইলেক্ট্রিক মেস্ত্রি জুলহাস কেমন করে তার এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করলেন সেই গল্প শুনেছেন বিপ্লব চক্রবর্তী
নিজের বানানো উড়োজাহাজ নিয়ে আকাশে উড়লেন মানিকগঞ্জের স্বপ্নবাজ তরুণ জুলহাস মোল্লা। স্থানীয় জাফরগঞ্জ এলাকায় যমুনা নদীর চরে নিজের তৈরি উড়োজাহাজে উড়ে বেড়াচ্ছেন এই তরুণ। তা দেখতে নিচে ভিড় জমিয়েছেন জেলা প্রশাসকসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় হাজারো মানুষ। জাফরগঞ্জের এক গৃহবধূ রুখসানা বেগম। তাঁর কাছে অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সামনে থেকে কখনও উড়োজাহাজ দেখিনি। এলাকার ছেলে উড়োজাহাজ তৈরি করেছে তাই দেখতে এসেছি। এসে দেখলাম জুলহাসের উড়োজাহাজ আকাশে উড়ছে।’ জুলহাসের বাবা জলিল মোল্লা বলেন, ‘ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের নানান জিনিস কুড়িয়ে জমিয়ে রাখত। সুযোগ পেলে এসব নিয়ে খুটুর-খাটুর করত। বানাতো নানান জিনিস। পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসব করার কারণ জানতে চাইলে বলত, দেখবে, কোনো একদিন এমন একটা জিনিস বানাব, যা দেখে সবাই চমকে উঠবে। আজ ছেলে সবার সঙ্গে আমাকেও চমকে দিয়েছে। আমার ছেলের বানানো উড়োজাহাজ আজ সত্যিই আকাশে উড়েছে। আমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না!’
স্বপ্নের পেছনে আছে কষ্টের ইতিহাস
নিজের স্বপ্ন ওড়ানোর কথা জানতে চাইলে জুলহাস মোল্লা বলেন, ‘আমি কখনও উড়োজাহাজ বা বিমানে উঠিনি। এই উড়োজাহাজ তৈরি করে আকাশে উড়তে পেরে নিজের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলতে পারেন। আসলে আমি আমার স্বপ্নটাকেই যেন আকাশে উড়িয়েছি। এই স্বপ্নের পেছনে আছে অনেক কষ্টের ইতিহাস। কেবল তাই নয়; শুরুর দিকে পরিবার থেকে শুরু করে বাড়ির আশপাশের মানুষ আমার কাজ দেখে বলতেন, সে তো পাগল হয়ে গেছে! মানে আমাকে পাগল বলতেন অনেকেই। আজ সেই মানুষগুলোই আমাকে উৎসাহ দিচ্ছেন। পিঠ চাপড়ে বাহবা দিচ্ছেন। এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? আমি অনেক কষ্ট করেছি। খেয়ে না খেয়ে এই কাজ করেছি। তিন বছর গবেষণা এবং এক বছর সময় লেগেছে উড়োজাহাজটি তৈরি করতে। সব মিলিয়ে প্রায় আট লাখ টাকা খরচ হয়েছে এটি তৈরিতে। এই উড়োজাহাজটি তৈরির আগে আরেকটি উড়োজাহাজ তৈরি করেছি, সেটি ওড়ানো সম্ভব হয়নি। এছাড়া গবেষণা কাজের জন্য ১৫০টি ৫ ফুট সাইজের রিমোট কন্ট্রোল উড়োজাহাজও তৈরি করেছি। এতেও খরচ হয়েছে অনেক টাকা। তবে আমি খেয়ে না খেয়ে এসব টাকা জোগাড় করেছি। ধারদেনাও আছে। তাই বলে দমে যাইনি। এতো কিছুর পরও আমি বলতে পারি, আমার আগে কেউ বাংলাদেশে নিজ উদ্যোগে বিমান তৈরি করে আকাশে ওড়াতে পারেনি। অনেকেই চেষ্টা করেছিলেন, সফল হননি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না থাকলেও শুধু ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম দিয়েই আমি সফলতার মুখ দেখেছি।’
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
জুলহাস মোল্লার বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া গ্রামে। স্থানীয় জিয়নপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করেন এই তরুণ। এরপর কলেজে ভর্তি হলেও আর্থিক টানাপোড়েনে একাডেমিক পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। জুলহাসের ছোটবেলা কেটেছে দৌলতপুর উপজেলার যমুনার চরে বাঘুটিয়া গ্রামে। ওই গ্রামের আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা এই তরুণ ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি প্লাস্টিকের বোতল, কাগজ, সংসারের ফেলে দেওয়া নানান উপকরণ দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করতেন। জুলহাসের বাবা জলিল মোল্লা জড়িত কৃষিকাজের সঙ্গে। ৬ ছেলে আর এক মেয়ের সংসার জলিল মোল্লার। বড় ছেলে মেহের আলী সৌদিপ্রবাসী। মেজ ছেলে জেহের আলী জড়িত ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে। সেজ ছেলে মনোয়ার হোসেন ড্রাইভার। চতুর্থ ছেলে ছানোয়ার হোসেন ঢাকায় বুকবাইন্ডিং পেশায় জড়িত। ছোট ছেলে নয়ন মিয়া জুলহাসের সঙ্গে ইলেকট্রিক কাজ করেন। এক মাত্র মেয়ে জোছনাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই।
যেভাবে এলো উড়োজাহাজের ভাবনা
উড়োজাহাজের ভাবনা কেমন করে এলো মাথায়, এই প্রশ্নের উত্তরে জুলহাস বলেন, ‘চার বছর আগে হঠাৎ মাথায় আসে ছোট ছোট রিমোট কন্ট্রোল বিমান তৈরি করার। এর কিছুদিন পর আল্টালাইট উড়োজাহাজ তৈরির কথা মাথায় আসে। সেটি তৈরি করে তেমন সাফল্য পাইনি। পরে তিন বছর গবেষণা করে এবং এক বছরের প্রচেষ্টায় এই উড়োজাহাজ তৈরি করি। এর সঙ্গে আমার ছোটভাই নয়ন মিয়াও জড়িত। মূলত টাকার জোগান না থাকায় পাম্প ইঞ্জিন, অ্যালুমিনিয়াম, এসএস দিয়ে
উড়োজাহাজটি তৈরি করেছি। উড়োজাহাজটির ওজন প্রায় একশ কেজি। গতি পরিমাপের জন্য যুক্ত করেছি ডিজিটাল মিটার, অ্যালুমিনিয়াম ও উন্নত কাপড় দিয়ে পাখা তৈরি করেছি। এর সেভেন হর্স ইঞ্জিন চলে অকটেন অথবা পেট্রোল দিয়ে। ঘণ্টায় গতি সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটার। চাইলে এর সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। পরিবর্তন আনা যাবে গঠনেও।’
আগামীর স্বপ্ন
উড়োজাহাজই এখন জুলহাসের ধ্যানজ্ঞান! এই
উড়োজাহাজকে ঘিরে জুলহাসের কাছে তাঁর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে আমার উড়োজাহাজ কেন্দ্রিক একাডেমিক পড়াশোনা তেমন নেই। যদিও আমি এর পেছনে প্রচুর সময় ব্যয় করেছি এবং সাফল্যও পেয়েছি। তবে আমার আরও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আমার তৈরি উড়োজাহাজ একজন চালক বা পাইলট ওড়াতে পারে। যদি ৫ লাখ টাকার ইঞ্জিন লাগানো যায় তবে তা দিয়ে যাত্রী ওড়ানো সম্ভব। তবে দেশের আইন অনুযায়ী এ ধরনের উড়োজাহাজ তৈরি করা গেলেও ওড়ানোর বৈধতা নেই। সরকারি নীতিমালা মেনেই খোলা জায়গায় চর এলাকায় মাত্র ৫০ ফুট উচ্চতায় উড়োজাহাজটি উড্ডয়ন করেছি। অনুমোদন পেলে এই উড়োজাহাজটি ১ হাজার ফুট উচ্চতায় উড্ডয়ন করানো সম্ভব।
আগামীতে আশা করি এসব বাধা কেটে যাবে
এবং এই উড়োজাহাজকে ঘিরে স্বপ্ন দেখবে
নতুন বাংলাদেশ!’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’
এবারের বাবা দিবস আমার কাছে একটু অন্যরকম। চারপাশ যেন কিছুটা বেশি নিস্তব্ধ, হৃদয়ের ভেতর যেন একটু বেশি শূন্যতা। কারণ এবার প্রথমবারের মতো আমার আব্বাকে ছাড়াই কাটছে দিনটি। আব্বা চলে গেছেন গত জানুয়ারিতে। ফলে বাবা দিবস এখন আর কেবল উদযাপনের দিন নয়– এটি হয়ে উঠেছে স্মরণ, অনুধাবন ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উপলক্ষ। আব্বা না থেকেও আছেন, তবে এক ভিন্ন অনুভবে– আমার নীরব নিঃশব্দ অভিভাবক হয়ে।
আমাদের সমাজে কিংবা বলা যায় পারিবারিক সংস্কৃতির বাবারা সবসময় প্রকাশের ভাষায় ভালোবাসা বোঝান না। তাদের স্নেহ, দায়িত্ববোধ ও নিবেদন অনেক সময়েই নীরব থাকে, তবে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। আমার আব্বাও ছিলেন তেমনই একজন। আব্বা ছিলেন আমার দিকনির্দেশক, আমার রক্ষাকবচ, আমার জীবনপথের চুপচাপ ভরসা।
আব্বার অ্যাজমা ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতেন, আমাদের প্রতিও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আমি কিংবা আমার মেয়ে সামান্য অসুস্থ হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর যখন ৭৯ বছর বয়স, তখনও আমি ডাক্তারের কাছে একা যেতে গেলে বলতেন, ‘তুমি একা যাবে কেন? আমি যাচ্ছি।’ এই কথা বলার মানুষটাকে প্রতি পদে পদে আমার মনে পড়ে, যেন দূর থেকে দেখছেন সবই। আর আমিও তাঁর কনুই-আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছি জীবনের পথে।
আব্বা ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ধার্মিক মানুষ। শৈশব থেকে নামাজের গুরুত্ব তিনি আমার মধ্যে গভীরভাবে বপন করার চেষ্টা করে গেছেন। কখনও নরম সুরে, আবার কখনও খুব জোর গলায়। তখন মনে হতো তিনি চাপ দিচ্ছেন; কিন্তু এখন তাঁর অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতায় আমি সেই কণ্ঠস্বরের জন্য আকুল হই।
অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে কিংবা আত্মীয়ের বা বন্ধুর বাসায় গেলে বাবার ফোন আসত, ‘কোথায়? কখন ফিরবি?’ সেসব ফোন একসময় মনে হতো আব্বার বাড়াবাড়ি। এখন মনে হয়, একটাবার হলেও যদি ফোনে তাঁর নামটা দেখতাম! ছোট ছোট এসব প্রশ্ন– এই উদ্বেগই তো ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। এগুলোই ছিল বাবার নিজের মতো করে যত্ন নেওয়ার ভাষা। সেই ভাষাটাই আজ আর শোনা যায় না। আব্বা নেই, এখন জীবনযাপনে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।
আব্বা ছিলেন একজন ব্যাংকার। হয়তো চেয়েছিলেন আমি তাঁর পেশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। কিন্তু কোনোদিন চাপ দেননি। বরং নিজের ইচ্ছেমতো পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। আব্বাই আমাকে নিজের ওপর আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন। বিয়ে করেছি, বাবা হয়েছি, নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়েছি– তবুও বাবার সেই গাইডেন্স কখনও ফুরায়নি। আব্বা কখনও অর্থ বা অন্য কোনো সহায়তার কথা বলেননি; বরং সবসময় নিজে থেকেই পাশে থেকেছেন। মনে পড়ে, একবার মেয়ের অসুস্থতার সময় আমি অর্থকষ্টে ছিলাম, কিছু বলিনি তাঁকে। কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন, পাশে থেকেছেন।
এখন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে হয়, ‘বাবা হলে কী করতেন?’ তাঁর শিক্ষা, অভ্যাস, স্নেহ– সবকিছু এখন আমার আচরণে, আমার সিদ্ধান্তে, আমার ভালোবাসায় প্রতিফলিত হয়। তাঁকে ছুঁতে না পারলেও আমি প্রতিদিন তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি– স্মৃতিতে, নৈঃশব্দ্যে, নানা রকম ছোট ছোট মুহূর্তে।
এই বাবা দিবসে আব্বার কোনো ফোন আসবে না, থাকবে না কোনো উপহার বা আলিঙ্গনের মুহূর্ত; যা আছে সেটি হলো আব্বার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসা। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সন্তানদের শুধু দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চাননি কখনোই। তাঁর জীবনদর্শন আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি– এগুলোই নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হয়তো পুরোপুরি পারছি না; কিন্তু আমার মনে হয় এ চেষ্টাটাই আমার জীবনে শৃঙ্খলা এনেছে।
বাবাকে হারানোর শোক যেমন গভীর, তেমনি গভীর তাঁর রেখে যাওয়া ভালোবাসা। নিজের অনুভবকে চাপা না দিয়ে, বরং বাবাকে নিজের ভেতরে জায়গা দিন। বাবার কথা বলুন, তাঁর শেখানো পথে হাঁটুন। কারণ প্রিয় মানুষরা চলে যান বটে, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা থেকে যায় সবসময়।
লেখক: কমিউনিকেশনস প্রফেশনাল