রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) পাম্পগুলো এখন অফিস থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পাম্পে এখন জনবলের তেমন প্রয়োজনই নেই। তারপরও পাম্পগুলোতে দুই থেকে তিনজন করে পাম্প অপারেটর রাখা হয়েছে। তাদের বেতন-ভাতা খাতে বিপুল টাকা ব্যয় হলেও লোকসান কমাতে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে পানির দাম।

রাজশাহী ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, শহরে তাদের পাম্প রয়েছে ১২৩টি। দুবছর আগেই ৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পাম্পগুলোতে রাশিয়া ও ভারত থেকে আনা সুইচ ডিভাইস লাগানো হয়। এখন পাম্পগুলো অফিস থেকেই চালু ও বন্ধ করা হয়। তারপরও পাম্পে পাম্পে রাখা হয়েছে দুই থেকে তিনজন অপারেটর। এদের বেশিরভাগই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া। তাদের পেছনে প্রতিবছর বিপুল টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে ওয়াসাকে।

কেউ থাকে না পাম্পে

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ওয়াসার এক অফিস আদেশে চলতি রমজান উপলক্ষে পাম্পের অপারেটরদের সময়সূচি দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, প্রথম শিফটে রাত ১১টায় অপারেটর পাম্পে যাবেন, রাত আড়াইটায় পাম্প চালু হবে, বন্ধ হবে ৫টা ১৫ মিনিটে এবং দায়িত্ব শেষ হবে সকাল ৭টায়। দ্বিতীয় শিফটে পাম্পে উপস্থিতি ভোর ৬টায়, পাম্প চালু সকাল ৭টায়, বন্ধ হবে দুপুর দেড়টায় এবং ডিউটি শেষ হবে দুপুর ২টায়। তৃতীয় শিফটে ডিউটি শুরু দুপুর ১২টায়, পাম্প চালু দেড়টায়, বন্ধ হবে সন্ধ্যা ৭টায়, ডিউটি শেষ হবে রাত ৮টায়। অর্থাৎ, রমজান মাসে সব পাম্পে তিনজন করে পাম্প অপারেটর রাখা হয়েছে।

রাজশাহী নগরের দড়িখড়বোনা এলাকায় রেলওয়ের গেটকিপারের ঘরেই ওয়াসার পাম্প চালু ও বন্ধ করা ডিভাইস বসানো আছে। রোববার সকাল ১০টায় সেখানে গিয়ে রেলওয়ের গেটকিপারকে পাওয়া যায়। তবে সেখানে ওয়াসার কোনো পাম্প অপারেটরকে পাওয়া যায়নি। রেলওয়ের ওই গেটকিপার বললেন, পাম্পের কেউই থাকে না। তারা মাঝে মাঝে আসেন।

নগরের বিসিক পাম্পে গিয়ে দেখা যায়, ঘরটি তালাবদ্ধ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শ্রমিক নেতা বাকী বিল্লাহ সাগর ও রুবেল এই পাম্পের অপারেটর। স্থানীয়রা জানান, তারা পাম্পেই আসেন না। সব সময় ঘরটি তালাবদ্ধই থাকে। ওয়াসার প্রধান কার্যালয়ের পাশেই উপশহর হাউজিং এস্টেট পাম্পে গিয়েও তালাবদ্ধ পাওয়া গেল ঘর। ফোন করা হলে পরে পাম্প অপারেটর মো.

সুমন আসেন। তিনি বলেন, তিনি পাশেই একটা অফিসে বসে ছিলেন।

অটোমেশনের ফলে অফিস থেকেই চালু ও বন্ধ করা হয় পাম্প। তাহলে অপারেটরের কী দরকার, এ প্রশ্নে মো. সুমন তাদের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরলেন। জানালেন, বিদ্যুতের ভোল্ট সাড়ে তিনের কম ও সাড়ে চারের বেশি হলে মোটর পুড়ে যায়। ডিভাইস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই তাদের সার্বক্ষণিক ভোল্টের দিকে নজর রাখতে হয়। ভোল্ট কম কিংবা বেশি দেখলে পাম্প বন্ধ করে দিতে হয়। এ জন্য তাদের পাম্পে থাকা খুব জরুরি বলে তিনি জানালেন।

ব্যয় মেটাতে বাড়ছে পানির দাম

ওয়াসার বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ কোটি ৫২ লাখ টাকার পরিচালন ব্যয় করে ১৭ কোটি ৭২ লাখ টাকার পানি বিক্রি করে ওয়াসা। অর্থাৎ লোকসান হয় প্রায় ৬ কোটি টাকা। প্রতিবছরই এমন লোকসান হয়ে থাকে। এই লোকসান কমাতে দফায় দফায় বাড়ানো হয় পানির দাম।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াসা পানির দাম তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়। এতে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট বা এক হাজার লিটার পানির দাম ২ টাকা ২৭ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৮১ পয়সা এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ৫৪ পয়সা থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সায় গিয়ে দাঁড়ায়।

গত বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ওয়াসার ১৬তম বোর্ড সভায় আবারও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। সম্প্রতি এ প্রস্তাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে অনুমোদনের জন্য। অনুমোদন পেলে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট পানির দাম বেড়ে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট ১৭ টাকা ৭০ পয়সা হবে।

ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, এখন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে অস্থায়ী কর্মচারী আছেন ১৯৩ জন। এদের মধ্যে অল্প কিছু কর্মচারী আছেন প্রধান কার্যালয়ে, বাকি সবাই পাম্প অপারেটর। দক্ষ কর্মচারীরা ৬০০ ও অদক্ষ কর্মচারীরা ৫০০ টাকা মজুরি পান। তাদের পেছনে বছরে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়। তাদের তেমন কাজ না থাকলেও এই টাকা ব্যয় করছে ওয়াসা। আর গত বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকা লোকসানের জন্য পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন ভুল পদক্ষেপে রাজশাহী ওয়াসার ব্যয় বাড়তেই আছে। তাদের বিপুলসংখ্যক জনবল কাজে না লাগলেও আমাদের বিলের টাকাতেই বেতন-ভাতা দিচ্ছে। এই বোঝা টানতে গিয়ে ওয়াসা দফায় দফায় পানির দাম বাড়াচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত থেকে না সরে এলে ঈদের পর কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’

রাজশাহী ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মামুদ বলেন, ‘এখনও পরীক্ষামূলক সময় চলছে। অটোমেশনের পাশাপাশি আমরা পাম্প অপারেটরদেরও রেখেছি যেন কখনও ডিভাইস কাজ না করলে ম্যানুয়ালি পাম্প চালানো যায়। তবে আগামী বছরই জনবল কমাতে শুরু করব। একটা সময় হয়তো পাম্পে কোনো অপারেটরই থাকবে না। এই সময়টা দিতে হবে।’

পাম্পে অপারেটরদের না থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখনও পাম্প ঘরে অপারেটরদের থাকা জরুরি। মুশকিল হলো, জায়গার অভাবে আমরা ঘরে তাদের থাকার ভাল ব্যবস্থা করতে পারিনি। ফলে অনেকেই বাড়ি চলে যান। তারপরও তারা যেন থাকে সেই নির্দেশনা আমাদের আছে। যারা এই নির্দেশনা অমান্য করে তাদের কাছে ব্যাখা চেয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ঢাকা/টিপু

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর অফ স থ ক ই ইউন ট

এছাড়াও পড়ুন:

ব্যয় বাড়ল ১৪৪ কোটি টাকা

‘খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ’ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয় ২০১১ সালে। ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। এর পর আটবার প্রকল্পের সময় বেড়েছে, দুই দফা সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। এ অবস্থায় প্রকল্পটি শেষ হওয়া নিয়ে হতাশা দেখা দেয়। 
আশার কথা, নতুন জেলা কারাগারের কাজ শেষ হয়েছে। গত ২৫ মে গণপূর্ত বিভাগের কাছ থেকে নতুন কারাগারটি বুঝে নেওয়ার কথা ছিল কারা কর্তৃপক্ষের। কিছু কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় হস্তান্তর হয়নি। চলতি জুন মাসে যে কোনো সময় নতুন কারাগার হস্তান্তরের কথা রয়েছে। জনবল পদায়ন হলেই নতুন কারাগারে বন্দি স্থানান্তর শুরু হবে।
১৯১২ সালে নগরীর ভৈরব নদীতীরে নির্মাণ করা হয় খুলনার প্রথম কারাগার। সেখানে বন্দি ধারণক্ষমতা ৬৭৮ জনের। রয়েছেন ১ হাজার ৪শর বেশি বন্দি। ১১৩ বছরের পুরোনো জরাজীর্ণ ভবনে ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয় তাদের। এসব বিবেচনায় নিয়েই নতুন কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
খুলনার সিটি (রূপসা সেতু) বাইপাস সড়কের জয় বাংলা মোড়ের অদূরে প্রায় ৩০ একর জমির ওপর নতুন কারাগার নির্মাণ হচ্ছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নতুন কারাগারে ৪ হাজার বন্দি থাকতে পারবেন। প্রকল্পের আওতায় আপাতত ২ হাজার বন্দি রাখার অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। পরে প্রয়োজন পড়লে পৃথক প্রকল্প নিয়ে অন্য অবকাঠামো নির্মাণ হবে।
নতুন কারাগার হবে সংশোধনাগার
কারাগার ঘুরে দেখা গেছে, ভেতরে সাজানো-গোছানো অভিজাত আবাসিক এলাকার মতো পরিবেশ। রং দেওয়া নতুন ভবন, পথের ধারে 
ফুল, দামি পার্কিং টাইলস দেওয়া ফুটপাত ধরে হাঁটলে এটি কারাগারই মনে হয় না। নতুন এ কারাগার নির্মাণ হচ্ছে সংশোধনাগার হিসেবে। এখানে বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের পৃথক স্থানে রাখা হবে। কিশোর ও কিশোরী বন্দিদের জন্য রয়েছে পৃথক ব্যারাক। নারীদের জন্য পৃথক হাসপাতাল, মোটিভেশন সেন্টার ও ওয়ার্কশেড আছে। একইভাবে বন্দিদের জন্য ৫০ শয্যার হাসপাতাল থাকবে। 
আরও থাকবে কারারক্ষীদের সন্তানদের জন্য স্কুল, বিশাল লাইব্রেরি, ডাইনিং রুম, আধুনিক স্যালুন ও লন্ড্রি। কারাগারে শিশুসন্তানসহ নারী বন্দিদের জন্য থাকবে পৃথক ওয়ার্ড ও ডে-কেয়ার সেন্টার। এ ওয়ার্ডটিতে সাধারণ নারী বন্দি থাকতে পারবেন না। সেখানে শিশুদের জন্য লেখাপড়া, খেলাধুলা, বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা থাকবে। কারাগারে পুরুষ ও নারী বন্দিদের হস্তশিল্পের কাজের জন্য আলাদা আলাদা ওয়ার্কশেড, বিনোদন কেন্দ্র ও নামাজের ঘর রয়েছে। মোট ৫২টি স্থাপনা রয়েছে এ কারাগারে। 
গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রাশিদুল ইসলাম জানান, বন্দিদের প্রতিটি ব্যারাকের চারপাশে পৃথক সীমানাপ্রাচীর রয়েছে। এক শ্রেণির বন্দিদের অন্য শ্রেণির বন্দিদের সঙ্গে মেশার 
সুযোগ নেই। কারাগারের ভেতরে শুধু সীমানাপ্রাচীরই রয়েছে প্রায় ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের। ভেতরে ড্রেন, ফুটপাত, নিজস্ব পয়োবর্জ্য শোধন কেন্দ্র, ওয়াকওয়ে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা, দুটি পুকুর ও সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সবকিছুর কাজ শেষ।
সময় বেড়েছে আটবার, ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ
২০১১ সালের অনুমোদিত খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১৪৪ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ৬ জুন প্রকল্পটি প্রথম দফা সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫১ কোটি টাকা। নতুন লক্ষ্য নেওয়া হয় ২০১৯ সালের ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার। এর পর পাঁচ দফায় পাঁচ বছর সময় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কাজ আর শেষ হয়নি। ২০২৩ সালের মে মাসে দ্বিতীয় দফায় প্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৮ কোটি টাকায়।
হস্তান্তর ও চালু কবে
খুলনা গণপূর্ত বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নতুন কারাগারের সব কাজ শেষ। কয়েকটি স্থাপনায় রঙের শেষ প্রলেপসহ টুকটাক কাজ বাকি রয়েছে। আগে করলে এসব নষ্ট হয়ে যাবে। এ কারণে হস্তান্তর তারিখ নির্ধারণ হলেই এসব কাজ করা হবে। 
খুলনার জেল সুপার নাসির উদ্দিন প্রধান বলেন, কিছু কাজ বাকি ছিল, সেগুলো শেষ করতে বলা হয়েছে। সব ঠিক থাকলে চলতি জুন মাসেই আমরা কারাগার বুঝে নেব। তিনি আরও বলেন, কারাগার পরিচালনার জন্য ৬০০ জনবলের চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে পুরোনো কারাগারে প্রায় ২০০ জনবল রয়েছে। স্থাপনা বুঝে নেওয়ার পর কারাগার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ব্যয় বাড়ল ১৪৪ কোটি টাকা