ভারতের জগন্নাথদেবের মন্দিরে কেন ঢুকতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ-ইন্দিরা গান্ধী
Published: 30th, March 2025 GMT
ছবির মতোই সুন্দর মফস্সল শহর সুন্দরপুরে প্রকৃতির অকৃপণ শোভা ছাড়া দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল এক ফুড জয়েন্ট, ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি’। সেদিকে তাকালে কয়েকটা কথা মনে হতে পারে। এক, ওই ভোজনালয়ের নাম রবীন্দ্রনাথ কখনো শোনেননি। তাই তাঁর খেতে যাওয়া হয়নি। দুই, নাম শুনলেও খাওয়ার আগ্রহ হয়নি। হয়তো তাগিদই অনুভব করেননি। তিন, পুরোটাই কল্পনা। আজগুবি। সত্যিটা জনপ্রিয় সাহিত্যিক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনই জানেন।
কিন্তু অনেকেই জানেন না, ইচ্ছা, আগ্রহ ও তাগিদ থাকার পরও এমন এক স্থান রয়েছে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ যেতে পারেননি। অন্যভাবে বলতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য সেই দরজা নিষিদ্ধ ছিল।
এই হেঁয়ালির মধ্যেই যদি জানতে চাওয়া হয়, রবীন্দ্রনাথের মতো ভাগ্যহীন আর কারা? কিংবা একটু অন্যভাবে যদি জানতে চাওয়া হয় মহাত্মা গান্ধী, বি আর আম্বেদকর, স্বামী প্রভুপাদ, লর্ড কার্জন, গুরু নানক দেব অথবা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিল কোথায়? বাজি ধরে বলা যেতে পারে, ফেলু মিত্তিরের সবজান্তা সিধু জ্যাঠার মতো ক্ষণজন্মা দু-একজন হয়তো রহস্যের অবগুণ্ঠন সরিয়ে উত্তরটা দিতে পারবেন। ভারতের পুরীর জগন্নাথমন্দির।
পূর্ব ভারতের ওডিশা রাজ্যের সমুদ্রতীরবর্তী পুরীতে জগন্নাথদেবের এই মন্দির সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এক পুণ্যতীর্থ। হিন্দুদের মূল চার ধাম উত্তর ভারতে বদ্রিনাথ, পশ্চিম ভারতে দ্বারকা, দক্ষিণ ভারতে রামেশ্বরম ও পূর্ব ভারতে পুরী। পুরীতেই রয়েছে ভগবান বিষ্ণু বা তাঁর অবতার শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ রূপ জগন্নাথ। মন্দিরের গর্ভগৃহে গিয়ে যাঁকে দর্শন করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, আম্বেদকর, ইন্দিরা গান্ধীরা।
কেন? কিসের সেই বাধা? উত্তর খুবই সংক্ষিপ্ত। আবহমান কালের প্রথা—হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মের কারও অধিকার নেই পুরীর মন্দিরে প্রবেশের। শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক দেব তাই ব্যর্থ হয়েছিলেন ১৫০৮ সালে। ব্যর্থ হয়েছিলেন ১৮৮৯ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ভাইসরয় লর্ড কার্জন। কিংবা এই একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দা আইনজীবী এলিজাবেথ জিগলার, যিনি পুরীর মন্দিরে ১ কোটি ৭৮ লাখ রুপি অনুদান দিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত অনুদানের ক্ষেত্রে এলিজাবেথ জিগলারকে আজও কেউ ছাপিয়ে যেতে পারেননি।
তা সত্ত্বেও, ওই যে কথায় বলে না, ‘রুল ইজ রুল’, রবীন্দ্রনাথ টু ইন্দিরা গান্ধী—সবার ক্ষেত্রে সেই নিয়মই গেরো হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরীর জগন্নাথ ধামের দরজা আজও অহিন্দুদের জন্য উন্মুক্ত নয়।
ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে ওডিশার সম্পর্ক বহুকালের। প্রিন্স দ্বারকানাথের জমিদারি ছিল সেখানেও। জমিদারি দেখাশোনা করতে রবীন্দ্রনাথকে বারবার যেতে হয়েছে পুরী। কিন্তু মন্দিরের দরজা তাঁর জন্য বন্ধই থেকেছে তাঁরা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী বলে। ব্রাহ্মরা নিরাকারের উপাসক। জগন্নাথদেব সাকার। মোটকথা রবীন্দ্রনাথ ‘অহিন্দু’। এই পরিচয়ের পাশাপাশি উঠে এসেছিল ঠাকুর পরিবারের ‘পিরালি’ ব্রাহ্মণত্বের পরিচিতিও, যে বংশের পূর্বজরা ধর্মান্তরিত হয়ে বিবাহসূত্রে বাঁধা পড়েছিলেন মুসলিমের সঙ্গে।
একই রকম ভাগ্যাহত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। মন্দিরে প্রবেশের ক্ষেত্রে ইন্দিরাকে বাধা দেওয়া হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। তখন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী! কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ জওহরলাল নেহরুর মেয়ে বিয়ে করেছিলেন পার্সি ফিরোজ গান্ধীকে। হিন্দুশাস্ত্র মতে, বিয়ের পর স্ত্রীর গোত্র, বর্ণ, ধর্ম বদলে যায়। মন্দিরের পুরোহিতদের দাবি ছিল, ইন্দিরারও তা–ই হয়েছে। বিয়ের পর আর হিন্দু নন। বাধ্য হয়ে ইন্দিরা জগন্নাথদেবের উদ্দেশে পূজা দিয়েছিলেন অনতিদূরে রঘুনন্দন গ্রন্থাগার থেকে।
অবশ্য শুধু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাই নন, হিন্দু সমাজে যাঁরা ‘অস্পৃশ্য’, জাতপাতের ছোঁয়াছুঁয়ি যাঁদের নিয়ে এখনো প্রবল, সেই দলিত সমাজেরও জগন্নাথমন্দিরে প্রবেশের অধিকার আছে কি না, তা বহু বিতর্কিত। না হলে দলিতদের অধিকার নিয়ে সরব মহাত্মা গান্ধীকে বাধা দেওয়া হতো না। কিংবা ভারতের সংবিধানপ্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকরকে।
গান্ধীজি ১৯৩৪ সালে পুরী গিয়েছিলেন জগন্নাথদেবের দর্শনে। তবে একা নন, সঙ্গে ছিলেন আচার্য বিনোভা ভাবেও। জাতপাতের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ দলিত, খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের নিয়ে গান্ধীজি যাত্রা শুরু করেছিলেন মন্দির অভিমুখে, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। পুরোহিত সমাজ শুধু গান্ধীজিকে মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন। অন্যদের নয়। প্রতিবাদে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে মন্দিরের ফটক থেকে মিছিল বের করেছিলেন গান্ধীজি।
দলিত পরিবারে জন্ম নেওয়া বাবাসাহেব আম্বেদকরকেও ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে। সেদিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন।
শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক দেব শিষ্য মারদানাকে নিয়ে পুরী গিয়েছিলেন ১৫০৮ সালে। কিন্তু বাদ সেধেছিল ওই নিয়ম। ভগ্ন মনোরথ গুরু নানক পুরীতেই অবস্থান করেছিলেন আরও কিছুদিন। সেই সময়ই ঘটে যায় এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। পুরীর রাজাকে স্বপ্নে দেখা দেন স্বয়ং জগন্নাথদেব। তাঁর নির্দেশ, গুরু নানককে যেন মন্দির প্রবেশে বাধা দেওয়া না হয়। স্বপ্নাদিষ্ট রাজার হুকুম সেই থেকে পালিত হচ্ছে। গুরু নানক দেব মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন। শিখ ধর্মাবলম্বীরাও।
ইসকন আন্দোলনের পুরোধা স্বামী প্রভুপাদের হালও হয়েছিল গান্ধীজির মতো। ১৯৭৭ সালে বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে তিনি মন্দির দর্শনে এসেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। তাঁকে ছাড় দেওয়া হলেও বিদেশি অতিথিদের জন্য দরজা বন্ধ থাকবে জানিয়ে দেওয়া হয়। সহযাত্রীদের ছেড়ে প্রভুপাদ মন্দিরে প্রবেশ করেননি।
ইদানীং অবশ্য অহিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশের দাবি জোরাল হয়ে উঠছে। সুপ্রিম কোর্টও সম্প্রতি রীতি বদলের পরামর্শ দিয়েছেন মন্দির কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু সেবায়েতদের এখনো রাজি করানো যায়নি।
দুই বছর আগে উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল গণেশি লাল বলেন, ‘একজন বিদেশি যদি গজপতির (পুরীর মহারাজা) সঙ্গে দেখা করতে পারেন, সেবায়েতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন, জগৎগুরু শংকরাচার্যর সঙ্গে মিলতে পারেন, তা হলে জগন্নাথদেব দর্শন কেন করতে পারবেন না? জানি না, সবাই এই দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে গ্রহণ করবেন। এই মত আমার একান্তই নিজস্ব। আপনারা একটু ভেবে দেখবেন।’
রীতি অবশ্য এখনো ভাঙেনি। জগন্নাথদেব, তাঁর বড় ভাই বলভদ্র ও বোন সুভদ্রা হিন্দু-অহিন্দু সবার জন্য সর্বসমক্ষে দৃশ্যমান হন বছরে একবার। রথযাত্রার সময়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর ছ ল ন র মন দ র প রব শ র মন দ র র জগন ন থ হয় ছ ল র জন য প র নন ইন দ র
এছাড়াও পড়ুন:
২৩৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী তালিকা, আপনার আসনে কে
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। কোন আসনে বিএনপির মনোনয়ন কে পেয়েছেন, তার তালিকা প্রকাশ করেছে দলটি। জাতীয় সংসদের আসন ৩০০টি। এর মধ্যে কিছু আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি আর কিছু আসন জোট শরিকদের জন্য রেখে দিয়েছে বিএনপি।
সোমবার (৩ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আরো পড়ুন:
ঢাকায় বিএনপির মনোনয়ন পেলেন যারা
ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচন করবেন মির্জা আব্বাস
দেখে নিন আপনার আসনে বিএনপির প্রার্থী কে
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ