তাসমিত আফিয়াত আর্নি। ২২ মার্চ উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্লগ আনোকি মিডিয়া প্রভাবশালী চার মার্কিন-দক্ষিণ এশীয় ফ্যাশন ডিজাইনারের নাম প্রকাশ করে। তাতে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে উঠে আসে তরুণ এই ফ্যাশন ডিজাইনারের নাম। গত ২৫ মার্চ এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে নতুন জার্সি পরে ভারতের বিপক্ষে লড়ে বাংলাদেশ ফুটবল দল। এর নকশাকারও আর্নি। যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ‘মিস ইউনিভার্স’-এ রিকশা, বর্ণমালা, মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশ, জামদানিসহ দেশীয় নানা উপাদানে পোশাকের নকশা করে প্রশংসায় ভাসা এই তরুণ এসেছেন সমকালে। শুনিয়েছেন তাঁর স্বপ্নের কথা। লিখেছেন আশিক মুস্তাফা
২২ মার্চ উত্তর আমেরিকার একটি ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল প্ল্যাটফর্ম আনোকি মিডিয়া আমেরিকান-সাউথ এশিয়ান প্রভাবশালী ফ্যাশন ডিজাইনারদের একটি তালিকা প্রকাশ করে। তাদের লক্ষ্য ছিল, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিভাবান নারী ডিজাইনার, যারা বিশ্ব ফ্যাশনে প্রভাব ফেলছেন, তাদের খুঁজে বের করা এবং তাদের সংগ্রামের গল্প তুলে ধরা। সেই তালিকায় স্থান পেয়েছেন আর্নি। অন্যদের মধ্যে দু’জন ভারতের ও একজন শ্রীলঙ্কার। ২০২৪ সালে তরুণ এই ডিজাইনার অংশ নিয়েছিলেন সাংঘাই ফ্যাশন উইকে। এবার আমন্ত্রণ পেয়েছেন মায়ামি ফ্যাশন উইকে। আনোকি মিডিয়ার প্রভাবশালী ডিজাইনার হওয়া ছাড়াও তাঁর সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হয়েছে আরেকটি বিশেষ পালক। তিনি এবার বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি ডিজাইন করেছেন। এই জার্সি পরে গত ২৫ মার্চ বাংলাদেশ দল ভারতের শিলংয়ে এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে অংশ নেয়।
নতুন জার্সি ও বাফুফের অফিশিয়াল ডিজাইনার
বাংলাদেশ ফুটবল দলের অফিশিয়াল নতুন জার্সিতে মুগ্ধ দেশ। এই জার্সির নকশা করেছেন তাসমিত আফিয়াত আর্নি; তাতে উজ্জ্বল লালে জলের গল্প ছড়ানো। জার্সি সম্পর্কে জানতে চাইলে আর্নি বলেন, ‘লাল আর সবুজে বেশ কয়েকটি দেশের জার্সি ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। এর কারণ, কয়েকটি দেশের পতাকাতে বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়েছে এই দুই রং। বিশাল মাঠে যখন খেলা হয়, তখন দূর থেকে সবার পক্ষে পার্থক্য করা সম্ভব হয় না। খেলা উপভোগ তখন খানিকটা কঠিন হয়ে পড়ে। এ বিষয় মাথায় রেখেছি পরিকল্পনার সময়ে। পতাকার লাল সূর্য থেকেই প্রাণিত লাল রং। আবার একই সঙ্গে আমাদের মানচিত্রে চোখ রাখলে নদীতে চোখ আটকে যায় মুহূর্তেই। নদীমাতৃক দেশের পরিচয় পাওয়া যায় এখানেই। বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে সেই অনুযায়ী মোটিফেই আমি তুলে এনেছি জার্সির ক্যানভাসে। আর দুই হাতায় আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা থেকে মোটিফ খুঁজে এনেছি। শাপলার কলি আর পাপড়ি থেকে খুঁজে নিয়েছি ডায়মন্ড শেইপ নকশা। জ্যামিতিক মোটিফের প্রতি ছেলেদের জোর আগ্রহ আছে বলে আমার মনে হয়েছে। সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ এটি এ দেশের ছেলেদের ফুটবল দলের জন্যে তৈরি।’
এই জার্সির হাত ধরে আর্নি এখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বা বাফুফের অফিশিয়াল ডিজাইনার। তিনি বাংলাদেশের নারী ও পুরুষের জাতীয় দলের জন্য জার্সি ডিজাইন করছেন।
যেসব উপাদানে ভর করে এগিয়ে চলা
জামদানি, নকশিকাঁথা, গামছা, খাদি, রাজশাহী সিল্কের মতো স্থানীয় উপাদান দিয়ে আর্নি তৈরি করেন তাঁর টেকসই ফ্যাশনের সংগ্রহ, যেখানে রিকশা পেইন্ট, মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো মোটিফও থাকে। কয়েক বছর আগে ‘স্ট্রাইড ফ্যাশন ওয়ার’ নামে একটি ফ্যাশন হাউস প্রতিষ্ঠা করেছেন আর্নি। সেই সূত্রে অনেকক’টি বিয়ের পোশাকের অর্ডার তিনি পান। বেশির ভাগ গ্রাহক ভারত কিংবা পাকিস্তানি পোশাকের আদলে নকশাকে গুরুত্ব দিত বলে জানালেন আর্নি। অনেকটা বাধ্য হয়ে সেই ডিজাইনে পোশাক বানিয়ে দিতেন। মনে মনে ভাবতেন, দেশীয় উপাদান দিয়ে আধুনিক এবং আকর্ষণীয় অনেক পোশাকের নকশা করা যায়, কিন্তু এই ঝুঁকিটা কেউ নিতে চাচ্ছিল না। শেষমেশ নিজে প্রচলিত সেই ধারণায় ধাক্কা দেবেন বলে ঠিক করলেন। ২০২২ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। বর আমেরিকান। সেখানে নিজের বিয়ে, গায়ে হলুদ আর সংবর্ধনার সব পোশাকের নকশা নিজেই করেছেন রিকশা, জামদানির মতো দেশীয় মোটিফে। বাহবাও পেয়েছিলেন। পরে অনেকে দেশীয় মোটিফে বিয়ের পোশাকের নকশা করিয়েছেন তাঁকে দিয়ে। আর্নি বললেন, ‘সুন্দর ডিজাইন করে পোশাক বিক্রি করা অনেক সহজ, কিন্তু তরুণ-তরুণীরা পোশাক পরতে গিয়ে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়, সেগুলোর সমাধান করে পোশাকের নকশা করা একটু কঠিন। সে কাজটি করি আমি। স্ট্রাইড মূলত লাক্সারিয়াস সাসটেইনেবল ফ্যাশনে মনোযোগী।’
মায়ামি ফ্যাশন উইকের রানওয়েতে…
দেশের উদীয়মান এই ফ্যাশন ডিজাইনারের পোশাক রানওয়ে মাতাতে যাচ্ছে মায়ামি ফ্যাশন উইকে। মায়ামি ফ্যাশন উইক সম্পর্কে জানতে চাইলে আর্নি বলেন, ‘মূলত এই ফ্যাশন উইকের দুটি কিউতে থাকছে আমার কালকেশন। এসব পোশাক পরে রানওয়েতে হাঁটবেন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মডেলরা। দুই দেশ থেকে দুটি দল যাবে মায়ামিতে। একটি কিউতে থাকবে সমাজের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে নকশা করা পোশাক। দ্বিতীয় কিউতে থাকছে জামদানি দিয়ে তৈরি ওয়েডিং কালেকশন। আমাদের দেশে ধর্ষণের শিকার কেবল নারী একা হন না। অন্য লিঙ্গের মানুষেরাও ভুক্তভোগী। আমার সংগ্রহে এ বিষয়টি তুলে ধরা হবে পোশাকে সচেতনতামূলক বার্তার মাধ্যমে।
ডিজাইনে প্রতিবাদের ভাষা
গত জানুয়ারির আর্কা ফ্যাশন উইকেও দেখা গেছে আর্নির দুই থিমের সংগ্রহ। সেখানে নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের পাশাপাশি জায়গা করে নেয় জুলাই বিপ্লবের স্লোগান ও হ্যাশট্যাগ প্রাণিত পোশাক। আর্কা ফ্যাশন উইকে থিম ছিল ‘সোসাইটাল সাইলেন্সিং’। আর্নি বলেন, ‘কেবল মায়ামি ফ্যাশন উইকেই নয়; পোশাককে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তুলে ধরেছি। এই কাজ আমি একা করি যে তা কিন্তু না; বিশ্বের অনেক আলোচিত ডিজাইনার এর ব্যবহার করেছেন। আমিও আছি সেই মিছিলে। আসলে আমি সব সময় চেয়েছি, আমার ডিজাইন হয়ে উঠবে প্রতিবাদের ভাষা। সমাজের যেসব নেতিবাচক বিষয় নিয়ে সচরাচর মানুষ কথা বলে না কিংবা বলতে ভয় পায়, আমি সেসব বিষয়কেই আমার নকশায় তুলে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার পোশাকে উঠে এসেছে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।’
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তরুণ এই ডিজাইনার বলেন, ‘রিকশা পেইন্ট, জামদানি, মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশ–এগুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও ব্যাপকভাবে কাজ করতে চাই। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় অনুষ্ঠিত মিস ইউনিভার্সের আসরে শিরিন শিলা দেখা দিয়েছিলেন আমার নকশা করা শাড়ি, রিকশার হুড আর বর্ণমালার গহনায়। ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনালসহ অনেক দেশেই প্রশংসিত হয় আমার নকশা করা লাল জামদানিতে তৈরি গাউনশাড়ি, তালপাতা থেকে অনুপ্রাণিত সোনালি মুকুট, মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা উপকরণের আঙ্গিকে তৈরি বেল্ট আর গহনা। ছিল সবুজ পাখা আর সবুজ রেশমি চুড়ি। মাস কয়েক আগে বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন উইক-সাংহাই-এ অংশ নিয়েছি। সেখানে ৯০টি দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নারী ডিজাইনার ছিলাম আমি। সাংহাইয়ে উপস্থাপিত আমার সংগ্রহের একটি বড় অংশের উপজীব্য ছিল জুলাই আন্দোলন। পরে অংশ নিয়েছি কাতার ফ্যাশন উইকে। আসলে আমি সবসময় বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। এখনও করছি এবং আগামীতেও করে যেতে চাই। এটিই আমার স্বপ্ন।’ আমরাও তার সেই স্বপ্নের প্রত্যাশায়!
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প শ ক র নকশ ফ টবল দল কর ছ ন জ মদ ন উপ দ ন আম র ক
এছাড়াও পড়ুন:
পিডিবির ভুলে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হলো বাংলাদেশকে
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) খামখেয়ালিজনিত এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশকে দুই কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।
খামখেয়ালিটি হলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২০০০ সালে হওয়া ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে (বিরোধ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা) একটি মামলায় পক্ষভুক্ত না হওয়া। পক্ষভুক্ত হতে গেলে বাংলাদেশকে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হতো। তা করেনি পিডিবি। ফলে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে একতরফা রায় হয়েছে। দুই যুগ পর এখন বাংলাদেশকে জরিমানা দিতে হয়েছে ৩৩৩ গুণ বেশি অর্থ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত ১৯ মে পিডিবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ হিসেবে পিডিবিকে দেওয়া হবে, যা তারা দেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডকে। হরিপুরে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্পনসর (পৃষ্ঠপোষক) ছিল এই স্মিথ কো-জেনারেশন।
আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানঅবশ্য পিডিবি অর্থ বিভাগের ঋণ নেয়নি। সংস্থাটি নিজের তহবিল থেকে গত ২৩ মে ২৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কোম্পানিটি।
এই পাওনা টাকাকে কেন্দ্র করেই ২০২৪ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। জটিলতা এড়াতে তাঁরা দুজন পরে হোটেল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় (বাংলাদেশ হাউস) গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।’
ঘটনা শুরু যেভাবেমূল ঘটনা ১৯৯৭ সালের অক্টোবরের। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার হরিপুরে বেসরকারি খাতে ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কো-জেনারেশন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে দুটি চুক্তি করে বাংলাদেশ। কোম্পানিটির সঙ্গে পিডিবির একটি চুক্তি হয় ১৯৯৭ সালের ১৪ অক্টোবর। দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর সরকারের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি হয় বিদ্যুৎ কেনার (পিপিএ)।
চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ১৯৯৮ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু কোম্পানিটি তা পারেনি। শর্ত ছিল নির্ধারিত দিন থেকে উৎপাদন করতে না পারলে দুই মাস মেয়াদ বাড়াবে সরকার, তবে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলার করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কোম্পানিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তো দূরের কথা, কোনো নির্মাণকাজ করতে পারেনি; বরং আরও ৬ মাস ২০ দিন সময় চায়। সরকার তা না মেনে ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পিপিএ ও জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করে দেয়। শুধু তা–ই নয়, ব্যাংক নিশ্চয়তার (পিজি) ১৫ লাখ ডলারও নিয়ে নেয় পিডিবি।
সচিবালয়ে গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক থেকে মার্কিন কোম্পানিটিকে ২ কোটি ডলার দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। বিদ্যুৎসচিব ফারজানা মমতাজ এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কথা আসেনি। যদিও সম্প্রতি আলাদা এক চিঠিতে অর্থ বিভাগ এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।
বিদ্যুৎসচিবের সঙ্গে গত ১৫ মে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করে জানতে চাওয়া হয় যে যাঁদের কারণে বাংলাদেশকে এখন ২৪৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে, তাঁদের তিনি বাঁচিয়ে দিলেন কেন। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।
ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদবিষয়টি যেভাবে আদালতে গড়ালঅর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে পাঠানো বিদ্যুৎসচিবের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটি ২০০০ সালে ঢাকার সাব জজ পঞ্চম আদালতে আরবিট্রেশন মিসকেইস (বিবিধ মামলা) এবং নারায়ণগঞ্জের সাব জজ প্রথম আদালতে আরেকটি আরবিট্রেশন বিবিধ মামলা করে। উভয় মামলাই আদালত খারিজ করে দেন। আদালতে মামলার পাশাপাশি কোম্পানিটি পরে পিপিএ বাতিল ও পিজি নগদায়নের বিরুদ্ধে আইসিসি আরবিট্রেশনে যেতে পিডিবিকে নোটিশ দেয়। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়ে জানায়, আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি হতে পারেন আরবিট্রেটর।
কিন্তু আইসিসি বিদেশে আরবিট্রেশন মামলায় অংশগ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনাল খরচ বাবদ নির্ধারণ করে ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা উভয় পক্ষকে সমানভাবে বহন করতে হবে। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার দিতে হবে অগ্রিম। অর্ধেক হিসেবে তখন পিডিবির খরচ করতে হতো অগ্রিমের ৬০ হাজার ডলার।
তখনকার পিডিবির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ট্রাইব্যুনাল খরচের কোনো অর্থ দেবে না। পিডিবির তৎকালীন আইনজীবী প্যানেল একই পরামর্শ দেয়। আইনজীবীরা আরও মত দেন, দেশে আরবিট্রেশন আইন হয়েছে ২০০১ সালে। এর আগে আইসিসির আরবিট্রেশনের রায় বাংলাদেশের বাইরে কার্যকর হবে না। তাঁরা মামলায় পক্ষভুক্ত না হতে পিডিবিকে পরামর্শ দেন।
পরে একপক্ষীয় শুনানি শেষে আইসিসি আরবিট্রেশন আদালত ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর রায় দেন। রায়ে বলা হয়, পিডিবি বছরে ৪ শতাংশ সুদসহ মোট ১ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে।
রায় বাস্তবায়নের ছয় মামলাআইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়নে স্মিথ কো-জেনারেশন পরে ছয়টি মামলা করে। এগুলো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব অব কলাম্বিয়া, ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্ক, সুপ্রিম কোর্ট অব নিউইয়র্ক, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের কোর্ট অব সেশন, সুইজারল্যান্ডের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব বাডেন এবং ঢাকার আদালতে।
আইসিসির রায় বাস্তবায়নে ২০০৭ সালের ২০ জুলাই রায় দেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব কলাম্বিয়া। স্মিথ কো-জেনারেশন এ আদালতে বিষয়টি আবার উত্থাপন করে। এরপর ২০২৪ সালের ১৯ মে পিডিবির বিরুদ্ধে সংশোধিত চূড়ান্ত রায় দেন আদালত। এবারের রায়ে বলা হয়, পিডিবি ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার পরিশোধ করবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে। কোম্পানিটি তখন তার আইনি প্রতিষ্ঠান ডোয়ান মরিস এলএলপিকে বিষয়টি জানায়। কিন্তু রায় আর বাস্তবায়ন হচ্ছিল না।
বিষয়টি নিয়ে জানতে গত ২৮ মে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনিও কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর যে বিপদে পড়েছিলেনআন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন যায় উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন একটি দল, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও ছিলেন। ২১-২৬ অক্টোবর (২০২৪) ছিল এ বার্ষিক সভা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপদেষ্টা ও গভর্নরের ওয়াশিংটন যাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে স্মিথ কো-জেনারেশন আরেকটি মামলা করে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায়। আদালত তখন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের জবানবন্দি নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু যেহেতু অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা আছে এবং তাঁরা পিডিবির সঙ্গে সম্পর্কিত নন, তাই তাঁরা জবানবন্দি দেননি।
স্মিথ কো-জেনারেশন তখন আবার আদালতে (যুক্তরাষ্ট্র) যায়। আদালত ২৫ অক্টোবর (২০২৪) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আহসান এইচ মনসুরকে আটক করে আদালতে নিয়ে আসতে ইউএস মার্শাল সার্ভিসকে নির্দেশ দেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা দুজন তখন আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সরকারি বাসভবনে। তাঁরা ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসির ১০ নম্বর সড়কে অবস্থিত অ্যাম্বাসি স্টু হোটেলে। দূতাবাসের গাড়িতে করে তাঁরা ম্যারিল্যান্ডে রাষ্ট্রদূতের বাসায় চলে যান।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগ এলএলপিকে নিয়োগ দেয়। তারা আপিল করলে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্থগিত করেন এবং শুনানির দিন ধার্য করেন ২৮ অক্টোবর (২০২৪)। ফলি হোয়াগ এলএলপি বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতার আবেদন জানায় বিচারকের কাছে এবং বিচারক তা গ্রহণ করেন। এভাবেই অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর ওই যাত্রায় রক্ষা পান।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ৩০ জুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়।’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।নিষ্পত্তির পথ খুলল যেভাবেমধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়কে ভিত্তি ধরে দেশে তখন গুরুত্বের সঙ্গে কাজ শুরু করেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর এ বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এরপর স্মিথ কো-জেনারেশনের মধ্যস্থতাকারী, বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান অনলাইনে ৫টি বৈঠক করেন। শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, জব্দ করা ব্যাংক নিশ্চয়তার ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হোক। বিপরীতে স্মিথ কো-জেনারেশন দাবি করে ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। আরও দাবি করে, মামলার খরচ বাবদ আরও ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার তাদের দিতে হবে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রস্তাবে কোম্পানিটিকে বলা হয়, ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান আইনের আওতায় বিদ্যুৎ খাতে তাদের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। এতেও রাজি হয়নি স্মিথ কো–জেনারেশন। বাংলাদেশ পরে ১ কোটি ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়। স্মিথ কো-জেনারেশন তখন নতুন প্রস্তাব দেয়। সেটি হলো, এককালীন ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। অথবা ২ কোটি ৪০ লাখ ডলার ও দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারা মেনে নেবে।
বিষয়টি নিয়ে মধ্যস্ততায় থাকা বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে গত ২৬ মে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অবশ্য অর্থ বিভাগ ও পিডিবি সূত্র জানায়, পরে স্মিথ কো-জেনারেশন ২ কোটি ডলারে রাজি হয়। বাংলাদেশ সরকারও সিদ্ধান্ত নেয়, এই পরিমাণ অর্থ ওই কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আগেই সম্মতি দিয়ে রেখেছিলেন (গত ১৮ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা। গত ২৮ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।
ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ‘দেশের বদনাম হলো’১৯৯৬-৯৯ সময়ে পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন নুরউদ্দিন মাহমুদ কামাল, তিনি ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর মারা যান। ১৯৯৯-০০ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক সচিব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক, যিনি মারা যান ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ২০০০-০২ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ মালেক, যিনি মারা যান ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে শাস্তি দিতে হবে। এমনকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবিরও শাস্তি পাওয়া উচিত। অর্থ বিভাগের পরামর্শ মেনে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করা।