নামাজ-রোজার মতোই পহেলা বৈশাখ-পাহাড়ি উৎসব আমাদের সংস্কৃতি।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা, বাংলাদেশ সরকার।
প্রতি বছর এপ্রিলে সংস্কৃতি আলোচনায় আমরা মেতে উঠি। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করেই আমাদের এ মেতে ওঠা।
কেন এই মেতে ওঠা?
মেতে ওঠার ইতিহাসটি নতুন তো নয়ই, উল্টো এই মেতে ওঠার সঙ্গে ১৯৭১-এর  মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরস্পরের হাত ধরে চলছে, কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা এখনও পূর্ণতা পায়নি বলে প্রতি বছর এই মেতে ওঠা। সাধারণ ধারণায় ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে লাখ লাখ পাকিস্তানি এ দেশে রয়ে গেছে। পরাজিত জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি ও তাদের তৎপরতা যে কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূমিতে একটি বাস্তবতা। মধ্যযুগে বা সামন্তকালে এমন পরাজিতদের সাধারণত হত্যা করা হতো অথবা ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো। এ বাস্তবতার মোকাবিলায় আদালত বা আইনি প্রক্রিয়ায় পরাজিতদের বিচার আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় চর্চা। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে ‘বিচার’ একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া হলেও, তৎকালীন বিজয়ী বা বাংলাদেশের নেতৃত্বদানকারীরা মানবতার সর্বশেষ চর্চাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তবে তারা ঝুঁকি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন এবং শীর্ষ নেতাসহ অসংখ্য জন নিহত হন। এ রাজনৈতিক বাস্তবতাই প্রতি বছর পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতে মাতিয়ে তোলে। কেন সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনা এপ্রিলে বা পহেলা বৈশাখে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ‘সাংস্কৃতিক’ কর্মীদের অবদান রাজনৈতিক কর্মীদের চেয়ে কম নয়। ভাষা আন্দোলন দিয়ে যার শুরু হলেও, কাগমারী সাহিত্য সম্মেলন কিংবা অনুরূপ আয়োজন শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে হয়েছে তা নয়, পাড়ায় পাড়ায় যে সংস্কৃতির চর্চা সেটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে। ছায়ানটের পহেলা বৈশাখ আয়োজন একটি স্বীকৃত মাইলফলক। এটিই পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনার অন্যতম কারণ।
সংস্কৃতি বিষয়টি আসলে কী?
বাউল গান যেমন আমাদের সংস্কৃতি, তেমনি হিন্দুর পূজা, সাওতালি নাচ, চাকমার পূজা, মুসলমানের নামাজ আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সব উপাদান ভূমি থেকে উৎসারিত হয় তা নয়। বাণিজ্য বিনিময়, আমদানি ও শাসনের মধ্য দিয়ে চাপিয়ে দেওয়াও বহু কিছু জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেয়। এ দেশের নারীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি, ইংরেজ শাসনের প্রভাবে ব্লাউস তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঐতিহ্য তথা সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। যে বাউল গান ছিল বৌদ্ধ পরবর্তী ব্রাহ্মণবাদের সমালোচক, সে বাউল গান হয়ে উঠেছে ইসলামের তত্ত্বালোচক। মনে রাখতে হবে এ দেশে ইসলাম যখন আসে, তখন কোনো মাদ্রাসা পাস মুফতি এ দেশে ছিলেন না। লোককবি, গায়কেরাই ইসলামের তত্ত্বালোচনা করেছিলেন বলেই ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এ দেশে। এ দেশে মাদ্রাসা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটে ইংরেজদের ইচ্ছায়। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় দফা মাদ্রাসা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায়। তৃতীয় দফা বা বর্তমান রূপের মাদ্রাসা-সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের সামরিক শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায়। অর্থাৎ এই যে আমাদের সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, তা ভূমিজাত নয়, বিদেশি শক্তি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের চাপিয়ে দেওয়া।


একটি জাতি যখন স্বাধীন হতে চায়, স্বাধীন থাকতে চায় তখন তাকে সংস্কৃতির বিবিধ উপাদান নিয়ে ভাবতে হয়। কোনটি তার স্বাধীনতার পক্ষে, কোনটি তার স্বাধীনতার বিপক্ষে তা চিনতে পারতে হয়। সাধারণভাবে ভূমি থেকে যা উৎসারিত তা হচ্ছে নিজস্ব। আমদানিকৃত এবং ভূমি কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত উপাদানগুলোও গুরুত্বপূর্ণ; তবে তা ‘অন্ধকার’ ডেকে আনতে পারে। ইসলামী সংস্কৃতি বা আরব-পারস্য-তুর্কি সংস্কৃতি বাংলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত হয়েছে। হাজার বছর ধরে তা জীবনচর্চারও অংশ। সে অর্থে তা এখন বাংলার সংস্কৃতিও বটে, কিন্তু তা সতর্কতার সঙ্গে, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে চর্চা না হলে দেশের স্বাধীনতাই বিপন্ন হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, ভূমি থেকে যা উৎসারিত বা নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে কীভাবে চিনব ও চর্চা করব?
এই চেনা ও চর্চার প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীদের বিশেষত গবেষক, লেখক ও সাংবাদিকদের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার গুরুত্বকে স্বীকার করেও বলতে হয় এ কাজে মুখ্য ভূমিকা গবেষক, লেখক ও সাংবাদিকদের। তাদের প্রধান শত্রুও আবার বুদ্ধিজীবীরাই। তাই তাদের কাজটি সহজ নয়।  ব্রিটিশ শাসনামলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীতা বহু উপাদানকে চিহ্নিত করেছেন, পাকিস্তানকালে সে সবই হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের অস্ত্র। লোকগান, যাত্রাপালা, কবিগান, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত ইত্যাদি। এমন কি নামাজ-মোনাজাতও এই অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। ১৯৭৫-এর পর ভূমিজ উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে, নিগ্রহ চালানো হয়েছে কি হয়নি তা এখানে আলোচ্য নয়, এখানে আলোচ্য এটাই যে সংগীত ও চলচ্চিত্রের মতো সাংস্কৃতিক পণ্যের বাণিজ্যিক সাফল্য নির্ভর করে ভূমিজ উপাদানগুলোর যথাযথ ব্যবহারের ওপর। দেশের জনপ্রিয় গান ও চলচ্চিত্রগুলো তার সাক্ষী। লোকজ বিবিধ পণ্য এক পহেলা বৈশাখেই যে অর্থনৈতিক লেনদেন ঘটায় তা সারাবছরের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে, এমনকি বিদেশি বিনিয়োগোর ‘স্বাধীনতা’ হরণের ঝুঁকিকেও মোকাবিলা করে ভূমিজ পণ্য বা লোক পণ্য। 
পহেলা বৈশাখের যে আয়োজনটি বিগত বছরগুলোয় ‘সংস্কৃতি’বিষয়ক আলোচনার কেন্দ্রে তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র চর্চায় ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজন যেমন একটি মাইলফলক, এটিও তেমনি। এর প্রভাব ব্যাপক। এই শোভাযাত্রার প্রভাবে দেশে এখন বিবিধ রকম শোভাযাত্রা হয়ে থাকে সেটা যেমন রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, তেমনি স্রেফ সামাজিক। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা আকাশ থেকে হঠাৎ পতিত কোনো ঘটনা নয়। এটি দেশে প্রচলিত হাজার বছরের বিবিধ শোভাযাত্রারই একটি সংঘটিত তথা আধুনিক রূপ বা নাগরিক রূপ। যুক্তিসঙ্গত কারণেই এ শোভাযাত্রার একটি রাজনৈতিক পরিচয় আছে। যার ফলে প্রতিবছর এ শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করেই বৈশাখী সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনায় আমরা মেতে উঠছি প্রতিবছর। এ আলোচনার মধ্য দিয়েই দেশের স্বাধীনতা সুসংহত হবে; তবে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব নিতে হবে স্বরূপ সন্ধানের। ব্রিটিশ কালের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পর মৌলিক সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর সন্ধানে বুদ্ধিজীবীদের অনীহা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যই হুমকিস্বরূপ।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর জন্ম দিয়েছে, আরও দেবে। এ উপাদানগুলো স্রেফ বিনোদনের বিষয় নয়; অর্থনীতি ও রাজনীতিতেও রয়েছে তার বিশাল ভূমিকা।
পরিশেষ
ইউরোপীয় ড্রাম আমরা বাজাব, আরবি তাবলও বাজাব, কিন্তু ঢোল ভুলে নয়। এই ঢোল বাজাতে পারাতেই আমাদের স্বাধীনতা। v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ল দ শ র স ব ধ নত আম দ র স স ক ত স স ক ত ব ষয়ক র জন ত ক ব স তবত উপ দ ন ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুণ্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজি পাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল, সে সম্পর্কে নিচে কয়েকটি নজির উপস্থাপন করছি। এগুলো জানার পর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কারোরই পাকিস্তানপ্রেমী হওয়া অযৌক্তিক। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবিরোধী হয়, সেটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় নয়। কিন্তু পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। 

১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলো প্রমাণ করছে, কত নির্মমভাবে পাকিস্তানের শাসকমহল পূর্ব পাকিস্তানকে (‘পূর্ব বাংলা’ থেকে যার নাম ১৯৫৫ সালে হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’) বঞ্চনা, শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি-পাচার ও বৈষম্যের শিকার করেছিল—

১. প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের ৭৫-৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রপ্তানি পণ্য থেকে। ওই রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭-৪৮ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল, তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭-১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনোই বছরে রপ্তানি আয়ের এক-পঞ্চমাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি, এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।

২. ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ওই বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ওই ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি

৩. পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা কবজা করে নিয়েছেন।

৪. ওই ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।

৫. ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।

৬. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি ৫ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।

৭. ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্পকারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্পকারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।

৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছিল পাকিস্তানে।

৯. ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা।

১০. যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।

১১. পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণ ব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান।

১২. ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ ও এর শাখাগুলোতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে। এ কারণে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি ১৯৭০ সালে সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হয়েছিল। উপরন্তু আর্থিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যার সমাধানে অর্থায়ন করতে বারবার অস্বীকার করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।

স্বাধীনতা-উত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৫ সালে ২ হাজার ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে, অথচ পাকিস্তানের মাত্র ১ হাজার ৫৪৭ ডলার। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যৌক্তিক ছিল।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার সরকারের মতো ভারতের কাছে নতজানু হবে না, সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার প্রায় তিন পাশ ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় না রাখলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না