রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে প্রশাসনের পদক্ষেপ চাই
Published: 18th, April 2025 GMT
গ্রামগঞ্জে বংশবিরোধের ঘটনা নতুন নয়। আমাদের সাহিত্য ও সিনেমায় এর অজস্র নমুনা আছে। সমাজ ও পরিবারের নানা বাস্তবতায় এমন বিরোধ তৈরি হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুঃখজনক হচ্ছে, এমন অনেক বংশবিরোধ যুগ যুগ ধরে চলমান থাকে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, খুনোখুনি, পাল্টাপাল্টি মামলাও চলতে থাকে। কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় এমন এক বংশবিরোধ চলছে অর্ধশতাব্দী ধরে। গ্রামবাসীর উদ্যোগে শান্তি কমিটি গঠন করেও সে বিরোধ মেটানো যায়নি। এমন বিরোধের শেষ কোথায়?
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, আধিপত্য ধরে রাখাকে কেন্দ্র করে উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের কর্তাবাড়ি ও সরকারবাড়ির মধ্যে বিরোধ চলছে ৫৬ বছর ধরে। এই বিরোধে দুই পক্ষের ১৪ জন নিহত হয়েছেন। মামলা হয়েছে শতাধিক। এতে গ্রামের শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। একের পর এক প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে এবং বেড়ে উঠছে এমন পরিস্থিতির মধ্যে। এই টানা বিরোধ শিশুর বেড়ে ওঠায় মানসিকভাবে কতটা প্রভাব ফেলে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কর্তাবাড়ি ও সরকারবাড়ির বিরোধ মূলত এলাকায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শন নিয়ে। আধিপত্য ধরে রাখাকে উভয় বংশের লোকজন আভিজাত্য মনে করেন। এর মধ্যে এক বাড়ির নেতৃত্বে রয়েছেন উপজেলার এক বিএনপি নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান। আরেক বাড়ির নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান। সর্বশেষ দুই বংশের বিরোধ মেটাতে গ্রামবাসীর উদ্যোগে একটি ‘শান্তি কমিটি’ও গঠন করা হয়েছিল। এরপরও গত মঙ্গলবার আবারও সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। গত ঈদুল আজহার আগের দিন ফুটবল খেলা নিয়ে সংঘর্ষে এক বাড়ির একজন নিহত হন। সে ঘটনার সূত্র ধরে দুই পক্ষ আবার সংঘর্ষ জড়ালে আরেক বাড়ির একজন নিহত হন।
বিরোধ মেটাতে দুই বংশের লোকজন নিয়ে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটিকে দুই বংশের মধ্যে আবার সংঘর্ষ না হওয়ার বিষয়ে নজর রাখা এবং মামলার কারণে গ্রামছাড়া হওয়া দুই পক্ষকে গ্রামে ফিরিয়ে শান্তিতে বসবাস নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুই পক্ষের লোকজন গ্রামে ফেরার পর আবার উত্তেজনা তৈরি হয় এবং দুই পক্ষ আবার সংঘর্ষে জড়ায়।
স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য, গ্রামের দুটি বংশের শত্রুতা কয়েক প্রজন্মের। গ্রাম দুটিকে নিয়ে পুলিশকে সর্বদা তটস্থ থাকতে হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়।
আমরা আশা করব, দুই বংশের এ দীর্ঘ বিরোধ মেটাতে স্থানীয় প্রশাসন থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। যুগের পর যুগ এমন বিরোধ চলতে পারে না। এর অবসান হোক। গ্রামেও শান্তি ফিরে আসুক।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।