সিন্ধু নদের পানি সরবরাহ আটকে দেওয়ার ভারতের হুমকিতে পাকিস্তানে আতঙ্ক
Published: 27th, April 2025 GMT
সিন্ধু নদ থেকে সামান্য দূরের একটি সবজিখেতে কীটনাশক ছিটাচ্ছিলেন পাকিস্তানের কৃষক হোমলা ঠাকুর। তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। একদিকে সূর্যের প্রখর তাপ, আরেক দিকে নদীর পানি কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে আবার কাশ্মীরে ভয়াবহ হামলার পর ভারত উজানে সিন্ধুর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
৪০ বছর বয়সী হোমলা ঠাকুর বলেন, ‘যদি তারা পানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে এই পুরো এলাকা, পুরো দেশ থর মরুভূমিতে পরিণত হবে।’ কথাগুলো বলে স্প্রেগানের ট্যাংক ভরাতে নদীর দিকে ফিরে যান হোমলা।
‘আমরা না খেয়ে মরব’দক্ষিণ-পূর্ব সিন্ধু প্রদেশের লতিফাবাদ এলাকায় প্রায় ৫ একর (প্রায় ২ হেক্টর) জায়গাজুড়ে চাষাবাদ করছেন হোমলা। তিব্বত থেকে উৎপত্তি হওয়া সিন্ধু নদ ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এ এলাকায় এসে আরব সাগরে পতিত হয়েছে।
১৫ জনেরও বেশি পাকিস্তানি কৃষক ও একাধিক বিশেষজ্ঞের বক্তব্যেও হোমলা ঠাকুরের উদ্বেগগুলো প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃষ্টি কম হওয়ায় এমন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি গত বুধবার একতরফা স্থগিত করেছে নয়াদিল্লি। এ চুক্তির কারণে পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ কৃষি খামারের জন্য পানি পাওয়ার পথ নিশ্চিত হয়েছিল।
চুক্তি স্থগিত করে ভারত বলেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাকিস্তান নির্ভারযোগ্যভাবে আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে।
দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত তাৎক্ষণিকভাবে পানিপ্রবাহ বন্ধ করতে পারবে না। কারণ, চুক্তি অনুযায়ী, অভিন্ন তিনটি নদীতে ভারত শুধু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়তে পারে, বড় কোনো জলাধার বা বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না। তবে কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে।গত মঙ্গলবার বিকেলে কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনায় ২৬ জন নিহত হন। ভারতের দাবি, কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলা চালানো তিনজনের দুজন পাকিস্তানের নাগরিক। তবে ইসলামাবাদ এ ঘটনায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, ‘পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত পানির প্রবাহ বন্ধ বা বাধাগ্রস্ত করার যেকোনো চেষ্টা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হবে।’
সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তির মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অভিন্ন সিন্ধু নদ এবং এর শাখা নদীগুলোর পানিবণ্টন হয়ে আসছে।
দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত তাৎক্ষণিকভাবে পানিপ্রবাহ বন্ধ করতে পারবে না। কারণ, চুক্তি অনুযায়ী, অভিন্ন তিনটি নদীতে ভারত শুধু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়তে পারে, বড় কোনো জলাধার বা বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না। তবে কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল বলেন, ‘সিন্ধু নদের এক ফোঁটা পানিও যেন পাকিস্তানে না পৌঁছাতে পারে, তা আমরা নিশ্চিত করব।’
এ নিয়ে পাকিস্তানিদের মধ্যে আতঙ্কের বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি জবাব দেননি।
সিন্ধু নদের এক ফোঁটা পানিও যেন পাকিস্তানে না পৌঁছাতে পারে, তা আমরা নিশ্চিত করব।চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল, ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রীনাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ভারত নিজেদের কৃষিকাজের জন্য খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নিতে পারে। পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেরও পরিকল্পনা করছে তারা। যেগুলো শেষ হতে চার থেকে সাত বছর সময় লাগতে পারে।
ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান কুশবিন্দর ভোহরা বলেন, ভারত তাৎক্ষণিক যা করতে পারে তা হলো, নদীগুলোর পানিপ্রবাহ–সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি বন্ধ করা, বন্যা সতর্কতা দেওয়া বন্ধ রাখা ও পার্মানেন্ট সিন্ধু কমিশনের আওতায় হওয়া বার্ষিক বৈঠকগুলো এড়িয়ে যাওয়া।
পার্মানেন্ট সিন্ধু কমিশন দুই দেশের একজন করে কর্মকর্তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।
কুশবিন্দর একসময় ভারতের সিন্ধুবিষয়ক কমিশনারও ছিলেন এবং বর্তমানে মাঝেমধ্যে সরকারকে পরামর্শ দেন। তিনি আরও বলেন, ‘কখন পানি আসছে, কতটা আসছে, সেসব তথ্য তারা (পাকিস্তান) বেশি পাবে না। তথ্য ছাড়া তারা পরিকল্পনা করতে পারবে না।’
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বিষয়টি শুধু (পাকিস্তানের) কৃষিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পানির ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপরও প্রভাব পড়বে। এতে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ ভাকার আহমেদ মনে করেন, ভারতের সিন্ধু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকিকে পাকিস্তান যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেনি। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে বন্যার সময় (সিন্ধু দিয়ে) দ্রুত পানিপ্রবাহ থামানো যাবে, এমন কোনো অবকাঠামো এখনো ভারতের নেই। তাই এ সময়টা পাকিস্তানের জন্য তাদের পানি খাতে বিদ্যমান অদক্ষতাগুলো দূর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে।’
এই অর্থনীতিবিদের মতে, ‘পানি খাতে ব্যবস্থাপনাগত অনেক অদক্ষতা রয়েছে ও অপচয় হচ্ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা বলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ভারত নিজেদের কৃষিকাজের জন্য খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নিতে পারে। পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেরও পরিকল্পনা করছে তাঁরা, যেগুলো শেষ হতে চার থেকে সাত বছর লাগতে পারে।বিদ্যমান মতপার্থক্যসাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনার চেষ্টা করে আসছে। কিষানগঙ্গা ও রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জলাধারের আয়তন নিয়ে দুই দেশ হেগের পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনে তাদের মতপার্থক্য মেটানোর চেষ্টা করছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান কুশবিন্দর ভোহরা বলেন, ‘এখন আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো আমাদের প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে পারব।’
গত বৃহস্পতিবার এক চিঠিতে ভারত পাকিস্তানকে বলেছে, চুক্তি স্বাক্ষরের সময় থেকে এখন জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়াসহ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে এবং অধিক পরিমাণে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎসের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেছে তারা।
সিন্ধু প্রদেশের ১৫০ একরের কৃষি খামারের মালিক নাদিম শাহ তুলা, আখ, গম ও সবজি চাষ করেন। তিনিও পানির সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
নাদিম বলেন, ‘আমরা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখি, তবে ভারতের কার্যক্রম নিয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে।’
আরও পড়ুনসিন্ধু পানি চুক্তি কী, ভারত কি এটি বাতিল করতে পারে২০ ঘণ্টা আগেপ্রায় ২৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত তিনটি অভিন্ন নদীর পানি ১ কোটি ৬০ লাখ হেক্টর পরিমাণ জমির সেচকাজের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা দেশের মোট কৃষিজমির প্রায় ৮০ শতাংশ।
করাচিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাকিস্তান অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চের গবেষক ঘাশারিব শওকত বলেন, ভারতের এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে এমন একটি ব্যবস্থার মধ্যে অনিশ্চয়তা ঢুকে গেছে, যা নিয়ে কখনো অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার কথা ছিল না।
এই গবেষক আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের কাছে কোনো বিকল্প নেই। এ চুক্তির আওতায় থাকা নদীগুলোর ওপর শুধু কৃষি খাতই নয়, বরং নগরব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রা নির্ভর করে।’
পাকিস্তানি রাজনীতিকেরা বলছেন, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান চারবার যুদ্ধে জড়ালেও এ চুক্তির ওপর প্রভাব পড়েনি। কিন্তু এবার চুক্তি স্থগিত হওয়ার বিষয়টি একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করল।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা সংঘাতে আটকে আছি। আর আমি মনে করি, সিন্ধু পানি চুক্তি থেকে সরে গিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও নতুন এক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এটা কোনোভাবেই ঘটতে দেওয়া যাবে না।’
আরও পড়ুনএক ফোঁটা পানিও যাতে পাকিস্তানে না যায়, আমরা তা নিশ্চিত করব: ভারতের জলমন্ত্রী২৬ এপ্রিল ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জলব দ য ৎ প রকল প প ন প রব হ কর মকর ত র জন য হ বন ধ র ওপর বলছ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।
বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।
জ্বালানি তেলবিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।
কৃষিপণ্যবিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।
খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।
২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।
দেশে কেন দাম বেশিবিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।
আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।
দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।