দেশে বৈষম্যের উদাহরণ কারিগরি শিক্ষা, উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের প্রস্তাব: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
Published: 29th, April 2025 GMT
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, দেশে বৈষম্য ও অবহেলার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কারিগরি শিক্ষা। অভ্যুত্থানপরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারও দায়িত্ব নেওয়ার পর কারিগরি শিক্ষা নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ‘বাংলাদেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা: বর্তমান পরিস্থিতি ও সংস্কার চিন্তা’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে কারিগরি শিক্ষার আধুনিকায়নের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
কারিগরি শিক্ষায় অবহেলা পীড়া দেয় উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘নীতিপ্রণেতাদের কাছে আমরা এই ব্যথা পৌঁছাতে চাই। কারিগরি শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছেন, সেখানেও রোগের উপসর্গ নিরাময়ের দাবি রয়েছে। মূল সমস্যা সমাধান করতে হলে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।’
টেকসই উন্নয়ন অর্জনে কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০২৩ সালের টেকসই উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে যুগোপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরি, উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ এবং কারিগরি শিক্ষাকে মূল ধারার শিক্ষায় যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন না হওয়াকে জাতীয় ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘শিক্ষা এমন একটি জিনিস, এটা টেকনিক্যাল বিষয় নয়। এর মধ্যে মূল্যবোধ থাকে। এটার মধ্যে বিশ্ব দীক্ষা থাকে। পৃথিবী, মানুষ ও দেশকে আমরা কীভাবে দেখি, এসব বিষয় থাকে। এটার ভেতর ইতিহাস থাকে। বর্তমান উত্তরণকালীন সময়ে বিষয়গুলো অনেক আলোচিত। কোনো ক্ষেত্রে এটি বিতর্কের জায়গায়ও চলে যায়।’
বাংলাদেশে শিক্ষা এখন বড় বৈষম্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এর কারণ হলো, এখনো কারিগরি শিক্ষাকে যথোপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়নি। সামাজিকভাবেও এই শিক্ষাকে নিচু দৃষ্টিতে দেখা হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখনো কারিগরি শিক্ষাকে মিস্ত্রি তৈরির শিক্ষা মনে করে।
মিডিয়া ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। কারিগরি শিক্ষাকে অবমূল্যায়ন করলে উন্নত দেশ গঠন বাধার মুখে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
কারিগরি শিক্ষায় দেশের উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এতে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বুঝতে পারবেন যে কী ধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ জরুরি। পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত করে শিক্ষা–প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি বাংলাদেশের জন্য বিনিয়োগ সুবিধা তৈরি করবে উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৬ সালে আমেরিকা শুল্ক বৃদ্ধির করলে চীন তাদের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ভিয়েতনামে নিয়ে যায়। এখনো একই পরিস্থিতি তৈরি হবে। চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশসহ এই স্তরের অন্য দেশগুলোয় আসবে। কিন্তু আমাদের দক্ষতার সঙ্গে সেটি ধরতে হবে।
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের নেটওয়ার্ক ফোকাল পয়েন্ট তারান্নুম জিনান, গবেষক নাইমা জাহান তৃষা, সংলাপ সহযোগী রিফাত বিন আওলাদ ও গবেষক ইন্টার্ন মালিহা রহমান।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: রহম ন
এছাড়াও পড়ুন:
চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
চিনি আর লবণ– দুটিই সাদা ও ঝকঝকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক হলেও তাদের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সরল অথচ গভীর সত্যটি আমাদের চারপাশের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আজ যখন মানুষ শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখোশ পরে এগিয়ে আসে, আমরা বুঝতে পারি না– কে চিনি, কে লবণ। এই বিভ্রমের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। তার ফলে সমাজে জন্ম নিচ্ছে ভাঙন, ক্ষয় ও ব্যথার করুণ কাব্য।
শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে প্রতারণার ছায়া আজ সমাজের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও বন্ধুত্বের আবরণে, কখনও আত্মীয়তার মোড়কে, আবার কখনও নির্ভরতার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের বারবার আহত করে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন বা পারিবারিক জীবন– বিশ্বাসের অবক্ষয়ের নির্মম চিত্র আজ সর্বত্র বিদ্যমান। সবচেয়ে আপন বলে যার হাত ধরেছি, সেই হাত কখন যে ছুরি হয়ে ফিরে আসে– বলা দুষ্কর।
সম্প্রতি রাজধানীর উপকণ্ঠে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে। বৃদ্ধ মা তাঁর তিন সন্তানকে অকুণ্ঠ বিশ্বাস করে সব সম্পত্তি লিখে দেন। সন্তানরা কথা দিয়েছিল– শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের পাশে থাকবে। কিন্তু দলিলের কালি শুকানোর আগেই মাকে উঠিয়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের চোখের জল তখন ছিল মূল্যহীন; সম্পদের নেশাই ছিল মূল।
অন্যদিকে দীর্ঘদিনের ‘বিশ্বস্ত’ বন্ধু ব্যবসার আড়ালে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে রাতের অন্ধকারে। এসব গল্প আজ প্রতিটি নগর-পল্লীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্পর্কের পবিত্রতা আজ যেন লোভ ও মুনাফার কাছে নতজানু।
বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা কোনো দাগের মতো নয়, যা সময়ের সঙ্গে মুছে যায়। বরং এটি মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। একজনের আঘাত শুধু তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; ছড়িয়ে পড়ে সমাজজুড়ে। গড়ে ওঠে এক অবিশ্বাসের দেয়াল, যেখানে একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সম্পর্কের উষ্ণতা ক্রমে ঠান্ডা হতে হতে বরফে পরিণত হয়, যা গলাতে লাগে যুগের পর যুগ।
ভোগবাদী সভ্যতা মানুষকে করে তুলেছে আত্মকেন্দ্রিক। মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার সংকট এবং তাৎক্ষণিক লাভের মোহে সম্পর্কও আজ মুনাফার মাপে মাপা হয়। বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, প্রেম– সবকিছু যেন পরিণত হয়েছে একেকটি চুক্তিতে। ‘কে কতটা কাজে লাগবে’– এই প্রশ্নই আজ সম্পর্কের মানদণ্ড। তবে সব আলো নিভে যায়নি। অন্ধকার যত গভীর হোক, এক টুকরো মোমবাতি গোটা ঘর আলোকিত করতে পারে। এই সংকটময় সময়ে আমাদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক হতে হবে। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবেগের তাড়নায় নয়, বিবেকের আলোয় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। শিশুর মনে শৈশব থেকেই সততা, বিশ্বস্ততা ও মানবিকতার বীজ বপন করতে হবে। পরিবারই হচ্ছে ব্যক্তিত্ব গঠনের মূল কেন্দ্র। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে সমাজে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠা পায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। তবু এই অন্ধকারে কিছু আলোকবর্তিকা রয়েছেন, যারা এখনও বিশ্বাসের মানদণ্ডে অবিচল। যাদের জীবন শুধু নিজের জন্য নয়, অপরের কল্যাণে নিবেদিত। সংকটে পাশে দাঁড়ানো, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলানো– এটাই তাদের ধর্ম। এরা প্রমাণ করে– বিশ্বাস এখনও বিলুপ্ত হয়নি পুরোপুরি। শুধু খুঁজে নিতে জানতে হবে।
পরিশেষে, চিনি ও লবণের বাহ্যিক সাদার ভ্রম নয়, আসল স্বাদ বোঝার সক্ষমতা অর্জন করাই আজ সময়ের দাবি। মানুষকে তার কার্যকলাপের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে; বাহ্যিক মোহের ফাঁদে পা না দিয়ে। অন্ধবিশ্বাস নয়– সচেতন, বিবেকবান বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে তুলতে হবে সম্পর্কের ভিত।
মুহাম্মদ ইমাদুল হক প্রিন্স: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়