ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, আমেরিকা শুধু আমেরিকানদের জন্য; কিন্তু ডলার সবার জন্য। ট্রাম্প টুইট করে বলেছেন, যদি উদীয়মান অর্থনীতির জোট ব্রিকস নতুন মুদ্রা চালু করে অথবা ‘মহাশক্তিশালী মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো মুদ্রাকে সমর্থন দেয়’, তাহলে তাদের পণ্য আমদানিতে ১০০ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে।
তবে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান স্টিফেন মিরান তাঁর সঙ্গে একমত নন। ৭ এপ্রিল হাডসন ইনস্টিটিউটে তিনি বলেন, ‘ডলারের বিশ্বব্যাপী ব্যবহার দীর্ঘ মেয়াদে মুদ্রাবাজারে বিকৃতি সৃষ্টি করেছে এবং অন্যান্য দেশের অবিচারপূর্ণ বাণিজ্য বাধার সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্থির বাণিজ্যঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
এই মত শুধু মিরানের নয়। মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন (মাগা) দর্শনের অনুসারী আরও কিছু অর্থনীতিবিদও একই কথা বলছেন। প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ মাইকেল পেটিস সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে একটি নিবন্ধে লিখেছেন: ‘যুক্তরাষ্ট্র গ্লোবাল ডলার ছাড়াই আরও ভালো থাকত।’
বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদা বাড়ায় এর দাম বাড়ে। ট্রাম্প মনে করেন, এটি ভালো ব্যাপার; কারণ তাঁর মতে, শক্তিশালী দেশগুলোর মুদ্রাও শক্তিশালী হওয়া উচিত। কিন্তু তিনি যেসব উপদেষ্টাদের চুপ করিয়ে রেখেছেন, তাঁরা উদ্বিগ্ন। কারণ, তাঁরা মনে করেন, শক্তিশালী ডলার মার্কিন শিল্পকে প্রতিযোগিতাহীন করে তোলে এবং দেশ থেকে কর্মসংস্থান বিদেশে চলে যায়।
তাহলে কার কথা ঠিকফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া, কলম্বিয়া—এবং আরও অনেক দেশের মানুষ যখন সঞ্চয় বা বিনিয়োগের জন্য ডলার ব্যবহার করে, তখন তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রকে এক বিশাল সুবিধা দিয়ে থাকে।
১৯৬০-এর দশকে ফ্রান্সের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ভ্যালেরি জিসকার দ্যস্তাঁ এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাড়াবাড়ি রকমের বিশেষাধিকার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি এটিকে কোনোভাবেই ব্যয় বা ক্ষতি হিসেবে দেখেননি, বরং এটিকে মার্কিন সুবিধা হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।
অন্যদিকে মিরান ও পেটিস এই সুবিধাটাকেই এখন ‘বাড়াবাড়ি রকমের বোঝা’ হিসেবে দেখছেন।
প্রায় প্রতিটি দেশই তাদের ব্যয় মেটাতে নিজেদের মুদ্রা ছাপে। দেশের মানুষ পণ্য ও সেবার বিনিময়ে এই কাগজের টুকরাগুলো গ্রহণ করে। অর্থনীতিবিদেরা এই ব্যবস্থাকে বলেন ‘সেনিয়োরেজ’। (একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন নতুন মুদ্রা ছাপে, তখন সেই মুদ্রা ছাপানোর খরচ বাদ দিয়ে যেটুকু মূল্য বা লাভ হাতে আসে, সেটাই হচ্ছে সেনিয়োরেজ। সহজ ভাষায়, আপনি যদি ১০ টাকা মূল্যমানের একটি নোট ছাপাতে ২ টাকা খরচ করেন, তাহলে বাকি ৮ টাকাই হচ্ছে সরকারের লাভ বা সেনিয়োরেজ।)
কিন্তু যখন মানুষ তাদের দেশের মুদ্রায় আস্থা হারায় এবং সেটা ফেলে দিতে চায় (যেমনটা আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, সুদান ও জিম্বাবুয়ের মতো দেশে ঘটেছে) তখন ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য হঠাৎ বেড়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি এখানে আলাদা; কারণ, সারা বিশ্বের মানুষ ডলার হাতে রাখতে চায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বের ওপর সেনিয়োরেজ পায়। ফেডারেল রিজার্ভের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এখন অন্তত এক ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ বাজারে চলমান মোট ডলারের ৪৫ শতাংশ নিজের কাছে রেখেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একধরনের স্বল্পমূল্যের অর্থায়নের উৎস।
ধরুন, একজন আমেরিকান বিদেশে গিয়ে ডলারে হোটেলের ভাড়া পরিশোধ করলেন। ধরে নিই, তিনি ১০০ ডলার দিলেন। বিদেশের সেই হোটেল ব্যবসায়ী সেই ১০০ ডলার জমিয়ে রাখলেন এবং এক বছর পর সেই ডলার নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলেন। যদি যুক্তরাষ্ট্রে এক বছরে পণ্যের দাম বেড়ে যায় (মূল্যস্ফীতি হয়) তাহলে সেই ১০০ ডলারে তিনি আগের মতো পণ্য বা সেবা কিনতে পারবেন না। হয়তো আগের যেটা ১০০ ডলারে পাওয়া যেত, এখন সেটার দাম হয়ে গেছে ১০৫ ডলার। এর মানে দাঁড়াল, এক বছর আগে তিনি একজন আমেরিকানকে ১০০ ডলার ধার দিয়েছিলেন, কিন্তু এক বছর পর সেই ১০০ ডলার দিয়ে তিনি আগের মতো জিনিস কিনতে পারছেন না। অর্থাৎ তিনি এমন একটা ঋণ দিয়েছেন, যার সুদের হার নেতিবাচক—কারণ, টাকা ফেরত পেলেও সেই টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
ঠিক এই কায়দায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বাকি দেশগুলো থেকে সুদবিহীন ঋণ নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কম খরচে অর্থায়ন পাওয়ার এটাই একমাত্র পথ নয়। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনে বন্ধক রাখার কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় মার্কিন সরকার ইস্যু করা বন্ড, বিশেষ করে ট্রেজারি বিল। যেহেতু এই বন্ড ব্যবহার করা সহজ, তাই বিদেশিরা এগুলো হাতে রাখতে চান, এমনকি যদি এদের সুদের হার অন্য দেশের সমপর্যায়ের বন্ডের চেয়ে কম হয়, তবুও। অর্থনীতিবিদেরা এই ব্যবধানকে বলেন ‘কনভিনিয়েন্স ইয়িল্ড’।
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ, বিদেশিরা মোট ৮ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কিন সরকারি ঋণ তাঁদের কাছে রেখেছেন। যদি ট্রেজারি বিল বন্ধক রাখার উপযোগিতার কারণে সুদের হার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কম হয়ে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করছে।
শুধু তা–ই নয়, যদি এই সুবিধার কারণে ট্রেজারির সুদের হার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারের চেয়েও নিচে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র একরকম কইয়ের তেলে কই ভাজছে। তারা সরকারিভাবে ঋণ ইস্যু করতে পারছে এবং কোনো দিন সেই ঋণ পরিশোধ করতে না হলেও তা চলছে।
হাডসন ইনস্টিটিউটে বক্তব্য রাখার আগে মিরান স্বীকার করেছিলেন, ‘ডলারের চাহিদা আমাদের ঋণের সুদের হার কমিয়ে রেখেছে।’ কিন্তু বাকিটা বক্তৃতায় তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন। তিনি আরেকটি বড় সুবিধার কথাও বিবেচনায় আনেননি। সেটি হলো, গ্লোবাল ডলারের কারণে যখনই যুক্তরাষ্ট্র কোনো সংকটে পড়ে (যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর অথবা ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ ঘোষণার পরের অস্থির সময়), তখন ডলারের মূল্য কমে যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যে ডলার ঋণ নিয়েছে, তার বোঝাও কমে যায়। কিন্তু যেসব দেশ নিজেদের মুদ্রায় ঋণ নেয়, তাদের সেই মুদ্রার মূল্য হ্রাসের ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে উচ্চ সুদ দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রকে সেটা করতে হয় না।
আমেরিকা লাভ করলে কি বাকি বিশ্বের ক্ষতি হয়? পুরোপুরি তা নয়। সারা বিশ্বের মানুষ ডলারনির্ভর নিরাপদ সম্পদে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করতে পারার সুবিধা ভোগ করে। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো অর্থনীতি এমন সুবিধা দিতে পারে না।
এদিক থেকে ইউরোপ একটি স্বাভাবিক বিকল্প হতে পারত। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূলধন বাজার এখনো অনেক বেশি খণ্ডিত; কারণ, সাম্প্রতিক কয়েক বছর আগে থেকেই কেবল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (স্বতন্ত্র সদস্যরাষ্ট্র নয়) ঋণপত্র ইস্যু করা শুরু করেছে। চীনের অর্থনীতি বড় হলেও দেশটির কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও কঠোর মূলধন নিয়ন্ত্রণের কারণে বিশ্ববাসী এখনো রেনমিনবিতে (চীনা মুদ্রা) নির্ভরশীল সম্পদ হাতে রাখতে আগ্রহী নয়।
ডলার একটি বৈশ্বিক মুদ্রা হয়ে উঠেছে কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহাসিকভাবে অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি নির্ভরযোগ্য। যদি মাগা-ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা এটা সমস্যাজনক বলে মনে করেন, তাহলে তাঁদের নেতার (ট্রাম্পের) কাছে এর জন্য তৈরি সমাধান রয়েছে। আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে শুল্ক আরোপ, কানাডা ও ডেনমার্কের মতো মিত্রদেশ আক্রমণের পরিকল্পনার গুজব, আদালতের রায় অগ্রাহ্য করা কিংবা সংবিধানবিরোধীভাবে তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার হুমকি দেওয়া—এসব কিছু করে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে দুর্বল মুদ্রা ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির দেশের মতো করে তুলছেন।
ট্রাম্পের ‘লিবারেশন ডে’ ঘোষণার মাধ্যমে নতুন করে শুল্ক আরোপের পর বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া ছিল একদম পরিষ্কার। এই ঘোষণার পর ইউরোর বিপরীতে ডলারের মূল্য প্রায় ৭ শতাংশ কমে যায়, আর ১০ বছরের ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার প্রায় অর্ধেক শতাংশ বাড়ে। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার দামও পড়ে যায়; কারণ, উচ্চ শুল্ক ও মন্থর বিশ্ব অর্থনীতি তাদের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
প্রায় সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন নীতি তৈরি করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু মাগা অর্থনীতিবিদেরা সেটা করে দেখিয়েছেন। যদি এর ফলে গ্লোবাল ডলার ব্যবস্থাটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে অনেকেই তা নিয়ে শোক করবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আন্দ্রেস ভেলাসকো চিলির সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স-এর পাবলিক পলিসি স্কুলের ডিন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এক বছর র জন য আম র ক সরক র ব যবস ক বছর ব যবহ
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলে হাজার হাজার ভারতীয় থাকার নেপথ্যে কী?
ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের প্রভাব বিশ্বের প্রায় সব দেশের উপরেই পড়ছে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। কারণ ইহুদি এই রাষ্ট্রে প্রচুর ভারতীয় কর্মী কাজ করেন।
“আমার ছয় বছরের মেয়েটাকে বহুদিন দেখিনি। ভেবেছিলাম সামনের মাসে বাড়ি যাব। কিন্তু ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে গেল। কবে যেতে পারব জানি না।” ইসরায়েলের তেল আবিব থেকে বিবিসি বাংলাকে এভাবেই বলছিলেন রাঘবেন্দ্র নাইক নামের এক ভারতীয় নাগরিক।
সেখানে তিনি কেয়ার গিভারের কাজ করেন। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের বাসিন্দা তিনি, কর্মসূত্রে ইসরাইলে আছেন গত ১৩ বছর ধরে। ইসরাইয়েল ও ইরানের সংঘাতের মধ্যে উদ্বেগে রয়েছেন নাইক।
আরো পড়ুন:
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ
ইরানে গ্রেপ্তার ইসরায়েলের ২২ গুপ্তচর
রাঘবেন্দ্র নাইক বলেন, “রাতে কান খাড়া করে থাকতে হয়, কখন সাইরেন বাজে। সাইরেনের আওয়াজ শুনলেই ভূগর্ভস্থ শেল্টারের দিকে দৌড়াই। গত কয়েক রাত আমি বা আমার আশপাশের কেউই ঘুমাতে পারিনি। যে হারে ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা হচ্ছে, তাতে এক এক সময় ভয় হয়, ফিরতে পারব তো?”
ইসরায়েল তেলেঙ্গানা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সোমা রভির গল্পটাও প্রায় একই। তেল আবিবের কাছেই থাকেন তিনি।
রভি বলছিলেন, “গত সপ্তাহে আমার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে এসেছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে গেল। কবে যেতে পারব জানি না।” প্রায় ২০ বছর আগে ইসরায়েল এসেছিলেন কাজের সূত্রে রভি।
তাদের মতো আরো অনেক ভারতীয় এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষই ইসরায়েলৈ থাকেন। ইসরায়েল ও ইরানের সংঘাতে ইরান থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
ভারতের পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে জারি করা নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, আটকে থাকা ভারতীয়দের ইসরায়েল থেকে স্থল সীমান্ত হয়ে প্রথমে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হবে। তারপর সেখান থেকে বিশেষ বিমানে তাদের দেশে ফেরানো হবে। তেল আবিবের ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা এই বিষয়ে নজর রাখবেন। যারা ফিরে আসতে চান, তাদের ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলা হয়েছে।
কাজ বা পড়াশোনার জন্য বহু ভারতীয়ই ইসরায়েলে রয়েছেন। ভারতের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটির প্রায় ২০০০০ হাজার কর্মী ইসরায়েলে আছেন। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে।
ওই দেশে ভারতীয় কর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই কেয়ার গিভারের কাজ করেন। তাছাড়া, নির্মাণ শ্রমিক হিসাবেও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ভারতীয়ই ইসরায়েলে পাড়ি দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে নার্স, কেয়ার গিভার এবং অদক্ষ শ্রমিকের জন্য ইসরায়েল কিন্তু ভারতীয়দের উপরই নির্ভরশীল। ইসরায়েলের প্রবীণ নাগরিকদের একটা বড় অংশই এই কেয়ার গিভারদের উপর নির্ভর করেন।
অশীতিপর নিসিন মোসেরি মুম্বাই থেকে ইসরায়েল গিয়েছিলেন ১৯৬৩ সালে। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমার ছেলেরা যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। আমার দেখাশোনা তো বটেই, সাইরেন বাজলে বোমা থেকে বাঁচতে ভূগর্ভস্থ আশ্রয়স্থলে যেতে হলেও আমাকে আমার কেয়ার গিভারেরই সাহায্য নিতে হবে।”
ইসরায়েলে ভারতীয়দের সংখ্যা
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০ ভারতীয় কর্মী ইসরায়েলে আছেন। তবে এই সংখ্যা আরো বেশি বলেই অনুমান করা হয়। কারণ, ২০২৩ সালে ভারতের সঙ্গে সে দেশের চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায়, বহু ভারতীয় কর্মী সেখানে গেছেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এরমধ্যে ২০২৫ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত, ৬,৬৯৪ জন ভারতীয় কর্মী ইসরায়েলে পৌঁছেছেন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়োগ করেছে।
পাশাপাশি ১৯৫টি ইসরায়েলি কোম্পানিতেও ভারতীয় কর্মী নিয়োগ হয়েছে। নির্মাণকর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই নির্মাণ খাতে নিযুক্ত, কাঠামো নির্মাণ, লোহা বাঁকানো এবং প্লাস্টার করার মতো কাজ করেন।
এরপর গতবছর ইসরায়েল নির্মাণকর্মী এবং কেয়ার গিভার মিলিয়ে প্রায় ১৫,০০০ ভারতীয় কর্মী সে দেশে পাঠানোর অনুরোধ জানায় ভারতকে। তাদের মধ্যে কতজন ইসরায়েলে কাজে যোগ দিয়েছেন, সে বিষয়ে জানা যায়নি।
কী কাজ করেন সেখানে তারা
ইন্ডিয়ান ইকনোমিক ট্রেড অর্গানাইজেশন-এর প্রেসিডেন্ট ড. আসিফ ইকবাল বলেছেন, ভারত থেকে মূলত কেয়ার গিভারের কাজ করেন তারা। মেল নার্স, নার্সিং অ্যাসোসিয়েট হিসাবে ভারতীয়দের চাহিদা রয়েছে। ইসরায়েলে প্রবীণ নাগরিকদের দেখাশোনা করার মানুষের অভাব। তাই ভারত থেকে, বিশেষত দক্ষিণ ভারত থেকে বহু ব্যক্তি কেয়ার গিভারের কাজ করেন। এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
তিনি বলছেন, দ্বিতীয় যে সেক্টরে এখন কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। সেটা হলো, কন্সট্রাকশন। ইসরায়েলের বিভিন্ন অংশে ভবন তৈরি, মেরামতের কাজে বহু ভারতীয় কর্মী নিযুক্ত। ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ পুনর্গঠনের জন্যও কর্মীদের নিয়োগ করা হচ্ছে। তবে এই কর্মীদের সংখ্যাটা নার্সের তুলনায় অনেকটাই কম। এছাড়াও তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক হলেও কর্মী রয়েছেন।
কেন ইসরায়েলমুখী ভারতীয়রা?
ইসরায়েলকে কর্মক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেওয়ার কী কারণ, জানতে চাইলে ম্যাঙ্গালরের বাসিন্দা পিএন লরেন্স বলেন, “এখানে মাইনে অন্যান্য অনেক দেশের চাইতে ভালো। আমি ইসরায়েলে ১৩ বছর কেয়ারগিভারের কাজ করার পর সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে এসেছিলাম, কিন্তু ইসরায়েলে ফিরে যাব ঠিক করেছি।”
পিএন লরেন্স আরো বলেন, “যুদ্ধের কথা মাথায় রেখেও বলব, ইসরায়েল কাজের জায়গা ভালো। এখানে সরকার বিদেশি কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা-সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেয়, যা অন্য দেশে নেই। এখানে আমরা যা আয় করি, তার উপর ভারতে থাকা আমাদের পরিবার নির্ভর করে। কোথায় যাব?”
পেঠা টিকোয়ার যে অংশে ইয়াকভ টকার থাকেন, সেখানে আরো অনেক ভারতীয়ই থাকেন। মুম্বাই থেকে ১৯৬৩ সালে ইসরায়েলে আসা টকার বলেন, গত ২০-২২ বছর ধরে ভারতীয় কর্মীদের সংখ্যা বেড়েছে, মূলত কেয়ার গিভারদের। তার কারণ, পরিবারের সবাই কাজ করেন। বাড়ির বয়স্কদের দেখাশোনার কেউ নেই। এর আগে এত সংখ্যক ভারতীয় কর্মী কিন্তু ইসরায়েলে দেখা যেত না।
তেল আবিবে বাস করেন বেন্নি নাইডু। পেশায় ব্যবসায়ী তিনি। ম্যাঙ্গালোর থেকে ইসরায়েলে এসেছিলেন ৯০-এর দশকে।
তিনি বলেছেন, “তেল আবিব বা তার নিকটবর্তী অঞ্চলেই ভারতীয়রা বাস করেন। যারা কেয়ার গিভার তারা গোটা সপ্তাহ কাজ করার পর সপ্তাহান্তে ভাড়া করা বাড়িতে ফেরেন। সেই সময় আমার দোকানে আসেন কথাবার্তা হয়। আমরা সমস্ত উৎসব একসঙ্গে উদযাপন করি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা সকলেই উদ্বেগে আছি।”
তার মতে, “গাজা নিয়ে সংঘাতের সময় থেকেই ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে। ইরানের সঙ্গে সংঘাতের পর পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হয়েছে এটা স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই।”
নাইডু বিয়ের পর দেশ ছাড়েন। তার কথায়, “আমার স্ত্রী ইহুদী। বিয়ের পর এখানে চলে আসি। নাগরিকত্ব নিই। প্রথমে টেলিফোনের একটা কোম্পানিতে কাজ করতাম। পরে ব্যবসা শুরু করি। আমার তিন ছেলে। দু’জনই মিলিটারি সার্ভিসে যোগ দিয়েছে, ছোটজনও দেবে। আমিও এখানকার নাগরিকত্ব নেওয়ার পর মিলিটারি সার্ভিসে যোগ দিয়েছি।”
‘চতুর্দিকে মৃত্যু ফাঁদ। কোথায় যাব’
এই মুহূর্তে ইসরায়েলের পরিস্থিতি কেমন জানতে চাইলে রাঘবেন্দ্র নাইক বলেন, “ইসরায়েলের পরিস্থিতির কথা নতুন করে কী বলব। আগে সাইরেন শুনলে এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকতাম কিন্তু এখন ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার খুঁজি কারণ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিশালী।”
ইয়াকভের বাড়ির কাছাকাছি দু’টো বাড়ি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, “গাজায় সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর এক সময় যেমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, তেমনই এটাও অভ্যেস হয়ে যাবে। আমাদের চতুর্দিকে মৃত্যু ফাঁদ। কোথায় যাব?”
ইসরায়েলস্থিত ইন্ডিয়ান জিউইশ কমিউনিটি সেন্টারের প্রেসিডেন্ট ওয়াস্কার জানিয়েছেন, তার পরিচিত কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে সাম্প্রতিক হামলায়। তিনি বলেন, “আমার পরিচিত কয়েকজনকে দিন কয়েক আগে হারিয়েছি। তার মধ্যে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া তরুণপ্রজন্মও আছে।”
তার নাতনি স্তাভ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমাদের এখানে মেয়েদেরও সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। আমি দুই বছর আগে আমার মেয়াদ শেষ করেছি। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি হয়তো আবার যেতে হতে পারে।”
এই সমস্ত কিছুর মাঝেই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন নাইক। তিনি বলেন, “আমি ঠিক করেছি পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে ভারতে ফিরে যাব। সেখানেই কাজ খুঁজে নেব। আগে বছরে একবার অন্তত দেশে যেতে পারতাম কিন্তু একের পর এক সংঘর্ষের কারণে সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। এখন ভয় হয়।”
ঢাকা/ফিরোজ