ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, আমেরিকা শুধু আমেরিকানদের জন্য; কিন্তু ডলার সবার জন্য। ট্রাম্প টুইট করে বলেছেন, যদি উদীয়মান অর্থনীতির জোট ব্রিকস নতুন মুদ্রা চালু করে অথবা ‘মহাশক্তিশালী মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো মুদ্রাকে সমর্থন দেয়’, তাহলে তাদের পণ্য আমদানিতে ১০০ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে।

তবে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান স্টিফেন মিরান তাঁর সঙ্গে একমত নন। ৭ এপ্রিল হাডসন ইনস্টিটিউটে তিনি বলেন, ‘ডলারের বিশ্বব্যাপী ব্যবহার দীর্ঘ মেয়াদে মুদ্রাবাজারে বিকৃতি সৃষ্টি করেছে এবং অন্যান্য দেশের অবিচারপূর্ণ বাণিজ্য বাধার সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্থির বাণিজ্যঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

এই মত শুধু মিরানের নয়। মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন (মাগা) দর্শনের অনুসারী আরও কিছু অর্থনীতিবিদও একই কথা বলছেন। প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ মাইকেল পেটিস সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে একটি নিবন্ধে লিখেছেন: ‘যুক্তরাষ্ট্র গ্লোবাল ডলার ছাড়াই আরও ভালো থাকত।’

বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদা বাড়ায় এর দাম বাড়ে। ট্রাম্প মনে করেন, এটি ভালো ব্যাপার; কারণ তাঁর মতে, শক্তিশালী দেশগুলোর মুদ্রাও শক্তিশালী হওয়া উচিত। কিন্তু তিনি যেসব উপদেষ্টাদের চুপ করিয়ে রেখেছেন, তাঁরা উদ্বিগ্ন। কারণ, তাঁরা মনে করেন, শক্তিশালী ডলার মার্কিন শিল্পকে প্রতিযোগিতাহীন করে তোলে এবং দেশ থেকে কর্মসংস্থান বিদেশে চলে যায়।

তাহলে কার কথা ঠিক

ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া, কলম্বিয়া—এবং আরও অনেক দেশের মানুষ যখন সঞ্চয় বা বিনিয়োগের জন্য ডলার ব্যবহার করে, তখন তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রকে এক বিশাল সুবিধা দিয়ে থাকে।

১৯৬০-এর দশকে ফ্রান্সের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ভ্যালেরি জিসকার দ্যস্তাঁ এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাড়াবাড়ি রকমের বিশেষাধিকার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি এটিকে কোনোভাবেই ব্যয় বা ক্ষতি হিসেবে দেখেননি, বরং এটিকে মার্কিন সুবিধা হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।

অন্যদিকে মিরান ও পেটিস এই সুবিধাটাকেই এখন ‘বাড়াবাড়ি রকমের বোঝা’ হিসেবে দেখছেন।

প্রায় প্রতিটি দেশই তাদের ব্যয় মেটাতে নিজেদের মুদ্রা ছাপে। দেশের মানুষ পণ্য ও সেবার বিনিময়ে এই কাগজের টুকরাগুলো গ্রহণ করে। অর্থনীতিবিদেরা এই ব্যবস্থাকে বলেন ‘সেনিয়োরেজ’। (একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন নতুন মুদ্রা ছাপে, তখন সেই মুদ্রা ছাপানোর খরচ বাদ দিয়ে যেটুকু মূল্য বা লাভ হাতে আসে, সেটাই হচ্ছে সেনিয়োরেজ। সহজ ভাষায়, আপনি যদি ১০ টাকা মূল্যমানের একটি নোট ছাপাতে ২ টাকা খরচ করেন, তাহলে বাকি ৮ টাকাই হচ্ছে সরকারের লাভ বা সেনিয়োরেজ।)

কিন্তু যখন মানুষ তাদের দেশের মুদ্রায় আস্থা হারায় এবং সেটা ফেলে দিতে চায় (যেমনটা আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, সুদান ও জিম্বাবুয়ের মতো দেশে ঘটেছে) তখন ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য হঠাৎ বেড়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি এখানে আলাদা; কারণ, সারা বিশ্বের মানুষ ডলার হাতে রাখতে চায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বের ওপর সেনিয়োরেজ পায়। ফেডারেল রিজার্ভের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এখন অন্তত এক ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ বাজারে চলমান মোট ডলারের ৪৫ শতাংশ নিজের কাছে রেখেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একধরনের স্বল্পমূল্যের অর্থায়নের উৎস।

ধরুন, একজন আমেরিকান বিদেশে গিয়ে ডলারে হোটেলের ভাড়া পরিশোধ করলেন। ধরে নিই, তিনি ১০০ ডলার দিলেন। বিদেশের সেই হোটেল ব্যবসায়ী সেই ১০০ ডলার জমিয়ে রাখলেন এবং এক বছর পর সেই ডলার নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলেন। যদি যুক্তরাষ্ট্রে এক বছরে পণ্যের দাম বেড়ে যায় (মূল্যস্ফীতি হয়) তাহলে সেই ১০০ ডলারে তিনি আগের মতো পণ্য বা সেবা কিনতে পারবেন না। হয়তো আগের যেটা ১০০ ডলারে পাওয়া যেত, এখন সেটার দাম হয়ে গেছে ১০৫ ডলার। এর মানে দাঁড়াল, এক বছর আগে তিনি একজন আমেরিকানকে ১০০ ডলার ধার দিয়েছিলেন, কিন্তু এক বছর পর সেই ১০০ ডলার দিয়ে তিনি আগের মতো জিনিস কিনতে পারছেন না। অর্থাৎ তিনি এমন একটা ঋণ দিয়েছেন, যার সুদের হার নেতিবাচক—কারণ, টাকা ফেরত পেলেও সেই টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।

ঠিক এই কায়দায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বাকি দেশগুলো থেকে সুদবিহীন ঋণ নিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কম খরচে অর্থায়ন পাওয়ার এটাই একমাত্র পথ নয়। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনে বন্ধক রাখার কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় মার্কিন সরকার ইস্যু করা বন্ড, বিশেষ করে ট্রেজারি বিল। যেহেতু এই বন্ড ব্যবহার করা সহজ, তাই বিদেশিরা এগুলো হাতে রাখতে চান, এমনকি যদি এদের সুদের হার অন্য দেশের সমপর্যায়ের বন্ডের চেয়ে কম হয়, তবুও। অর্থনীতিবিদেরা এই ব্যবধানকে বলেন ‘কনভিনিয়েন্স ইয়িল্ড’।

২০২৪ সালের শেষ নাগাদ, বিদেশিরা মোট ৮ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কিন সরকারি ঋণ তাঁদের কাছে রেখেছেন। যদি ট্রেজারি বিল বন্ধক রাখার উপযোগিতার কারণে সুদের হার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কম হয়ে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করছে।

শুধু তা–ই নয়, যদি এই সুবিধার কারণে ট্রেজারির সুদের হার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারের চেয়েও নিচে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র একরকম কইয়ের তেলে কই ভাজছে। তারা সরকারিভাবে ঋণ ইস্যু করতে পারছে এবং কোনো দিন সেই ঋণ পরিশোধ করতে না হলেও তা চলছে।

হাডসন ইনস্টিটিউটে বক্তব্য রাখার আগে মিরান স্বীকার করেছিলেন, ‘ডলারের চাহিদা আমাদের ঋণের সুদের হার কমিয়ে রেখেছে।’ কিন্তু বাকিটা বক্তৃতায় তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন। তিনি আরেকটি বড় সুবিধার কথাও বিবেচনায় আনেননি। সেটি হলো, গ্লোবাল ডলারের কারণে যখনই যুক্তরাষ্ট্র কোনো সংকটে পড়ে (যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর অথবা ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ ঘোষণার পরের অস্থির সময়), তখন ডলারের মূল্য কমে যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যে ডলার ঋণ নিয়েছে, তার বোঝাও কমে যায়। কিন্তু যেসব দেশ নিজেদের মুদ্রায় ঋণ নেয়, তাদের সেই মুদ্রার মূল্য হ্রাসের ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে উচ্চ সুদ দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রকে সেটা করতে হয় না।

আমেরিকা লাভ করলে কি বাকি বিশ্বের ক্ষতি হয়? পুরোপুরি তা নয়। সারা বিশ্বের মানুষ ডলারনির্ভর নিরাপদ সম্পদে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করতে পারার সুবিধা ভোগ করে। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো অর্থনীতি এমন সুবিধা দিতে পারে না।

এদিক থেকে ইউরোপ একটি স্বাভাবিক বিকল্প হতে পারত। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূলধন বাজার এখনো অনেক বেশি খণ্ডিত; কারণ, সাম্প্রতিক কয়েক বছর আগে থেকেই কেবল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (স্বতন্ত্র সদস্যরাষ্ট্র নয়) ঋণপত্র ইস্যু করা শুরু করেছে। চীনের অর্থনীতি বড় হলেও দেশটির কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও কঠোর মূলধন নিয়ন্ত্রণের কারণে বিশ্ববাসী এখনো রেনমিনবিতে (চীনা মুদ্রা) নির্ভরশীল সম্পদ হাতে রাখতে আগ্রহী নয়।

ডলার একটি বৈশ্বিক মুদ্রা হয়ে উঠেছে কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহাসিকভাবে অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি নির্ভরযোগ্য। যদি মাগা-ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা এটা সমস্যাজনক বলে মনে করেন, তাহলে তাঁদের নেতার (ট্রাম্পের) কাছে এর জন্য তৈরি সমাধান রয়েছে। আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে শুল্ক আরোপ, কানাডা ও ডেনমার্কের মতো মিত্রদেশ আক্রমণের পরিকল্পনার গুজব, আদালতের রায় অগ্রাহ্য করা কিংবা সংবিধানবিরোধীভাবে তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার হুমকি দেওয়া—এসব কিছু করে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে দুর্বল মুদ্রা ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির দেশের মতো করে তুলছেন।

ট্রাম্পের ‘লিবারেশন ডে’ ঘোষণার মাধ্যমে নতুন করে শুল্ক আরোপের পর বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া ছিল একদম পরিষ্কার। এই ঘোষণার পর ইউরোর বিপরীতে ডলারের মূল্য প্রায় ৭ শতাংশ কমে যায়, আর ১০ বছরের ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার প্রায় অর্ধেক শতাংশ বাড়ে। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার দামও পড়ে যায়; কারণ, উচ্চ শুল্ক ও মন্থর বিশ্ব অর্থনীতি তাদের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।

প্রায় সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন নীতি তৈরি করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু মাগা অর্থনীতিবিদেরা সেটা করে দেখিয়েছেন। যদি এর ফলে গ্লোবাল ডলার ব্যবস্থাটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে অনেকেই তা নিয়ে শোক করবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

আন্দ্রেস ভেলাসকো চিলির সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স-এর পাবলিক পলিসি স্কুলের ডিন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এক বছর র জন য আম র ক সরক র ব যবস ক বছর ব যবহ

এছাড়াও পড়ুন:

ক্লাসে ফেরেননি শিক্ষকরা, বিপাকে ৭ হাজার কুয়েট শিক্ষার্থী 

একাডেমিক কার্যক্রম চালু হওয়ার তৃতীয় দিনেও ক্লাসে ফেরেননি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষকরা। লাঞ্ছনার ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা ক্লাসে ফিরবেন না বলে জানিয়েছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোদমে কবে নাগাদ ক্লাস শুরু হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। পাশাপাশি সেশনজট বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে ৭ হাজার শিক্ষার্থী। 

কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক সাহিদুল ইসলাম বলেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষের পর কিছু শিক্ষার্থী ১০ থেকে ১৫ শিক্ষককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। জড়িতদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা ক্লাস-পরীক্ষা নেবেন না। 

এদিকে, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার ঘটনায় এরই মধ্যে দুই দফা ক্ষমা চেয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। শিক্ষকরা তাদের দাবিতে অনড় রয়েছেন। আগে থেকেই প্রায় দেড় বছরের সেশনজট রয়েছে। এর ওপর গত আড়াই মাস কোনো ক্লাস ও পরীক্ষা হয়নি। এ অবস্থা চলমান থাকায় বাড়ছে সেশনজট। 

কুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ ইলিয়াছ আক্তার বলেন, উপাচার্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে সংকট নিরসনের চেষ্টা করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ