কর্মী থেকে নিজেই এখন শতাধিক রেস্তরাঁর মালিক শামীম, যেখানে কাজ করে দুই হাজারের বেশি মানুষ
Published: 17th, May 2025 GMT
মেলবোর্নে থাকেন মোহাম্মদ শামীম। সেখান থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছেন প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরের ব্রিসবেনে। পথে যেতে যেতে ক্যানবেরা আর সিডনির ৪০টি সাবওয়ে আউটলেট পরিদর্শন করছেন। সে কাজ করতে করতেই সিডনিতে যাত্রাবিরতি নিয়েছেন। ১৫ মে সকালে দক্ষিণ সিডনির ক্যাম্পবেল টাউনের একটি ক্যাফেতে তাঁর মুখোমুখি হলাম। পরনে সাদামাটা পোশাক। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। আলাপচারিতায় ফুটে উঠল বিনয় আর সংযম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ছিলেন শামীম। স্নাতক শেষ করার পর থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় আসার চেষ্টা করছিলেন। ২০০৭ সালে সেই সুযোগ পেলেন। তত দিনে স্নাতকোত্তর শেষ। অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন ইউনিভার্সিটিতে আবার স্নাতকোত্তরেই ভর্তি হলেন, তবে বিভাগ আলাদা—অ্যাকাউন্টিং ও ফাইন্যান্স। পড়াশোনার পাশাপাশি মেলবোর্নেই সাবওয়ের একটি দোকানে খণ্ডকালীন কাজ নেন।
‘সাবওয়ে’ বহুজাতিক ফাস্টফুড চেইন রেস্তোরাঁ। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এটি একটি সাধারণ স্যান্ডউইচের দোকান হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। ‘ইট ফ্রেশ, ফিল গুড’ স্লোগান নিয়ে সাবওয়ে এখন শতাধিক দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। তবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড অঞ্চলে এটি এখন সবচেয়ে বড় কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ ব্র্যান্ড। যা পরিচালিত হয় ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের মাধ্যমে।
এমনই একজন ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানাধীন আউটলেটে ‘স্যান্ডউইচ আর্টিস্ট’ হিসেবে গ্রাহকের অর্ডার নেওয়া, টেবিল মোছা, মেঝে পরিষ্কারসহ নানা কাজ করতেন শামীম। কয়েক মাস যেতেই মালিকের আস্থা অর্জন করেন তিনি। বললেন, ‘দোকানের মালিক একদিন আমাকে পুরো দায়িত্ব দিয়ে বাইরে গিয়েছিলেন। সব দিক সামাল দিতে গিয়ে মনে হয়েছিল, কাজটা তো আমি পারি।’
সে বিশ্বাস থেকেই সাবওয়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। যে মালিকের অধীন কাজ নিয়েছিলেন, তাঁর বেশ কয়েকটি সাবওয়ে দোকানের ফ্র্যাঞ্চাইজি ছিল। দিনে দিনে স্টোর ম্যানেজার হলেন শামীম, তারপর এরিয়া ম্যানেজার। তাঁর কাঁধে তখন বেশ কয়েকটি দোকান পরিচালনার দায়িত্ব।
কর্মীদের সঙ্গে মোহাম্মদ শামীম.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।