জন্মগতভাবে সর্বতোমুখী প্রতিভার অধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম যাপিত জীবনে অর্জন করেছিলেন বৈচিত্র্যমুখী অভিজ্ঞান; যার অনেকখানিই আনকমন ও অনন্য। তাঁর কবিতায় ও সংগীতে সেই অনন্যতার ছাপ ফুটে উঠেছে সোনালি রঙের সচ্ছলতায়। তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি যাপিত জীবন ও ব্যতিক্রমী শৈল্পিক সক্ষমতার উজ্জ্বলতর শিল্প হয়ে আছে। কবিতাটি তাঁর সুচারুতায় সমৃদ্ধ শিল্পের জমিনে ধারণ করেছে দারিদ্র্যের নিবিড়তম, গভীরতম ও সূক্ষ্মতম ছাপ। অর্থনীতিবিদরা বহুদিন যাবৎ দারিদ্র্যের নানাবিধ সংজ্ঞা প্রদান এবং সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ করে আসছেন। সেসব সংজ্ঞায় মূলত দারিদ্র্যকে খাদ্যগ্রহণের ক্যালরি এবং কতিপয় মৌলিক চাহিদা পূরণের-অপূরণের মাপকাঠিতে চেনানোর চেষ্টা আছে। নজরুল সেটাকে হিসাবে রেখে তার সঙ্গে দারিদ্র্যের আরও কিছু ডাইমেনশন যোগ করেছেন। কবিতার শুরুতেই তিনি বলেছেন যে, দারিদ্র্য মানুষকে সত্য কথা বলার দুঃসাহস জোগায়, দান করে অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস। দারিদ্র্যের প্রভাবে তাঁর মুখের কথা এবং লেখার বাণী ক্ষুরধার তরবারির মতো শানিত হয়ে ওঠে। দরিদ্র মানুষেরা নির্ভীকভাবে সত্য কথা উচ্চারণ করতে পারেন, তারা ন্যায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। তাদের কোনো পিছুটান থাকে না। কিন্তু যাদের ধনসম্পদ বেশি থাকে, তারা প্রতিষ্ঠানবিরোধী সংগ্রামে শরিক হতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জমিদার নন্দন-ধনবান ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-জোতদাররা অংশগ্রহণ করেননি বলেই চলে। কারণ, তাদের ধনসম্পদ এবং আয়েশি জীবনের পিছুটান ছিল। কিন্তু ছাত্র-কৃষক-দিনমজুরের সেই পিছুটান ছিল না। তাই সেসব সংগ্রামে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপকভাবে বেশি। এভাবে দারিদ্র্য মানুষকে ব্যক্তিগত পিছুটান ফেলে মহত্তর ও বৃহত্তর কাজে শরিক হওয়ার প্রণোদনা দান করে, প্রেরণা জোগায়। নজরুল তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতার শুরুতেই তাই বলেছেন– ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান।/ তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান/ কণ্টক-মুকুট শোভা!– দিয়াছ, তাপস,/ অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;/ উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,’। এই প্রশংসার ভেতরেই দারিদ্র্যের নেতিবাচক দিক স্পষ্ট। ‘কণ্টক-মুকুট’ কিন্তু রাজার মুকুটের মতো পুষ্পশয্যার সুখ দেয় না, তার কাজ নিত্য যন্ত্রণাদান। আর বীণা যখন শাপে তরবারি হয়ে যায়, তখন যুদ্ধ করাই হয়ে ওঠে নির্মম নিয়তি। যাকে সারাজীবন যুদ্ধ করতে হয়, তার জীবন হয় আঘাতের ও রক্তপাতের, বিশ্রামহীনতার ও স্বস্তিহীনতার। সে জীবনে সুখ থাকে না।
প্রতিটি পিতামাতা চান তাদের সন্তান যেন দুধেভাতে থাকে কিন্তু দুধভাত সংগ্রহে রাখার সামর্থ্য গরিব মানুষের থাকে না। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। একজন অনাহারক্লিষ্ট অর্থাৎ দারিদ্র্যপীড়িত মা তাঁর দুধের শিশুকে বুকের দুধ দিতেও ব্যর্থ হন। কারণ, খাদ্যের অভাবে শীর্ণ-জীর্ণ শরীরে বুকের স্তনে মাতৃদুগ্ধ সঞ্চিত হয় না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক জ নজর ল ইসল ম নজর ল
এছাড়াও পড়ুন:
মালির সম্রাটের মহাকাব্যিক হজ সফর
চতুর্দশ শতাব্দীর মালি সাম্রাজ্যের সম্রাট মানসা মুসার হজযাত্রা (১৩২৪-২৫) একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই যাত্রা শুধু মালি সাম্রাজ্যের ধনসম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রকাশই ঘটায়নি, বরং পশ্চিম আফ্রিকার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। মানসা মুসার এই হজ তাঁকে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে সুপরিচিত করে এবং মালিকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে।
‘মানসা’ শব্দটি স্থানীয় ভাষায় সম্রাট বা সুলতান বোঝায় এবং মানসা মুসার পুরো নাম ছিল ‘মুসা কিতা’। ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী মুসা ১৩১২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে মালি সাম্রাজ্যের শাসক হন। তিনি তাঁর সময়ের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং সম্রাট হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁর ধনসম্পদের মূল উৎস ছিল স্বর্ণ ও খনিজ লবণের বাণিজ্য। তৎকালীন বিশ্বের স্বর্ণ ও লবণের অর্ধেকই মালি সাম্রাজ্য থেকে আহরিত হতো এবং মানসা মুসা এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে অগাধ সম্পদের মালিক হন। তিনি প্রথম আফ্রিকান শাসক ছিলেন, যিনি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁর উপাধির মধ্যে ছিল ‘প্রথম মুসা’, ‘মালির আমির’, ‘ওয়াংগারা খনির সম্রাট’, ‘কনকান মুসা’, ‘মালির সিংহ’ ইত্যাদি।
মানসা মুসা একজন ধার্মিক মুসলমান ছিলেন এবং তাঁর হজযাত্রার পেছনে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় উদ্দেশ্য ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, দুটি প্রধান কারণ ছিল:
আরও পড়ুনবদর যুদ্ধক্ষেত্রে একটি দিন১৯ এপ্রিল ২০২২মানসা মুসা ভুলবশত তাঁর মাকে হত্যা করেছিলেন, যার জন্য তিনি গভীর অনুশোচনায় ভুগতেন। প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তিনি ব্যাপক দান করতেন এবং সারা বছর রোজা রাখতেন। তবু মানসিক শান্তি না পেয়ে তিনি আলেমদের পরামর্শে হজ পালনের সিদ্ধান্ত নেন। আলেমগণ তাঁকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা পরিদর্শনের পরামর্শ দেন, যাতে তিনি ক্ষমা পান।
এ ছাড়া মানসা মুসা তাঁর হজযাত্রার মাধ্যমে মালি সাম্রাজ্যের ধনসম্পদ ও শক্তি বিশ্বের কাছে প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জোট গঠন এবং মালিকে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান দেওয়াও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল।
১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে মানসা মুসা মালি থেকে মক্কার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় তিনি একটি বিশাল কাফেলা নিয়ে রওনা হন, যা ইতিহাসে তাঁর সমৃদ্ধি ও মহানুভবতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। তাঁর কাফেলায় ছিল প্রায় ৬০ হাজার পুরুষ ও নারী, যার মধ্যে ১২ হাজার ক্রীতদাস ছিল। তাঁর প্রথম স্ত্রী, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং সরকারি কর্মকর্তারাও সফরসঙ্গী ছিলেন। ধনসম্পদ ছিল অঢেল। ৮০টি উটে ৩০০ পাউন্ড ওজনের স্বর্ণ বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ছাড়া ছিল ৫০০ ক্রীতদাস, যারা স্বর্ণমুদ্রা, স্বর্ণখণ্ড, খনিজ লবণ এবং মূল্যবান মণিরত্ন বহন করছিল।
যাত্রাপথে মানসা মুসা গরিব ও দরিদ্রদের অর্থ, খাদ্য ও বস্ত্র দান করেন। শহরের শাসকদের প্রচুর স্বর্ণ উপহার দেন এবং বিভিন্ন স্মারক ক্রয় করেন। তিনি প্রতি শুক্রবার একটি করে মসজিদ নির্মাণ করেন।
আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫কাফেলাটি সাহারা মরুভূমি অতিক্রম করে মিসরের কায়রোতে পৌঁছায়। সেখানে তাঁর সম্পদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং বণিকেরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। মানসা মুসা এত বেশি স্বর্ণ ব্যয় করেন যে মিসরের বাজারে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় এবং অর্থনীতিতে ধস নামে। ফেরার পথে তিনি উচ্চ সুদে স্বর্ণ ধার করে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন, তবে মিসরের স্বর্ণের বাজার স্বাভাবিক হতে প্রায় এক দশক লাগে।
মক্কায় পৌঁছে মানসা মুসা হজ পালন করেন। মক্কার জ্ঞানবিজ্ঞানের সমৃদ্ধি তাঁকে মুগ্ধ করে। ফেরার সময় তিনি চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস, গণিত ও আইনের বই, সেই সঙ্গে মক্কার শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও স্থপতিদের সঙ্গে নিয়ে আসেন। এই স্থপতিরা মালিতে পোড়া ইট দিয়ে পাঁচটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা ইসলাম প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মানসা মুসার হজযাত্রা মালি সাম্রাজ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার ওপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। যেমন এই যাত্রা ইসলামকে পশ্চিম আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়। মানসা মুসা তাঁর শাসনপদ্ধতিতে ইসলামিক নীতি ও সংস্কৃতি প্রবর্তন করেন, যা শিক্ষা ও বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে।
মালির শহরগুলোতে নতুন স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণকৌশল প্রবর্তিত হয়, যা পশ্চিম সুদানে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে ছিল সাংকোরে মাদ্রাসা (ইউনিভার্সিটি অব সাংকোরে), হল অডিয়েন্স এবং গ্র্যান্ড প্যালেস। মানসা মুসা মরক্কোর মারাকেচ, মিসরের কায়রো ও আন্দালুসিয়ার টোলেডোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি তিউনিস ও মিসরের সঙ্গে মালির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরে টিম্বাক্টু ও গাওকে তিনি জ্ঞানবিজ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়। সাংকোরে মাদ্রাসা বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে।
মানসা মুসার সম্পদ ও খ্যাতি মালিকে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান দেয়। কার্টোগ্রাফার অ্যাঞ্জেলিন ডুলসার্ট তাঁর প্রতিকৃতি মানচিত্রে অঙ্কন করেন এবং বিখ্যাত কাতালান অ্যাটলাস-এ তাঁকে স্বর্ণখণ্ড ও রাজদণ্ড হাতে সাহারার মধ্যবিন্দুতে চিত্রিত করা হয়।
(সূত্র: পুণ্যপথের যাত্রীরা: হজ হজযাত্রী ও পথ,মুহাম্মদ সাঈদ হাসান শিকদার, প্রথমা প্রকাশন)
আরও পড়ুনঅতি মূল্যবান ও পবিত্র হাজরে আসওয়াদ১০ জুন ২০২৩