গ্রীষ্মের শুরু থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি বেশি ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। বৃষ্টি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশক নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা ও স্বাস্থ্য খাতের দূরবস্থাকে দায়ী করছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১৫ জন। এ নিয়ে চলতি বছর মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৭২ জনে। যদিও গত একদিনে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি, তবে চিকিৎসকরা বলছেন, এটি বর্ষার আগমুহূর্তের শান্ত ঝড়ের পূর্বাভাস হতে পারে।

ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকায় আক্রান্তের হার ক্রমেই বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগে আক্রান্ত হয়েছেন সর্বোচ্চ ৬৮ জন, যা দেশের মোট নতুন আক্রান্তের প্রায় ৬০ শতাংশ। চট্টগ্রামে আক্রান্ত ২২ জন, অথচ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে আক্রান্ত মাত্র ৮ ও ১২ জন। রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহেও অল্প সংখ্যক রোগী শনাক্ত হলেও এর মধ্যেই স্থানীয় জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক ডা.

মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “গত বছরও আমরা শুরুতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভেবেছিলাম। কিন্তু জুন-জুলাইতেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নেয়। এ বছরও তার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা প্রবল।”

জুন-জুলাইয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশনগুলোর প্রস্তুতি সীমিত। স্থানীয় পর্যায়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, গৃহস্থালি পানির পাত্র ব্যবস্থাপনা এবং জনগণকে সচেতন করার কাজ দ্রুত শুরু না করলে জুন-জুলাইয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।” 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, মে মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৩ জন। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্রামাঞ্চলের অনেক মৃত্যুই রিপোর্ট হয় না বা ডেঙ্গু বলে চিহ্নিত হয় না। ফলে প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে।

২০২৪ সালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ‍সৃষ্টি হয়। সারা বছর আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং প্রাণ হারান ৫৭৫ জন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ঢাকায়, যেখানে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ওপর চাপ ছিল ভয়াবহ। বিগত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও এ বছরের শুরুতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

স্বাস্থ্য বিশ্লেষক ডা. তাসনুভা রহমান বলেন, “ডেঙ্গুর অনেক উপসর্গ এখন অন্যান্য ভাইরাল জ্বরের সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে শনাক্তে দেরি হচ্ছে। সরকারকে উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট ও প্রশিক্ষিত মেডিকেল স্টাফ জরুরিভাবে দিতে হবে। না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ জটিল হয়ে যেতে পারে।” 

পরিসংখ্যান বলছে, আক্রান্তদের ৬০.১ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৯.৯ শতাংশ নারী। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কর্মস্থলে যাতায়াত ও বাইরের কাজের জন্য পুরুষদের আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। তবে ঘরোয়া পর্যায়ে মশা নিয়ন্ত্রণ না থাকলে নারী ও শিশুরাও ঝুঁকির বাইরে নয়।

পরিবেশবিদ ড. মাহমুদ হাসান বলেন, “মশা নিধনে কেবল ওষুধ ছিটানো যথেষ্ট নয়। নগর পরিকল্পনায় খোলা ড্রেন, নির্মাণাধীন ভবন ও পরিত্যক্ত স্থাপনার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থানীয় সম্মানিত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে মাসিক অভিযান জরুরি।”

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কর্মী রাহাত হোসেন   বলেন, “প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ওষুধ ছিটানো হয়, কিন্তু জনবল ও সরঞ্জামের অভাবে কাজ কার্যকর হয় না। অনেকেই আবার ঘরে ওষুধ ছিটাতে দিতে রাজি হন না। সচেতনতাই মূল অস্ত্র। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আন্দোলনের কারণে ঠিকমতে ওষুধ পাচ্ছি না।”

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুন থেকে নতুন করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু হবে এবং প্রতিটি বিভাগে পর্যাপ্ত কিট, চিকিৎসক এবং ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। তবে জনস্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো মনে করছে, এটি দেরিতে নেওয়া পদক্ষেপ।

ঢাকার যাত্রবাড়ীর বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজ মোহাম্মদ তাকওয়া বলেন, “সামান্য বৃষ্টিও এখন ভয় জাগাচ্ছে নাগরিক মনে। কারণ, প্রতিটি পানির গর্ত হতে পারে মরণব্যাধি ডেঙ্গুর আঁতুড়ঘর। এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তি, পরিবার, স্থানীয় সরকার এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্মিলিত সচেতনতা ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।”

আগে বিচ্ছিন্নভাবে রাখলেও ২০০০ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখছে নিয়মিত। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ড্যাশবোর্ডে দেখা গেছে, এর মধ্যে ২০২৩ সালে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৪৮৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে এক হাজার ৬৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

২০২২ সালে পুরো বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার ৬৩১ জন, মারা গেছেন ২৮১ জন। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ১৬৪ জন, পরের বছর সেটা কমে আসে সাত জনে। ২০২১ সাল থেকে মৃত্যুর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০৫ জনে। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৮১ জন।

ঢাকা/এএএম/ইভা 

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর স থ ত পর য য়

এছাড়াও পড়ুন:

বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে 

বাংলাদেশে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরে ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে দিয়ে দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতিফলন দেখা গেছে।

বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সম্প্রতি যেসব দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে, সেসব দেশে পরবর্তী এক বছরে এফডিআই উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের পর এফডিআই কমেছে ১৯.৪৯ শতাংশ, চিলিতে ২০১৯ সালের পর কমেছে ১৫.৬৮ শতাংশ, সুদানে ২০২১ সালের পর ২৭.৬০ শতাংশ, ইউক্রেনে ২০১৪ সালের পর ৮১.২১ শতাংশ, মিশরে ২০১১ সালের পর ১০৭.৫৫ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালের পর ১৫১.৪৯ শতাংশ কমেছে। এই ধারাবাহিক হ্রাসের মধ্যে বাংলাদেশে এফডিআইর ১৯.১৩ শতাংশ বৃদ্ধির চিত্র বিশেষভাবে নজরকাড়া।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেছেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গুণ হলো—শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অর্থনীতিকে পুনরায় চালু করার অদ্ভুত ক্ষমতা। এই পরিসংখ্যান তার দারুন একটা প্রতিফলন। সাধারণত, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়, কিন্তু আমরা উল্টা দেখছি। সঠিক নীতি নির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার আন্তরিকতা এবং প্রাইভেট সেক্টরের অদম্য স্পৃহা কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। আমরা সব সময় বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। সব সমস্যার সমাধান হয়নি, তবে সদিচ্ছার কোনো ত্রুটি ছিল না। শিগগিই সারা বছরের একটি আমলনামা (রিপোর্ট কার্ড) প্রকাশ করা হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪৮৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ হয় ৯২৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার, তবে ২০২৪ সালে কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৭৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯২ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই ধারা বজায় থাকা অত্যন্ত ইতিবাচক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।

ঢাকা/নাজমুল/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে