বন্যহাতি ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে কোচ সম্প্রদায়। তাদের কেউ কেউ দিনমজুরি, বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ, বাঁশ দিয়ে ডোল, ধারাই ও চাটাই তৈরি করে বিক্রি করে থাকেন। আবার কেউ নিজেদের লাগানো কাসাবা খেয়ে বেঁচে থাকেন। অভাব-অনটনে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করলেও তাদের দিকে বিশেষ নজর নেই কারও। অবহেলিত এ আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক পরিবারের বসবাস নালিতাবাড়ী উপজেলার খলচান্দা গ্রামে। সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩০০।
বারমারী বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে খলচান্দা গ্রামে যেতে হয়। প্রায় ১০০ গজ উত্তরে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। স্বাধীনতার আগে মাত্র চার ঘর কোচ এই গ্রামে বাস করত। এর পর বংশবৃদ্ধি এবং ১৯৭৬ সালে চৌকিদার টিলা গ্রামে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন ও পরে ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প করায় আন্ধারুপাড়া গ্রাম থেকে বেশ কিছু পরিবার এখানে এসে বসতি গড়ে। এই গ্রামের বর্তমান পরিবার সংখ্যা প্রায় ৫২ ঘর। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ এ গ্রামে যেতে চান না। টিলায় ঘেরা গ্রামে দিনদিন জনসংখ্যা বাড়লেও তাদের ভাগ্যের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাসিন্দারা জানান, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা চেল্লাখালী নদী দিয়ে এক সময় ভারত থেকে ভেসে আসত অসংখ্য বড় মূল্যবান গাছ। সে গাছ নদী থেকে তুলে এনে বিক্রি করে এবং পাহাড়ের সমতল জমিতে ধান চাষ করে ভালোই চলত খলচন্দা গ্রামের কোচদের সংসার। এসব দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। তাদের মূল পেশা কৃষিকাজ হলেও পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ায় জমি সংকট এবং কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই সেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিনমজুর, কেউবা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নানা পেশায় যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঘরে বসে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকেই।
গ্রামটিতে কোনো পাকা সড়ক নেই। যাতায়াতের সড়কটি বেহাল। শুষ্ক মৌসুমে সড়ক ধুলোময় হয়ে থাকে। বর্ষায় চলাচল সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে যায়। এ ছাড়া গ্রামে একটি মাত্র প্রাকপ্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এই গ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার হার নাজুক। স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও একই। কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পায় না কোচ পরিবারগুলো। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তিন কিলোমিটার দূরে বারোমারি খ্রিষ্টান পল্লীর দাতব্য হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়। মুমূর্ষু রোগীকে ডাক্তার দেখাতে বা চিকিৎসা নিতে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলা সদরে অথবা ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদর হাসপাতালে যেতে হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছায়নি খলচান্দা গ্রামে। আজও আঁধার কাটেনি কোচদের– এমনটিই বলছেন স্থানীয়রা।
খলচান্দা গ্রামের মায়াদেবী কোচ বলেন, ‘আমগর সড়কটা দিয়ে শান্তি মতো যাওন যায় না। আধা মাইল দূর থাইকা দুই বেলা পানি আইনা চলি। এতে আমগর বিরাট কষ্ট অয়। মেঘ (বৃষ্টি) অইলে সড়কা দিয়া হাঁটন যায় না। সরকার যদি আমগরে গ্রামে বেশ কয়ডা টিউবওয়েলের ব্যবস্থা কইরা দিত, বিরাট উপকার অইত।’
বৃদ্ধ রুক্কিনী কোচ জানান, তাঁর বাবার বাড়ি পাশের সমেশ্চুরা গ্রামে। দেশ স্বাধীনের আগে এই গ্রামে বিয়ে হয় তাঁর। এক সময় পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা ছিল। পাহাড় থেকে মরা কাঠ সংগ্রহ আর গাছ থেকে বিভিন্ন ফল পেড়ে খেতেন তারা। অনেক পশুপাখিও ছিল, কিন্তু এখন এই পাহাড়ে আর আগের মতো গাছও নেই, তাদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
গ্রামের রমেশ কোচ ও পরমেশ্বর কোচের ভাষ্য, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের গ্রামের মাত্র তিনজন কোচ সরকারি চাকরি পেয়েছেন। এর মধ্যে বিজিবিতে কর্মরত একজন অনেক আগে মারা গেছেন। অভাব-অনটন আর যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় এই গ্রামের কোচ উপজাতিরা শিক্ষায় এগোতে পারছেন না।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, মাঝে মধ্যেই বন্যহাতি হানা দেয় এই গ্রামে। গাছের কাঁঠাল ও ক্ষেতের ধান পাকার মৌসুমে বন্যহাতির পাল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। এ সময় হাতির পাল কাঁঠাল, ক্ষেতের ধান খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে দেয়। বাড়িঘরও ভেঙে তছনছ করে ফেলে। তখন এই অসহায় কোচদের টিন পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, ডাকচিৎকার ও হৈহুল্লোড় করে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। তাদের ভালো-মন্দের খবর কেউ রাখে না। জনপ্রতিনিধিরা শুধু নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে আসেন। তাদের পদচারণায় কোচপল্লী তখন মুখর হলেও নির্বাচনের পর তাদের খবর রাখে না কেউ।
স্থানীয় চেয়ারম্যান হাজী জামাল উদ্দিন বলেন, খলচান্দার কোচপাড়া যাওয়ার রাস্তাটার জন্যই অনেক পিছিয়ে আছে কোচ সম্প্রদায়ের লোকগুলো। বিশেষ করে অনিরাপদ রাস্তার জন্য শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তারা। রাস্তা ও স্কুলের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ফুটপাত দখল করে ঘেরের বাঁধ আ.লীগ ও জামায়াত নেতার
যশোরের মনিরামপুরে ব্যস্ত একটি পাকা সড়কের পাশের ফুটপাত দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার নেহালপুর-আলীপুর-পোড়াডাঙ্গা সড়কের আলীপুরে এই কাজ করেছেন স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী দুই রাজনীতিবিদ। এদের একজন আওয়ামী লীগের, অন্যজন জামায়াতে ইসলামীর নেতা। তারা মাছের ঘেরের বাঁধ তৈরি করেছেন সড়কের ফুটপাতে। যদিও এলাকাবাসীর তোপের মুখে কিছু অংশ থেকে সম্প্রতি মাটি সরিয়ে নেন তারা।
এলাকাবাসী জানিয়েছে, মাছের ঘেরটির অংশীদারদের একজন কামরুজ্জামান। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্য। তাঁর অন্য অংশীদার হলেন– ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামী টিম সদস্য খিদির হাসান।
নেহালপুর বাজারের উত্তরপাশ দিয়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ পিচ ঢালাই করা সড়কটি আলিপুর হয়ে কুলটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে পোড়াডাঙ্গায় গিয়ে মিশেছে। নেহালপুর থেকে সড়কের দু’পাশে পাঁচ-সাত ফুট জায়গা রাখা হয়েছে পথচারীদের চলাফেরা ও যানবাহন ক্রসিংয়ের জন্য। শনিবার সকালে আলীপুর এলাকার পশ্চিমপাশে দেখা গেছে, সড়কটির প্রায় আধা কিলোমিটার ফুটপাত দখল করে উঁচু বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। পাশেই প্রায় শত বিঘা জমি ইজারা নিয়ে গড়ে তোলা মাছের ঘের। এটির অংশীদার কামরুজ্জামান ও খিদির হাসান।
যেখানে বাঁধ দেওয়া হয়েছে পাশেই গাবরডাঙ্গা সার্বজনীন পূজা মন্দির ও আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ফুটপাত দখল করায় শিক্ষার্থীসহ পথচারীদের যাতায়াতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। সরু সড়কে উল্টো দিক থেকে আসা যানবাহন ক্রসিং করতেও ঝুঁকি বাড়ছে।
আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমতা রানী ঘোষের ভাষ্য, ব্যস্ততম সড়কের ফুটপাতটি দখলের কারণে জনসাধারণের চলাচলে সমস্যা তো হচ্ছে। জনস্বার্থে যে কোনো মূল্যে এ বাঁধ অপসারণ করা উচিত বলে মনে করেন কুলটিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হামিদুল ইসলাম।
ঘেরমালিক আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামানের ভাষ্য, ‘জামায়াত নেতা খিদির হাসানসহ বেশ কয়েকজন মিলে ঘের করেছি। কিন্তু সড়কের পাশে পরিত্যক্ত জমির সামান্য অংশে বাঁধটি নির্মাণ করা হয়।’ জামায়াত নেতা খিদির হাসানের দাবি, এলাকাবাসীর অনুরোধে বাঁধটি কিছু দূরে সরিয়ে নিয়েছেন।
সড়কের পাশে সাত ফুট চওড়া হাঁটার পথ ছিল। এর মধ্যে দখল করা হয়েছে অন্তত পাঁচ ফুট। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সদুত্তর দেননি দুই নেতার কেউই। আর কুলটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখর চন্দ্র রায় বলেন, সড়কের পাশে কমপক্ষে পাঁচ-সাত ফুট জায়গা থাকার কথা। এখানে রাখা হয়েছে খুবই সামান্য। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তবে সড়কের পাশের ফুটপাত এভাবে
দখলের বিষয় জানা নেই মনিরামপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিয়াজ মাখদুমের। তিনি বলেন, অভিযোগ পেলে দ্রুতই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।