বর্তমানে ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থান করছেন রুশ পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ অ্যাডলান মারগোয়েভ। ব্রিক্স সম্পর্কিত এক সম্মেলনে অংশ নিতে তিনিসহ আরও কয়েকজন রুশ বিশেষজ্ঞ তেহরানে গিয়েছিলেন। এরই মধ্যে শহরটিতে ইসরায়েল হামলা শুরু করে। এর পর ইরান পাল্টা জবাব দিলে কলেবর বাড়ে হামলা-পাল্টা হামলায়। এতে ইরানে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানের বাসিন্দাদের শহরটি খালি করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তবে তেহরানের পরিস্থিতি কেমন, সেখানকার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনেইবা কী প্রভাব পড়েছে এ হামলায়– এসব বিষয়ে মস্কোভিত্তিক পত্রিকা কমের্সান্তের বিশেষ প্রতিবেদক এলিনা চেরনেনকোর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন অ্যাডলান মারগোয়েভ। তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আরটি ইন্টারন্যাশনাল। সমকালের পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন আসিফ মাহমুদ।
এলিনা চেরনেনকো: আপনি ও আপনার সঙ্গী কয়েক রুশ বিশেষজ্ঞ এখন তেহরানে আছেন। আপনারা কী করছেন?
অ্যাডলান মারগোয়েভ: আমরা ব্রিক্স ও রাশিয়া-ইরান কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে একটি যৌথ সম্মেলনে অংশ নিতে এসেছি।
এলিনা: ইসরায়েলের ইরানে হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে আপনাদের কি জানা ছিল? আপনারা কি বিপদের আশঙ্কা করছিলেন?
অ্যাডলান: না, সবকিছু স্বাভাবিক ছিল এবং রয়েছে। ইরানিরা যে কোনো মুহূর্তে হামলা বা নাশকতা হতে পারে– এমন মানসিকতার সঙ্গে অভ্যস্ত।
আমাদের সম্মেলনের এক ইরানি অংশগ্রহণকারী বলেছেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই করেছি। তাই এ হামলা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়।’ সাধারণভাবে বললে, ইরানিরা বন্ধুত্বপূর্ণ ও শান্ত রয়েছে। আমরা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কাজ চালাচ্ছি।
এলিনা: আপনারা কোথায় আছেন?
অ্যাডলান: আমরা উত্তর-পশ্চিম তেহরানে একটা হোটেলে আছি। এখানে সম্মেলন হচ্ছে এবং আজও (গতকাল মঙ্গলবার) চলবে।
এলিনা: পরিস্থিতি কি আগের মতোই?
অ্যাডলান: হ্যাঁ, প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। শুধু আজ রাতের (সোমবার) একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে।
এলিনা: হামলার রাতে কী হয়েছিল?
অ্যাডলান: হামলা শুরুর সময়ে আমরা ঘুমাচ্ছিলাম। আমাদের প্রতিনিধি দলের নেতা রাত ৩টার দিকে বিস্ফোরণের শব্দ ও আকাশ প্রতিরক্ষার কার্যক্রম টের পান। দ্বিতীয় দফায় হামলা হয় সকাল ৬টার দিকে। বলাই যায়, ওই সময় সবাই জেগে গিয়েছিল। কী হচ্ছে, আমরা সে বিষয়ে খবর ও তথ্য খুঁজতে শুরু করি। অন্য সব তথ্যের সঙ্গে জানতে পেরেছি, আকাশপথ বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের ফেরার বিমানের তারিখ রোববার নির্ধারিত রয়েছে।
এলিনা: আপনারা কি চলমান অস্থিরতায় স্থলপথে দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন?
অ্যাডলান: না, সেটা অযথাই আতঙ্ক সৃষ্টি করবে।
এলিনা: অর্থাৎ, আপনাদের বা ওখানকার অন্য কারও মধ্যেও আতঙ্ক নেই?
অ্যাডলান: যা দেখছি, ও যা মনে হচ্ছে, তাই বলছি, সত্যিই আতঙ্ক নেই।
এলিনা: তার পরও পরিস্থিতির যে গুরুতর অবনতি হয়েছে, এটা কি বলা যায়?
অ্যাডলান: অনেক বেশি গুরুতর। কারণ, এ হামলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে চালানো হয়েছে। এপ্রিল থেকে চলা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার পরবর্তী দফা রোববার ওমানে হওয়ার কথা ছিল। আমার মনে হচ্ছে, এখন সে আলোচনা অনিশ্চিত হয়ে গেল।
এলিনা: মার্কিন কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী মনে হচ্ছে, ওয়াশিংটন এই হামলা সম্পর্কে জানত।
অ্যাডলান: না, তারা জানত কিনা বলা মুশকিল। কিন্তু তারা সম্ভাব্য ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল। যেমন– কূটনৈতিক কর্মীদের সতর্ক করা।
এলিনা : ইরান কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে বলে আপনারা মনে করছেন?
অ্যাডলান: সম্প্রতি শুনেছি, ইরান এবার ২০২৪ সালের ‘ট্রু প্রমিস’ অভিযান বা ২০২৪ সালের অপর হামলাগুলোর মতো সংযত পদক্ষেপ নেবে না।
এলিনা: ইরান বলেছে, যদি ইসরায়েল আবার হামলা করে, তবে তারা মধ্যপ্রাচ্যে থাকা মার্কিন ঘাঁটিতেও হামলা চালাতে পারে। আপনারা কি মনে করেন, ইরান কি এমন করবে?
অ্যাডলান: ভালো প্রশ্ন। ইরান চাইবে না যুক্তরাষ্ট্রও এই লড়াইয়ে জড়িয়ে যাক। তাই মনে হচ্ছে, ওরা সমুচিত জবাব দিলেও সরাসরি মার্কিন ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাবে না। আঞ্চলিক যুদ্ধ এড়াতে চাইলে ইসরায়েলকে একটা জোরালো জবাব দিতে চাইবে ইরান। কিন্তু সেটি ওয়াশিংটনকে যুদ্ধে জড়ানোর কারণ হতে পারবে না।
এলিনা: সম্প্রতি রাশিয়া ও ইরান একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। সেখানে অপর পক্ষের ওপর হামলা হলে হস্তক্ষেপ করার অঙ্গীকার নেই, তার পরও দু’দেশই ঘনিষ্ঠ অংশীদার। এই হামলায় রাশিয়া কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে বলে আপনারা মনে করেন?
অ্যাডলান: প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে যা বলেছে ও যা মনে হচ্ছে তা হলো, ইরান চাচ্ছে রাশিয়া ও চীন আন্তর্জাতিক অঙ্গনগুলোতে, যেমন নিরাপত্তা পরিষদ ও আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি কমিশনে এ ঘটনার নিন্দা করুক। অন্যদিকে, সামরিক ও কারিগরি বিষয় যেমন নতুন নতুন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও বাড়ানোয় আগ্রহী হবে দু’পক্ষ। তবে এসব বিষয় প্রকাশের সম্ভাবনা খুবই কম।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল পর স থ ত প রক শ আম দ র আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
ভুলে যাবেন না, শরীরচর্চা একটি সুন্নত
খেলাধুলা ও শারীরিক ব্যায়াম আধুনিক জীবনে প্রায়ই অবহেলিত হয়, বিশেষ করে ব্যস্ততার কারণে। কিন্তু ইসলামে খেলাধুলার একটি গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, যা নবীজি (সা.)-এর জীবন থেকে শুরু হয়েছে। তিনি নিজে বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ নিয়েছিলেন এবং এর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উপকারিতার কথা উল্লেখ করেছেন।
শরীরচর্চার আধ্যাত্মিক উপকারিতাশরীরচর্চা ইসলামে একটি ভুলে যাওয়া সুন্নাহ, যা আমাদের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ করে। এটি আমাদের মনোযোগ ও স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়, সম্প্রদায়ের বন্ধন জোরদার করে এবং হারাম থেকে দূরে রাখে। যেমন:
দুটি নিয়ামত এমন আছে, যার প্রতি অনেক মানুষ প্রতারিত হয়: স্বাস্থ্য ও অবসর সময়।সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬,৪১২১. মনোযোগ ও অবিচলতা গড়ে তোলে
ইসলাম আমাদের নিজেকে উন্নত করতে ও পরকালে উত্তম স্থান অর্জনের জন্য সংগ্রাম করতে শেখায়। শরীরচর্চা এই প্রক্রিয়ায় সহায়ক; কারণ, এটি মনোযোগ, সংগ্রাম এবং ধৈর্যের মাধ্যমে আমাদের মন ও শরীরকে শক্তিশালী করে।
শারীরিক ব্যায়ামের সময় আমরা যখন মাত্রা অতিক্রম করে যাই, তখন তাৎক্ষণিক আরাম ত্যাগ করে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানসিক শক্তি অর্জন হয়।
আরও পড়ুনউত্তম ব্যবসায়ী হওয়ার নববি কৌশল০৯ জুন ২০২৫২. সমাজের শক্তি বৃদ্ধি করে
ইসলামে সামাজিক ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই এক উম্মাহর অংশ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই এই যে তোমাদের উম্মাহ, এটা তো একই উম্মাহ, আর আমি তোমাদের রব, অতএব আমার ইবাদত করো।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৯২)
জুমার নামাজ, হজের মতো ইবাদত আমাদের সম্প্রদায়ের বন্ধনকে শক্তিশালী করে।
দলগত খেলাধুলা বা ব্যায়াম অনুশলীন এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে। সাইক্লিং, দৌড় বা সাঁতারের মতো সামাজিক আয়োজনের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করে এবং যোগাযোগ, দলগত কাজ ও স্থিতিস্থাপকতার দক্ষতা বৃদ্ধি করে। এটি ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৩. হারাম থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়
আধুনিক সমাজে হারাম ক্রিয়াকলাপ—যেমন মদ্যপান, অবৈধ সম্পর্ক, জুয়া বা অনৈতিক কনটেন্ট—সহজলভ্য। এই প্রলোভনগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখা, বিশেষ করে তরুণদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিয়মিত শরীরচর্চা আমাদের সময় ও শক্তিকে ইতিবাচক কাজে লাগাতে সাহায্য করে। জিমে শরীরচর্চা বা মাঠে শারীরিক প্রশিক্ষণ আমাদের মনকে হারাম থেকে দূরে রাখে এবং দ্বীনের প্রতি নিবেদিত রাখে।
সাইক্লিং, দৌড় বা সাঁতারের মতো সামাজিক আয়োজনের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করে এবং যোগাযোগ, দলগত কাজ ও স্থিতিস্থাপকতার দক্ষতা বৃদ্ধি করে।নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দুটি নিয়ামত এমন আছে, যার প্রতি অনেক মানুষ প্রতারিত হয়: স্বাস্থ্য ও অবসর সময়।’ (সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬,৪১২)
শরীরচর্চা আমাদের স্বাস্থ্য ও সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করে, যা আমাদের দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্য কল্যাণকর।
আরও পড়ুনযে ৪টি পরীক্ষা নবীজি (সা.)–এর জীবনকে দৃঢ়তা দিয়েছে২২ জুলাই ২০২৫হাদিসে উল্লিখিত খেলাধুলানবীজি (সা.)-এর জীবনে খেলাধুলার গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য। তিনি নিজে বিভিন্ন শারীরিক কসরতের মতো খেলায় অংশ নিয়েছিলেন এবং এর প্রশংসা করেছেন। কিছু উল্লেখযোগ্য খেলা হলো:
দৌড়: হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি নবী (সা.)-এর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে দৌড় দিয়েছিলাম এবং তাঁকে হারিয়েছিলাম। পরে যখন আমার ওজন বেড়ে গেল, তিনি আমাকে হারিয়েছিলেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২,৫৭৮)
বোঝা যায়, শুধু পুরুষ নয়, নারীদের জন্যও এ ধরনের খেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শরীরচর্চা করা অনুমোদিত।
তিরন্দাজি: নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তিরন্দাজি অনুশীলন করো, কারণ এটি তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৯১৭)
তিরন্দাজি শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা বাড়ায়।
আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে দৌড় দিয়েছিলাম এবং তাঁকে হারিয়েছিলাম। পরে যখন আমার ওজন বেড়ে গেল, তিনি আমাকে হারিয়েছিলেন।হজরত আয়েশা (রা.), সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২,৫৭৮ঘোড়দৌড়: নবীজি (সা.) ঘোড়দৌড়ের প্রশংসা করেছেন এবং এতে অংশগ্রহণকারীদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন। (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৩,৫৮৫)
সাঁতার: নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের সাঁতার, তিরন্দাজি এবং ঘোড়সওয়ারি শেখাও।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৬,৫৮২)
কুস্তি: নবীজি (সা.) একবার নিজেই রুকানা নামক একজন ব্যক্তির সঙ্গে কুস্তি লড়েছিলেন এবং তাঁকে পরাজিত করেছিলেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,০৭৮)
এই হাদিসগুলো প্রমাণ করে যে খেলাধুলা শুধু শারীরিকভাবে উপকারী নয়, বরং এটি সুন্নাহের একটি অংশ। নবীজির (সা.) জীবন আমাদের জন্য অনুকরণীয়। আধুনিক বিশ্বে যেখানে সামাজিক বিভেদ ও হারামের প্রলোভন আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে, সেখানে এই খেলাধুলা ও শরীরচর্চা আমাদের দ্বীন ও সমাজকে শক্তিশালী করতে পারে।
আরও পড়ুনসুস্থ জীবনের জন্য নবীজি (সা.)–এর কয়েকটি সুন্নাহ২৯ জুন ২০২৫