প্রাথমিক শিক্ষা: জাতির ভিত্তি গঠনের প্রথম ধাপ
Published: 13th, July 2025 GMT
একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার শিশুদের ওপর। আর সেই ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। এটি শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও নৈতিক বিকাশের ভিত্তি তৈরি করে। শুধু সাক্ষরতা অর্জন নয়, একজন সচেতন, মূল্যবোধসম্পন্ন ও কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার গোড়াপত্তন হয় এই পর্যায়েই।
বাংলাদেশে শিক্ষা এখন মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। সরকার ‘প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক’ ঘোষণা করেছে এবং এই খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। বর্তমানে প্রায় শতভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, শতভাগ পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে এবং উপবৃত্তি ও মিড-ডে মিল কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বাড়ানো হচ্ছে। তবুও মানসম্মত শিক্ষা এবং ঝরে পড়া রোধ এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক উদাহরণগুলো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারে।
ফিনল্যান্ড, বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম প্রশংসিত শিক্ষা ব্যবস্থার অধিকারী। সেখানে শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষায় পরীক্ষা বা র্যাঙ্কিংয়ের চাপ ছাড়াই শেখে। বিদ্যালয়গুলোকে আনন্দদায়ক ও শেখার উপযোগী পরিবেশে রূপ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকতাকে সেখানে সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জাপানে শিশুদের প্রথম ছয় বছরে মূলত শৃঙ্খলা, সৌজন্য, সম্মান ও সামাজিক আচরণ শেখানো হয়। ‘শিক্ষা মানেই শুধু বই মুখস্থ করা নয়’—এই চিন্তাকে তারা বাস্তবায়ন করেছে সমাজজীবনের প্রাথমিক ধাপেই।
দক্ষিণ কোরিয়া শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে ১৯৬০-এর দশকের পর দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে সবার জন্য সহজলভ্য এবং মানসম্মত করার মাধ্যমে তারা প্রযুক্তিনির্ভর মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পেরেছে।
অন্যদিকে, ব্রাজিল দারিদ্র্য-পীড়িত এলাকায় শিক্ষা নিশ্চিত করতে চালু করে Bolsa Família কর্মসূচি—যেখানে দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়, যদি তারা নিয়মিত সন্তানদের স্কুলে পাঠায়। এতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ও উপস্থিতি অনেক বেড়েছে।
সিঙ্গাপুর শিক্ষক প্রশিক্ষণকে কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। সেখানে শিক্ষক নিয়োগ হয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে, এবং নিয়োগপ্রাপ্তদের উচ্চমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হয়েছে।
বাংলাদেশেও কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি সত্ত্বেও বেশ কিছু জায়গায় কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন—গ্রামীণ ও শহরের মধ্যে মানের বৈষম্য এবং পাঠদান পদ্ধতির দুর্বলতা। এছাড়া, শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। এটি সমাধানে শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নয়, সমাজের সামগ্রিক অংশগ্রহণ প্রয়োজন। শিশুদের স্কুলমুখী করতে স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও, মিডিয়া এবং অভিভাবকদের একযোগে কাজ করতে হবে।
এখানে আরও একটি বিষয় জরুরি—বিদ্যালয়কে শিশুর জন্য ‘আকর্ষণীয় স্থান’ হিসেবে তৈরি করা। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও খেলাধুলা, শিল্প-সংস্কৃতি, লাইব্রেরি এবং কমিউনিটি ইনভলভমেন্ট জরুরি।
আমরা যদি জাতিকে দক্ষ, মানবিক, মূল্যবোধসম্পন্ন ও উদ্ভাবনী শক্তিতে ভরপুর করে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে প্রাথমিক শিক্ষাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। উন্নত বিশ্বের শিক্ষা কাঠামো থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে, আমাদের প্রেক্ষাপটে উপযোগী করে মানসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আনন্দময় প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তির সাধক ছিলেন লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী’
লেখক, প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ মোতাহের হোসেন চৌধুরী সারা জীবন মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার চর্চা করে গেছেন। প্রকৃত মানবতাবাদী দার্শনিক ছিলেন তিনি। এ কারণে তাঁর লেখা, সৃষ্টিকর্ম ও চিন্তা এখনকার মানুষের জন্যও সমান প্রাসঙ্গিক।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ৬৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণসভায় বক্তারা এ কথা বলেন। লেখকের নিজ জেলা লক্ষ্মীপুরে তাঁকে নিয়ে প্রথম স্মরণসভা ছিল এটি।
রামগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত এ স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম রবিন শীষ। প্রধান অতিথি ছিলেন লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার। বক্তব্য দেন প্রবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক ড. কুদরত-ই-হুদা, যুগান্তরের সাহিত্য সম্পাদক কবি জুননু রাইন, লেখকপুত্র ক্যাপ্টেন সৈয়দ জাহিদ হোসাইন, লক্ষ্মীপুর সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক গাজী গিয়াস উদ্দিন।
জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার তাঁর বক্তব্যে বলেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী ছিলেন বাংলার একজন উজ্জ্বল প্রাবন্ধিক, মুক্তচিন্তার আলোকবর্তিকা। তাঁর লেখায় যেমন মানবতার বোধ রয়েছে, তেমনি যুক্তি ও প্রগতিশীল চিন্তার শক্ত ভিত্তি রয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
বাবার স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ক্যাপ্টেন সৈয়দ জাহিদ হোসাইন বলেন, ‘আমরা লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। অথচ দুঃখজনক হলো, এত দিন বাবাকে নিয়ে এ জেলায় আলোচনা বা স্মরণসভা হয়নি। তাঁর মতো মহান প্রাবন্ধিকের জীবন ও দর্শন নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা জরুরি।’
জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের গবেষক ড. কুদরত-ই-হুদা বলেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী ছিলেন চিন্তার দিক থেকে ব্যতিক্রমধর্মী এক ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির সাধক, মানবতাবাদী দার্শনিক ও সাহিত্যপ্রেমী। তাঁর প্রবন্ধ আজও পাঠককে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা দেয়।
সাহিত্য, দর্শন ও সমাজচিন্তায় মোতাহের হোসেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন বলে জানান কবি জুননু রাইন। তিনি বলেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর লেখনী আজও প্রজন্মকে চিন্তার খোরাক জোগান।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী ১ এপ্রিল ১৯০৩ সালে তৎকালীন নোয়াখালী জেলা এবং বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানার কাঞ্চনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদিরের সঙ্গে যৌথভাবে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। বের করেন ‘শিখা’ নামের পত্রিকা। তাঁর রচিত প্রবন্ধ সংকলন ‘সংস্কৃতি কথা’ পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।